Advertisment

করোনা কি বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবনদর্শন?

ইতিহাস বলে, ভেঙে পড়া অর্থনীতি যতবার সমাজের গায়ে আঁচড় বসিয়েছে, যতবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে মানুষের, ততবারই বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
lockdown enforce

কলকাতার বেলেঘাটা এলাকায় লকডাউন বলবৎ করতে রাস্তায় পুলিশ। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। যা কিছু ইতিহাস পড়ে জানা। কিছুটা সাহিত্য বা সিনেমা থেকে জ্ঞান আহরণ। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ পেয়েছিলেন এমন মানুষের সংস্পর্শে এসেছি আমরা অনেকেই। আমাদের আগের দুই প্রজন্মের সেইসব মানুষের মুখে যুদ্ধ-পরবর্তী জীবন ও সমাজের কথা শুনে কিছুটা আন্দাজ তো নিশ্চয়ই হয়েছে।

Advertisment

আদতে যে কোনও বৃহৎ ঘটনারই দুটি দিক থাকে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। যুদ্ধে সরাসরি জড়িত পক্ষ তো বটেই, যারা নয়, তাদেরও জীবন প্রবলভাবে প্রভাবিত হয় পরবর্তী ঘটনাক্রমে। বলা বাহুল্য, ভালোর থেকে মন্দ প্রভাবই বেশি। মুষ্টিমেয় ক'জন অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে। বাকিরা বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত ও কেউ কেউ একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। সারা বিশ্ব জুড়েই আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের রূপরেখাটাই বদলে দেয় যুদ্ধ।

আমাদের জীবদ্দশায় করোনা ভাইরাস (Sars-Cov-2) সম্ভবত সেই বিশ্বযুদ্ধের আঁচই নিয়ে এল। এর সরাসরি প্রভাব কতটা ভয়াবহ, তা প্রতি মুহুর্তে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা বা সরকারি ব্যবস্থায় প্রাপ্ত খবরের আপডেটের মাধ্যমে অবগত হচ্ছি আমরা। আপাতত সেই প্রত্যক্ষ প্রভাব নিয়েই উত্তাল বিশ্ব। সেটাই স্বাভাবিক। যে রোগ আন্তর্জাতিক মহামারী বলে ঘোষিত। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। যার প্রতিষেধক এখনও আয়ত্তের বাইরে। তা নিয়ে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা তো হবেই। যদিও এর থেকে কোনও অংশে কম নয় এর পরোক্ষ বা পরবর্তী প্রভাব।

আরও পড়ুন: লকডাউনের দ্বিতীয় দিনেই উদাসীন বাংলা

সেনসেক্স সূচক তলানিতে ঠেকেছে, এ খবর রোজ দেখছি আমরা। শেয়ার বাজারের ওঠানামার সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতি ও তার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার তুল্যমূল্য বিচার বাজার বিশেষজ্ঞরা করছেন প্রতিনিয়ত। তবে, বিশেষজ্ঞ না হয়েও শুধুমাত্র সাধারণ বুদ্ধিবলেই অনেকটা বোঝা যায় বিষয়টা। বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক লেনদেন ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে। পর্যটন, বিমান ও রেল পরিষেবা, বিনোদন জগৎ, ছোট-বড় ইন্ডাস্ট্রি, সব ধরনের ট্রেডিং থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রথম সারির উৎসব-অনুষ্ঠান সব বন্ধ। কাজ বন্ধ। আয়ও বন্ধ। এর ফলে বহু প্রতিষ্ঠান আগামীতে মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা। কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা অগণিত মানুষের।

ভারতের মতো দেশ, যেখানে এমনিতেই অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, তার জন্য এ যেন মহা প্রলয়ের ইঙ্গিত! এর মধ্যে আবার যাদের ভবিষ্যৎ পুঁজি বলে কিছু নেই, তাদের অবস্থা ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, এমন এক প্রেক্ষিতে শ্রমজীবি মানুষের চিরন্তন লড়াই কঠিনতর হয়ে উঠতে চলেছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে তবু কিছুটা ভরসা আছে। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করেন, সেই সব মানুষ প্রবল অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি যে হতে চলেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এমন এক অবস্থায় সারা দেশ জুড়ে 'লকডাউন'-এর সরকারি সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা, যা করোনার আগ্রাসন রোধ করার ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত। আপাতত সত্যি এর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু ওই যে কিছু মানুষ অপরের সর্বনাশের মাঝেই নিজেদের পৌষ মাস খুঁজে নেয়! লকডাউন ঘোষণার পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের যোগানে কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। তবু কালোবাজারিরা সুযোগ পাওয়া মাত্রই মজুত ও যোগানে ঘাটতির খেলা শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। একদিকে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের রোজগার বন্ধ। কারণ তারা এখন গৃহবন্দি। রোজগার নেই অথচ মূল্যবৃদ্ধি। কোথায় যায় মানুষগুলো?

