Advertisment

আতঙ্কিত দুনিয়ায় ব্রাত্য হোক ক্ষুদ্র রাজনীতি

দেখুন, এই ভাইরাস আজ কিভাবে ভারত ও পাকিস্তানকে কাশ্মীর সংকট ভুলিয়ে ঐক্যের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইজরায়েল ও প‍্যালেস্তাইন করোনা নিয়ে আলোচনায় বসেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus world

হাওড়া স্টেশনে আতঙ্কের স্বাস্থ্য পরীক্ষা। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি কখনও দেখিনি। কোভিড-১৯ তো শুধু আতঙ্ক নয়। এ তো বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রবিবার ভারতে জনতা কার্ফুর কথা ঘোষণা করেছেন। আরোপিত নয়, এ হলো স্বতঃস্ফূর্ত আইসোলেশন। ইতালি করেছে, স্পেন করেছে, ভারতীয়রাও বাড়ির ব‍্যালকনিতে এসে হাততালি দিয়ে, শঙ্খধ্বনি দিয়ে এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের স্বাগত জানাবেন।

Advertisment

সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুল প্রচারিত একটি মন্তব্য: এতদিন বাঙালি বিলেতফেরত ডাক্তার দেখেছে, এবার দেখল বিলেতফেরত রোগী। আপাত-লঘু মন্তব্য। কিন্তু এর মধ্যে আছে বাঙালির দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শ্লাঘার উপর এক তীব্র কষাঘাত। করোনাভাইরাস মহামারীর দৌরাত্ম‍্যের পরও যদি আমরা 'ভালো', 'দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন' নাগরিকের পরিচয় দিতে না পারি, তবে এ দুঃসময় আরও জটিল, আরও প্রলম্বিত হতে পারে।

পৃথিবীতে চিনের পর প্রথম কোন দেশ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলো? ইতালি। ইতালির সবচেয়ে ধনী শহুরে নাগরিক এলাকায় এই রোগটির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ইতালির রাজশক্তি ভেবেছিল, এ সমস্যা সামলে নেবে। প্রথম দিকটিতে সেই অর্বাচীন বিলেতফেরত বঙ্গসন্তান রোগীটির মতোই হাবভাব ছিল ওদের। 'ডোন্ট কেয়ার'। তারপর? দেশে নিউমোনিয়া-করোনার প্রকোপের মোকাবিলায় ভেন্টিলেটর আর অক্সিজেনই কম পড়ে গেল! এমন অবস্থা যে, অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো সচেতনভাবে। ফলে মৃত্যুর হার হলো কল্পনাতীত।

coronavirus world করোনার দাপট। রবিবার দিল্লিতে জনতা কার্ফুর চিত্র। ছবি: রেণুকা পুরী, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

চিন বাদ দিয়ে ১২১টি দেশে করোনার থাবা প্রসারিত। ইতালির স্বাস্থ‍্য পরিষেবা 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস', এমনটাই রাষ্ট্রসংঘ পর্যন্ত মানত। কিন্তু সেই ইতালিতে মানুষের বেপরোয়া মনোভাব এবং কিঞ্চিৎ বেশি গণতন্ত্র, অত‍্যধিক ব‍্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সামাজিকতা দেশটাতে মড়ক লাগাল। চিন অবশ‍্য যা করেছে, যা করতে পেরেছে, তা ইতালি পারেনি, আমেরিকাও পারবে না। আমরা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কীভাবে কতটা পারব জানি না।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একদলীয় শাসনের সুবিধা নিয়ে চিনা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব 'ব্রুটাল কোয়ারেন্টিন' অর্থাৎ, বাধ‍্যতামূলক দমননীতির সাহায্যে একঘরে করেছে দেশের মানুষকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যতই বলুন, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তা কি করা সম্ভব? চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘটনা জানার পর একবার উহান গেলেন, তারপরই নিয়ন্ত্রণের চিনা অপারেশন।

স্বাস্থ্য ব‍্যবস্থার মধ্যে যেসব দেশে এক বিশ্বজনীন জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা আছে, সেসব দেশে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হচ্ছে। যেমন ব্রিটেন। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে বেসরকারি বানিজ্যিক হাসপাতাল এখনও বেশি ক্ষমতাশালী লবি, সেখানে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন। আমেরিকার ২৮ মিলিয়ন মানুষ এখনও স্বাস্থ‍্যবিমার অধীনে আসেন নি, ১১ মিলিয়ন মানুষ অবৈধ বসবাসকারী।

