বেজায় গরম, কিন্তু কোন কাজ না থাকায় টিভির সামনের লম্বা সোফায় চুপচাপ শুয়ে আছি। ফ্যান চলছে, তবে এসি নেই। তাই ঘেমে অস্থির।
পাশে গামছাটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্যে যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি গামছাটা বলল “পিং”! কী আপদ, গামছাটা পিং করে কেন?
চেয়ে দেখি গামছাটা তো আর গামছা নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টকটকে একটা কোভিড-১৯ ভাইরাস চার দিকের দাঁড়া ফুলিয়ে প্যাটপ্যাট করে আমার দিকে চেয়ে আছে!
আমি ভয়ে চটকে চৌত্রিশ, “কী বিপদ! ছিল গামছা, হয়ে গেল বেমক্কা ভাইরাস।”
অনলাইনেও লক ডাউন! এমনটা তো কথা ছিল না
অমনি ভাইরাস বলে উঠলো, “বিপদ আবার কি? পিং শুনেই তোমার শুরুতেই চিনে নেওয়া উচিৎ ছিল আমি চিনে। আর হোয়াটসঅ্যাপে যে অন্যকে ডাকার বদলে পিং করতে হয় সে তো তোমরা ভালোই জানো। ছিল সাত হয়ে গেল তিন, মরল কোভিডে কৃতিত্ব পেল কেৎরে থাকা অকৃতকার্য কিডনি। এ তো হামেশাই হচ্ছে।”
আমি খানিক ভেবে বললাম, “তা হলে তোমায় এখন কী বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের ভাইরাস নও, আসলে তুমি হচ্ছ গামছা”।
ভাইরাস বলল, “কোভিডও বলতে পার, কিডনি-কিলারও বলতে পার, নিউমোনিয়াও বলতে পার, আর অবশ্যই চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার”। আমি বললাম “চন্দ্রবিন্দু কেন?”
শুনে চিনে ভাইরাস বলল, “তাও জানো না?” বলে একটু হেঁটে রান্নাঘর থেকে একটা থালা আর সঙ্গে রুটি বেলার বেলন নিয়ে এসে ঠং করে একবার বাজিয়ে দিল।
সারাদিন কাজ করে পাশের ঘরে গিন্নি ঝিমুচ্ছিলেন। আধঘুমে খেঁকিয়ে উঠে জানালেন, “আগের দিন তো যথেষ্ট বাটি বাজিয়ে পেছনগুলো তুবড়ে দিয়েছো। টেবিলে রাখতে গেলেই নড়ে যাচ্ছে। সেই জন্যে দাদা বলেছেন আর বাটি না বাজাতে। এমনিতেই বারোটা বেজেছে, এবার জ্বলবে। আজ রাতে প্রদীপ কিংবা মুঠোফোন।”
“চাইনিজ ভাইরাস” আসলে ছড়ালো কে?
গিন্নির খিঁচুনিতে ভাইরাস ভ্যানিশ। বাড়িতে গিন্নি থাকার এই এক সুফল। কাক, চড়াই, মশা, ডেঙ্গু, কোভিড কিছুই ঘেঁষতে সাহস পায় না। ভাইরাস বিদায় নেওয়ায় আমিও আরও কিছুক্ষণ আলিস্যির পরিকল্পনা করলাম। চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, করোনার আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হতে তাকিয়ে দেখি বারান্দার পাশের গাছ থেকে কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠলো, “তিনের সঙ্গে আরও চারটে চন্দ্রবিন্দু যোগ করলে কত হয়?”
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? বিজেপি না তৃণমূল? এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, “কই জবাব দিচ্ছ না যে? তিন আর চারে কত হয়?” তখন ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি কোভিডের শুকনো কাশিতে বসন্তের কোকিলের গলা ভেঙে গেছে। হাতে একটা মুঠোফোন নিয়ে কোকিলের ডাক শোনাচ্ছে, আর সেখানেই ক্যালকুলেটর দিয়ে অঙ্ক কষছে। মাঝে মাঝে ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি বললাম, “তিন আর চারে সাত।”
কোকিল অমনি দুলে দুলে মাথা নেড়ে বলল, “হয় নি, হয় নি ফেল। বামফ্রন্ট আমলে সেই যে ইংরিজি উঠে গেছিল, তখন থেকেই অঙ্কের এই দশা। পাখিদের পাঠশালাতে না পড়লে এমনটাই হয়।”
আমার কাঁচা ঘুম ততক্ষণে চটকে গেছে। ভয়ানক রাগ হল। বামফ্রন্ট আমলে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি, সেই শংসাপত্রকে অপমান? বললাম, “নিশ্চয় হয়েছে। তিন আর চার যোগ করলে সাত, গুণ করলে বারো, আর শাসকদের মত পাওয়ার হাতে পেলে তিন এর মাথায় চারকে তুলে একাশি।”
কোকিল কিছু জবাব দিল না, খালি মুঠোফোনে দু পায়ের সরু আঙুল দুটো দিয়ে টুকটুক করে কী যেন লিখল। তারপর বলল, “দাঁড়াও, তিন আর চারে কত হয় হোয়াটসঅ্যাপ করে প্রশাসকদের জিগ্যেস করেছি। তারা আবার ওপর থেকে অনুমতি নেবে। ততক্ষণ এই আমার ডানার তলায় ঢাকা থাকল মুঠোফোন।”
আমি বললাম, “তার মানে এখন নতুন হাওড়া সেতুর কোলে অঙ্ক কষা হচ্ছে? তা সেটা আগে বললেই হত। ভুলভাল বকছিলে কেন?”