আরও পড়ুন: শ্রেণী বিভাজনের বেলুন ফুটো করে দিয়েছে করোনা, তবে আতঙ্কে অমঙ্গল

এখানে আর একটা কথা বলা বিশেষ জরুরি। কিছু মানুষের অতি তৎপরতা, গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি করেছে। "কদিন পরে বাজারে কিছুই পাওয়া যাবে না" বা "বাজার বন্ধ হয়ে যাবে", এই আতঙ্কে আমরা সকলেই ঘরে ঘরে এখন এক একটি মজুতদারে পরিণত। একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। এটা সত্যি যে পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার ফলে কিছুটা সমস্যা আছে। কিন্তু সমস্যাকে জটিলতর করছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী এবং কিছু গুজব ছড়ানো দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ।

অর্থনীতি, সেই প্রেক্ষিতে জীবনদর্শন ও চর্চা, করোনার প্রভাবে অনেক অভ্যাসেই ধাক্কা লাগতে চলেছে। বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয় উপকরণ কী, আর কী নয়, পরিস্থিতি সেই পাঠ পড়াচ্ছে আমাদের এখন। জীবনের এই নতুন পাঠ সকলেই যে খুশি হয়ে পড়ছেন, তা নিশ্চয়ই নয়। তবে, পরিস্থিতির বাধ্যতা এই মুহূর্তে এমন পর্যায়ে, যেখানে সমঝোতাই একমাত্র পথ। আসলে বেঁচে থাকা সবচেয়ে বড় বালাই। করোনা ভাইরাস কান ধরে সেটা আমাদের শেখাচ্ছে এখন।

মনের ভিতর কিছু প্রশ্ন এই প্রেক্ষিতে ঢেউ তোলে। আত্মকেন্দ্রিক বিপণন সংস্কৃতির আঁটোসাঁটো বাঁধন থেকে এই স্বল্প সময়ের মুক্তি কি সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষগুলির প্রতি কিছুটা সহমর্মী করে তুলবে আমাদের?  অথবা,আমার আর্থিক ক্ষমতা বা সোর্স আছে, তাই আমি এক বছরের পণ্য বাড়িতে মজুত করে ফেললাম। সেটা না করে একটু গভীরে গিয়ে ভাবলাম, এতে অপরের ভাগে বা ভাগ্যে কম জুটতে পারে। অতএব আমি কিছুটা তার জন্যও ভাবি। আগামীর জন্য এমনটা আশা করতে দোষ কোথায়?

আরও পড়ুন: করোনা অধিমারী: দায়িত্ব ও কর্তব্য

আর্থ-সামাজিক পতনকে ঘিরে সমাজে আর একটি অসুখেরও প্রাদুর্ভাব ঘটে। সক্রিয় হয়ে ওঠে অপরাধের কালো দুনিয়া। অজান্তেই কখন যেন পেটের খিদে টেনে নিয়ে যায় অপরাধের চোরাগলিতে। যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। অর্থনৈতিক সংকটে সামাজিক এই প্রবণতারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে দেখি আমরা বার বার। করোনার থাবা সেখানেও নতুন কিছু অধ্যায় লিখতে চলেছে সম্ভবত।

শুধু সংগঠিত অপরাধচক্র নয়, ব্যক্তিগত স্তরেও এইসব অগোছালো, বিপর্যস্ত অবস্থা আমাদের মনের অন্ধকারকে যেন খোঁচা মেরে জাগিয়ে তোলে। সম্প্রতি দুটি ঘটনা দেখলাম টিভির পর্দায়। একটি অতি চেনা। যে কোনও ধরনের বনধ বা অবরোধে কিছু অসাধু গাড়ির চালক ভাড়া দ্বিগুণ, তিনগুণ করে দেয়। সেদিন হাওড়া স্টেশনে সেটাই চলছিল। কেউ কেউ জানতেন না, রেল পরিষেবা বন্ধ। স্টেশনে চলে এসে বিপাকে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ওই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবি মানুষ। কাজেকম্মে বের হয়েছেন।

আর একটি ঘটনা মারাত্মক। এক বাংলাদেশি পরিবারকে এক উবার চালক, তাঁরা গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগপত্র নিয়ে চম্পট। প্রচুর টাকার জিনিস ও জরুরি কাগজপত্র ছিল সেখানে। তাঁরা পাগলের মতো ছুটোছুটি করছেন, একবার পুলিশ, একবার স্থানীয় উবার পরিষেবা কেন্দ্রে, এবং হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। এই যে উবার চালক এই অপরাধটি ঘটাল, এটা তাৎক্ষণিক লোভ বা সুচিন্তিত অপরাধ, দুটোর যে কোনও একটা হতে পারে। এক্ষেত্রে সবেরই উৎস কিন্তু সেই পরিবেশের অস্বাভাবিকতা।

এত কিছুর পরও নেতিবাচক এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই প্রতিবেদন শেষ করতে মন চায় না। ইতিহাস বলে, ভেঙে পড়া অর্থনীতি যতবার সমাজের গায়ে আঁচড় বসিয়েছে, যতবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে মানুষের, ততবারই বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে। আর এভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ। এই ঘুরে বা উঠে দাঁড়ানো, এই সংকটে হাতে হাত দিয়ে, পায়ে পা মিলিয়ে চলাই তো সভ্যতা। দেশের বেশ কয়েকটি বৃহৎ বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এসেছে আপৎকালীন এই সময়ে। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি ছেড়ে করোনা প্রতিরোধে একতাবদ্ধ।

মারণ ভাইরাস করোনা তামাম বিশ্বের বহু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মত্ত এখন। কিন্তু একদিন এ খেলার অবসান হবেই। তারপর থেকে শুরু নতুন লড়াই। মানুষের নতুন করে বাঁচার পরীক্ষা। মনুষ্যত্ব বড়ই শক্তিশালী। বন্যার পর পড়ে থাকা পলি যেমন উন্নত ফসল ফলায়। তেমন করেই এই বিশ্ব একদিন দেখুক, সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে মনুষ্যত্বই জয়ী হচ্ছে।

Advertisment