করোনাভাইরাস নিয়ে আরও সমস্যা হলো, এখনও এই ভাইরাসটি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিতভাবে খুব বেশি কিছু জানি না। দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাস মহামারীর আকার ধারণ করে যেভাবে দ্রুত ছড়াচ্ছে - ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে সে গতি আটকানো গেলেও, এখানে আমাদের গবেষক, চিকিৎসা ও রাষ্ট্রনেতাদের পক্ষে আটকানো সম্ভবপর তো?

coronavirus world বাজার আছে, ক্রেতা নেই। কলকাতায় ২২ মার্চের জনতা কার্ফু। ছবি: শশী ঘোষ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এখনও পর্যন্ত করোনার প্রকোপ গোটা দুনিয়ায় এবং আমাদের দেশে যা দেখা যাচ্ছে, তার সম্ভাব‍্য অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ। বাজার-দোকান বন্ধ। বিশ্ব বাজারের আমদানি-রপ্তানি তথা শেয়ার বাজার, সবই এক চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি। বাজার যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, রাজস্ব সংগ্ৰহ যদি না হয়, তবে কর্মসংস্থান তথা জীবিকা কিভাবে চলবে? পরিস্থিতিতে কী পরিবর্তন হবে জানি না, কিন্তু ইতিমধ্যেই যা হয়ে গিয়েছে তাতেই সংকট যথেষ্ট গভীর।এমনিতেই বিশ্ব তথা ভারতের আর্থিক অবস্থা খারাপই ছিল। সেখানে করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিল।

এখন তাই ক্ষুদ্র রাজনীতি ভুলে, পারস্পরিক দোষারোপ ভুলে এক রাষ্ট্র অন‍্য রাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়াক। সেটাই কাম‍্য। চিন অভিযোগ করেছে, মার্কিন সেনাবাহিনী উহানে এই ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর আমেরিকার প্রচার: চিন হলো এই ভাইরাসের আঁতুড়ঘর, এখান থেকেই পৃথিবীতে ছড়িয়েছে; অতএব এ হলো চিনের জৈব-রাসায়নিক যুদ্ধের রিহার্সাল। আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র বা সরকার নয়, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই প্রচার চলছে।

আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোনও জিনিস প্রচার করতে কোনও অসুবিধা নেই! কোনটা যে 'সত‍্য' আর কোনটা যে 'মিথ্যা', কে বিচার করবে? সত‍্য চাপা পড়ে যাচ্ছে 'ফেক নিউস'-এর দৌরাত্ম‍্যে। এ হলো উত্তর-সত্য যুগ। তবে এ গুজবের বাস্তব ভিত্তি হলো একটি উপন্যাস। মার্কিন ঔপন্যাসিক ডিন কুন্ট্জ-এর লেখা 'দ‍্য আইজ অফ ডার্কনেস'। এর একটা পাতাও এখন 'মহামারী' । ১৯৮১ সালে এই উপন্যাস যখন প্রকাশিত হয়, তখন ওই পাতায় ভাইরাসের নাম কিন্তু লেখা ছিল 'গোর্কি-৪০০'। রুশ-মার্কিন চরম 'ঠান্ডাযুদ্ধ'-র সময়ই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। 'পেরেস্ত্রৈকা'-র পর যখন দু-দেশের মধ্যে 'ঠাণ্ডাযুদ্ধ'-র অবসান হয়, তখন কুন্ট্জ সাহেব গোর্কি বাদ দিয়ে মারণ ভাইরাসটির নাম দিলেন 'উহান-৪০০'।

coronavirus world ডিন কুন্ট্জ-এর লেখা সেই বই ও তার পাতা

বইটি ১৯৮৯ সালে সংশোধিত হয়ে নবকলেবরে প্রকাশিত হয়। আসলে 'ঠান্ডাযুদ্ধ'-র পর ততদিনে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, আর মার্কেট যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে চিন। 'সিএনএন' ও 'সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট' সম্প্রতি এসব তথ্য প্রকাশ করে আবার বাজার গরম করেছে। ১৯৮১ সালে 'লেই নিকোলস্' ছদ্মনামে ডিন কুন্ট্জ বইটি লেখেন, তারপর ১৯৮৯ সালে তিনি নিজের নামেই বইটি প্রকাশ করেন। তবে এখানেও তথ্য বিভ্রান্তি আছে। লেই নিকোলস্ নাকি অন‍্য আর একজন ব‍্যক্তি ছিলেন, তা ' ছদ্মনাম' ছিল না। তবে উইকিপিডিয়া, যা সাধারণ তথ্য পেতে মানুষের বেসিক সোর্স, যেখানে স্পষ্ট বলা যে, লেই নিকোলস্ ছদ্মনাম-ই।

