Advertisment

বিশ্ব-স্বাস্থ্য, সুস্থ বিশ্ব

ট্রাম্প সাহেব ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি "ফেলো কড়ি মাখো তেল" নীতিতে বিশ্বাসী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
America WHO Funding

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ভাতে মারলে আসলে বিশ্বের স্বাস্থ্যকেই হাতে মারা হবে

সুস্থতা রক্ষার জন্য বা অসুখকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য মানুষের লড়াই সমষ্টিগত হওয়া উচিত, এই কথা আমরা অনেকেই বহুদিন ধরে বিশ্বাস করি এবং সোচ্চারে বলে থাকি। COVID-19 অতিমারী এই সত্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। আমরা দেখলাম যে সমষ্টি মানে এক্ষেত্রে শুধু একটি শহরের পুরসভা বা একটি রাজ্য নয়, এমনকি একটিমাত্র দেশও নয়, সমগ্র পৃথিবীকেই বোঝাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক সমন্বয় গড়ে তোলা এবং পরস্পরের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, গবেষণা এবং সহযোগিতার ওপর নির্ভর করা ছাড়া এই ধরণের "বৈশ্বিক মহামারী" থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এই ধরণের সমন্বয় গড়ে তোলা এবং আরও বাড়ানোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য সংকট থেকে মুক্তির সোনার কাঠি। এই কাজে অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation)-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্মল পক্স থেকে পোলিও, নানা ভয়ঙ্কর সংক্রামক রোগকে দুনিয়া থেকে তাড়ানোর ক্ষেত্রে এই সংস্থার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

Advertisment

আজ থেকে বাহাত্তর বছর আগে এরকম বেশ কিছু উদ্দেশ্য নিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে গঠিত হয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারও প্রায় এক শতাব্দী আগেই অনুভূত হয়েছিল সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা। ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে কলেরা, প্লেগ, পীতজ্বর ইত্যাদি প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের মোকাবিলার জন্য শুরু হয় ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্স। প্রথমদিকে বড় কিছু করে উঠতে পারেনি তারা, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সপ্তম কনফারেন্স থেকে তারা সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। কিছু রোগের মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সমন্বয় গড়ে তুলতে, কিছু প্রস্তাব পাশ করাতে এবং কিছু নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী প্রচলন করতে সমর্থ হয় তারা। এই সাফল্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন দেশে ক্রমশ গড়ে উঠতে থাকে স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা সংস্থা। পরবর্তীকালে ইউনাইটেড নেশনসের জন্মের পর এমন বিভিন্ন সংস্থাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে গঠিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর ইতিহাসটি মনোগ্রাহী। পরে কখনো তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতীয় শ্রমিক

দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য সমষ্টিগত লড়াইয়ের প্রয়োজন সারা বিশ্বে ক্রমশ বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল এবং বিগত পৌনে দুই শতাব্দী ধরে এই উদ্দেশ্যে পৃথিবীর মানুষ ক্রমশ সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন। প্রত্যাশিত ছিল করোনাভাইরাসের প্রকোপে একবিংশ শতকের প্রথম অতিমারী এই প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করবে এবং মানুষে-মানুষে যদ্ধের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে সকলে মিলে সকলের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা আরও প্রবল হবে। এমনটা হলেই ভালো হত, কিন্তু ইতিহাস বলে যে যা হলে সবচেয়ে ভালো হত, তা সবসময় হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কেউকেউ এই সংকটকালেই উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের নাম প্রথমেই উঠে আসবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে COVID-19 অতিমারীর রাজধানী হয়ে উঠেছে। যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন শুধুমাত্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নব-করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে এগারো লক্ষ, মৃতের সংখ্যা ছেষট্টি হাজার ছুঁইছুঁই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের চেয়েও বেশি সংখ্যক মার্কিন নাগরিক নিহত হলেন করোনা যুদ্ধে। উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণ মার্কিনীদের মৃত্যুর জন্য ক্ষমতাবানদের লোভ আর সরকারের নীতিকে কিছুটা দায়ী করা যায়। এবার প্রথমাবস্থায় মার্কিন প্রশাসন সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। নিউইয়র্ক শহরে রোগের সংক্রমণ ধরা পড়ার পরেও ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছে। অর্থনীতিকে বাঁচানোর যুক্তিতে হেয় করা হয়েছে মানুষের জীবনের মূল্যকে। তার ফলে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। তারপর যখন গেল গেল রব উঠেছে এবং চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখন দেখা গেছে প্রস্তুতির অভাব আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও ধনী দেশটি এমন মহামারীর মোকাবিলা করার জন্য তৈরি নয়। হাসপাতালে যথেষ্ট সংখ্যক মাস্ক বা গ্লাভস নেই। কর্পোরেট হাসপাতাল নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি এই বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যর্থ। এই রোগে ব্যবহারযোগ্য ওষুধ যেহেতু তেমন দামী নয় এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়, তাই তা তৈরি করে না আমেরিকা। ফলত ওষুধ জোগাড় করার জন্য অন্য দেশের কাছে হাত পাতা ছাড়া গতি নেই। অবশ্য হাত পাতার ধরণটির মধ্যেও দম্ভের প্রকাশ লুকোতে চেষ্টা করেননি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প। চিন বা ভারতের তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও অসুস্থ ও মৃতের সংখ্যায় সবাইকে টপকে গেছে আমেরিকা।