জৈব রাসায়নিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ও তার আগাম সায়েন্স ফিকশন সম্পর্কে আমার জ্ঞান কম। প্রবীণ সাংবাদিক তুলসী দত্ত, রূপকুমার বসু ও শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এ ব‍্যাপারে বহু প্রবন্ধ লেখেন। জে মিলার, এস এন্ড্রেলবার্গ ও ব্রডের বিখ্যাত বই 'জার্মস'। তাতেও এ ব‍্যাপারে আগাম অনেক কথা বলা হয়।

coronavirus world গোয়ার এই জনহীন সমুদ্রতট এখন সারা পৃথিবীর প্রতিভূ হতে পারে। এক্সপ্রেস ফোটো

কিন্তু আমার মনে হয় না, নিজের দেশের এত লোকসান করে চিন বা আমেরিকা কেউ-ই এ কাজ করবে। তাই আজ এসব গুজব ভিত্তিক বৈরীর আবহকে না বাড়িয়ে বরং উচিত যৌথভাবে এই ভাইরাসের মোকাবিলা করা। দেখুন, এই ভাইরাস আজ কিভাবে ভারত ও পাকিস্তান, এই দুই দেশকে কাশ্মীর সংকট ভুলিয়ে ঐক্যের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অনেক দিন পর কাঠমান্ডুতে দুই দেশ মিলিত তো হলো। প্রত‍্যেক বছর এ সময়
২৩ মার্চ 'পাকিস্তান দিবস'কে কেন্দ্র করে দিল্লিতে টেনশন বৃদ্ধি পায়। পাক হাই কমিশনে আমন্ত্রণ জানানো হয় হুরিয়াত নেতাদের। সেখানে এ বছর পাকিস্তান দিল্লি দূতাবাসে এই অনুষ্ঠানটিই বাতিল করে দিয়েছে।

ইজরায়েল ও প‍্যালেস্তাইন - দুই পক্ষ করোনা নিয়ে আলোচনায় বসেছে। হয়তো দেখব উত্তর কোরিয়া আর দক্ষিণ কোরিয়াও কথা বলছে এই ভাইরাস নিয়ে। এই ভাইরাস যেহেতু পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত, তাই এক দেশ থেকে অন‍্য দেশে যাতায়াত বন্ধ করতে হচ্ছে‌। সব রাষ্ট্রই সুরক্ষিত থাকার জন্য বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করছে।

'কোয়ারেন্টিন' নামক (অধুনা জনপ্রিয়তম) শব্দটি র আভিধানিক উৎসেও আছে 'বন্দরে নিষেধাজ্ঞা'। রোগ সংক্রমণের প্রসার বন্ধ করার জন্য বন্দর এলাকায় যখন যাত্রীদের আলাদা করে রাখা হত, তখন তাকে বলা হত 'কোয়ারেন্টিন'। আজ আবার সব দেশ নিজেদের 'একঘরে' করতে উদ‍্যত। আপাতত আমরাও তা করতে বাধ্য। সরকার করলেও তা মানতে হবে। গণতন্ত্রের নামে রোগীর যত্রতত্র বিচরণ সমর্থনযোগ্য নয়।

তবে এই সাময়িক রাষ্ট্রীয় 'একঘরে নীতি' বিশ্বায়নের সামাজিকতাকে যেন আঘাত না করে, কারণ একদিকে যেমন জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে, ঠিক সেভাবেই সমস্ত দেশকে সমস্ত ভেদজ্ঞান ভুলে একত্রিত হতে হবে। মোকাবিলা করতে হবে করোনার। প্রয়োজন ভারসাম‍্য। একদিকে চাই বিশ্ব-ঐক্য সংহতি, অন‍্যদিকে কোয়ারেন্টিনের জন্য সংশ্লিষ্ট মানুষকে বাধ্য করা। গণতন্ত্র আর এই নির্দেশের মধ্যেও চাই সামঞ্জস্য। চিনের মতো 'দমননীতি' নয়, কিন্তু তাই বলে বিমানবন্দরে প্রত‍্যেক নাগরিকের পরীক্ষা হচ্ছে বলে অসহিষ্ণু ভারতীয়দের যখন টিভি ক‍্যামেরার সামনে চিৎকার করে সরকারকে গালি দিতে দেখছি, তখনও মনে হচ্ছে এহেন অসহিষ্ণুতা আজ মোটেই কাম‍্য নয়!

বরং প্রত‍্যাশা একটাই: দুনিয়ার গবেষক বিজ্ঞানীরা একত্র হয়ে খুব শীঘ্রই এই ভাইরাসেরও প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। যেমনটা পেরেছেন অতীতে।

Advertisment