এমতাবস্থায় দেশের মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে পারে ট্রাম্প সরকার। একইসঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষতির ফলে বাঘা-বাঘা ধনী ব্যবসায়ীদের রাগের মুখে পড়ার ভয়ও। এদিকে বছর ঘোরার আগেই নির্বাচন হবার কথা। ক্ষমতা দখলে রাখার লোভ বড় বালাই। উভয় সংকটে কোণঠাসা ট্রাম্প বড়-বড় কথার আশ্রয় নিলেন। তাঁর পারম্পর্যহীন কথাবার্তায় অবশ্য বিভ্রান্তিই বাড়ল শুধু। আজ করোনা মোকাবিলায় চিনের ভূমিকার প্রশংসা করে কদিন আগে আবার চিনকে গালাগালি দিয়ে আমেরিকার সমস্যার জন্য তাদের দায়ী করে নিজের দায় এড়াতে ব্যস্ত হন। চাপে পড়ে লক-ডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হয়ে পরমুহূর্তেই বলেন বণিকদের স্বার্থে তাড়াতাড়ি কাজকর্ম স্বাভাবিক করার করা। দুটো ওষুধের নাম শোনামাত্র মুখ্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে কথা না বলেই ওষুধের নামসহ টুইট করে বলেন সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, যার জেরে দুনিয়ায় লোক ওষুধ কিনে বাড়িতে জমিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন।

ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! – কোভিড দুনিয়ার বাস্তব

তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ক্ষতিকর ট্রাম্পোচিত সিদ্ধান্ত হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করা। এই আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকাণ্ড বিপুল এবং তা নির্বাহ করার খরচও কম নয়। সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে সংগৃহীত চাঁদা বা অনুদানেই সেই খরচ মেটানো হয়। যেহেতু দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে বেশি অর্থ নিলে বিশ্বের সর্বত্র স্বাস্থ্য পরিষেবার বিকাশ ঘটানোর মূল উদ্দেশ্যটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে বেশি অর্থ অনুদান হিসেবে নেওয়া হয়। একথা অনস্বীকার্য যে দাতা দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বরে আছে আমেরিকা। তাদের আর্থিক ক্ষমতা সর্বাধিক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মোট অনুদানের প্রায় সতেরো শতাংশ দেয় তারা। ট্রাম্পের জমানার আগে থেকেই আমেরিকার এই ভূমিকাটি বজায় আছে। ট্রাম্প সাহেব ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি "ফেলো কড়ি মাখো তেল" নীতিতে বিশ্বাসী।

এই বিশ্বাস থেকে পূর্বতন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার আনা স্বাস্থ্য পরিষেবা বিষয়ক সংস্কারেরও বিরোধিতা করেছেন তিনি। একই কারণে সকলের জন্য স্বাস্থ্য, নিখরচায় ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা দান বা স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার ভাবার মতো নীতিগুলো তাঁর অপছন্দ। স্বভাবতই তিনি প্রত্যাশা করেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হাতজোড় করে মূলত আমেরিকার স্বার্থেই কাজ করবে। বদলে তারা অনুন্নত দেশগুলোর কথা বেশি ভাবলে বড়সাহেব গোঁসা করতেই  পারেন। সংস্থার বর্তমান সভাপতি ইথিয়পীয় তেদ্রস আধানম প্রথম থেকেই সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বলে ট্রাম্পবাবুর বিরক্তি উৎপাদন করেছেন। তারপর এই অতিমারী সামলানোর জন্য সংস্থাটি চিনকে সাহায্য করায় এবং ট্রাম্প সরকারের ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করায় বেদম চটে তাদের ভাতে মারার কথা ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ভাতে মারলে আসলে বিশ্বের স্বাস্থ্যকেই হাতে মারা হবে। আমেরিকার সেনেট বা কংগ্রেসের সব সদস্য ট্রাম্পের সঙ্গে একমত হবেনা না নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেহাৎ কম নয়। আমেরিকা অর্থসাহায্য বন্ধ করলে হয়ত অন্য কোনো জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জুটে যেতে পারে WHO-র, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে, তাতে আরও কিছু দেশ যদি আমেরিকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তাহলে বিশ্বের স্বাস্থ্য সত্যিই সমস্যায় পড়বে। অর্থাভাবে WHO-র বেশ কিছু কাজ বন্ধ হয়ে যাবে এবং বাকি সামর্থ্যটুকু কাজে লাগিয়ে তারা কোন ধরণের কাজে আত্মনিয়োগ করবে, তাও যদি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চাপে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে বিশ্বমানবের স্বাস্থ্য কয়েক যুগ পিছিয়ে যাবে।

কোভিড-১৯: বিজ্ঞান, তথ্য, এবং কিছু বিকৃতি

ধনী দেশগুলো ভাবতে পারে যে এর ফলে শুধু গরিবেরা মরবে এবং তারা অর্থবলে নিজেদের সামলে নেবে, ঠিক যেমনটা ভাবেন ধনী ব্যক্তিরা। অতিভোজনে উদরের পাশাপাশি মগজের রক্তবাহী ধমনিতেও চর্বি জমে যাবার ফলে চিন্তাভাবনার নানারকম সমস্যা হতে পারে অথবা অহংকারে আচ্ছন্ন হতে পারে যুক্তি-বুদ্ধি। তা নাহলে দেখতে পাওয়া যেত যে সবাইকে খারাপ রেখে একা ভালো থাকার চেষ্টায় কিছু স্বল্পমেয়াদী সাফল্য পাওয়া গেলেও অনেক দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা আছে।

COVID-19 স্পষ্ট করে দেখাল যে সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণে বাকিদের মরতে দিয়ে তার প্রকোপ থেকে শুধু নিজেকে বাঁচাতে গেলে লখীন্দরের লৌহবাসরে নিজেকে যাবজ্জীবন কয়েদ করতে হবে। তবু চাঁদ বণিকের হেঁতাল লাঠি এড়িয়ে শ্বাস নেবার ছিদ্রটুকু দিয়ে হঠাৎ প্রবেশ করতে পারে কালনাগিনী। এই বিশ্বায়িত বাণিজ্যের যুগে সপ্ত ডিঙা ভাসাতে না পারলে ধনী দেশগুলোর ধনের ভাণ্ডার খালি হয়ে যাবে, আবার ডিঙা ভাসালে মোহরের থলিতে চেপে এশিয়া-আফ্রিকা থেকে উজিয়ে আসতে পারে অচেনা জীবাণু। করোনার মতো ভাইরাসেরা ভিআইপি কালচার জানে না, কাউকে রেয়াত করে না। পাশের বস্তিটিকে অসুস্থ রেখে অট্টালিকায় ভালো থাকার দিন সম্পূর্ণ না ফুরোলেও আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। কখন সন্ধে হয়ে যাবে টেরও পাবেন না। সময় থাকতে ক্ষমতাবানেরা বুঝলে ভালো, না বুঝলেও সময় থেমে থাকবে না।

(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

 

এই কলামের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Donald Trump WHO Jon O Swasthyo COVID-19
Advertisment