২১ দিনে হবে না, বলছে বাঙালি বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক গবেষণা
কোকিল এর মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে পিং পেয়ে গেছে। সেটা পড়ে নিয়ে বলল, “তুমি যখন বলছিলে তখনও পুরো অঙ্ক কষা হয় নি। আগের বার ছিল অজানা জ্বরে তিন আর সাতে দুই। গত বছর যদি ধাঁই করে সাত লিখে ফেলতাম, তাহলে কোভিডের বাজারে হয়ে যেত সাত পূর্ণ সাতের সতেরো।”
আমি বললাম, “এমন আনাড়ি কথা তো কখনও শুনি নি। তিন আর চারে যদি সাত হয়, তা সে সব সময়েই সাত। বাম রাজত্বে হলেও যা, তৃণমূলের শাসনেও তাই। কেন্দ্রে কংগ্রেসই থাকুক কিংবা বিজেপি, মার্কিন দেশে ওবামাই হোক কিংবা ট্রাম্প।”
কোকিল ভারি অবাক হয়ে বলল, ”তোমাদের দেশে রাজনীতির দাম নেই বুঝি?”
আমি বললাম, “রাজনীতির দাম কিরকম?”
কোকিল বলল, “কোভিডের আতঙ্কে আর কদিন পরেই বুঝবে। রাজনীতির বাজারে এখন ভয়ানক মাগ্যি, এতটুকু বাজে খরচ করা জো নেই। এই তো কদিন খেটেখুটে চুরিচামারি করে খানিকটা রাজনীতি জমিয়েছিলাম, তাও আবার তোমার মত একটা আকাটের সঙ্গে তর্ক করতে করতে আর্ধেক খরচ হয়ে গেল।” বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি আর বাজে না বকে চুপচাপ বসে রইলাম।
এমন সময় হঠাৎ গাছের একটা ফোকর থেকে কী যেন একটা সুড়ুৎ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি তিন হাত লম্বা এক বুড়ো, তার ছুঁচলো দাড়ি, একদিক সবুজ, একদিক গেরুয়া। মাথা ভরা টাক, তাতে একটা টিকি। সে দণ্ডি কাটছে।
বুড়ো দণ্ডি কেটে কেটে তিন হাত দূরত্ব মেপে বেশ কিছু গোল আঁকলো। তারপর খুব ব্যস্ত হয়ে উঠে এসে ঘোষণা করল, “নিজামুদ্দিনে তাবলিঘি জামাত আর কিষ্কিন্ধ্যায় রামনবমী সেরে সামাজিক দূরত্ব সম্পূর্ণ। আর কোন ভয় নেই। মুড়ি চলতে পারে, সঙ্গে রাতে একবার ডাল, ভাত আর আলুসেদ্ধ খেলেই সব সমস্যার সমাধান। অর্থনীতিও বিন্দাস। ট্রাম্প ব্যাটা বোকা, তাই দু লক্ষ কোটি ডলার ঢালছে। আমাদের এখানে ন-মিনিট সব অন্ধকার করে প্রদীপ জ্বালালেই কাজ সারা। মা লক্ষ্মী ঘরে ঢুকে টাকা-পয়সা, চাল-ডাল, মাস্ক-গ্লাভস রেখে চলে যাবেন। পথ দেখানোর জন্যে প্রদীপ না থাকলে মুঠোফোনের আলো জ্বালালেও চলবে।”
আমি ভাবলাম, এ নিশ্চয় বড় কেউ হবে। লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা, নবান্ন, বা নিদেন আলিমুদ্দিন। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “এই আপদ মিটবে কত দিনে?”
বুড়ো বলল, “উনিশ।”
কোকিল অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, “লাগ লাগ লাগ কুড়ি।”
বুড়ো বলল, “একুশ”। কোকিল চেঁচাল, “বাইশ”। বুড়ো বাড়াল, “তেইশ”। ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
ডাকতে ডাকতে কোকিল হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বল, “তুমি ডাকছ না যে?”
আমি বললাম, “খামকা ডাকতে যাব কেন?”
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাৎ আমার আওয়াজ শুনেই সে বনবন করে আঠাশ পাক ঘুরে, আঠাশ দুগুণে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালো।
পকেট থেকে একটা লম্বা স্টেথোস্কোপ বার করে আমার বুকে ঠেকিয়ে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগল। তারপর নাকে একটা মাস্ক আর হাতে একটা গ্লাভস পরে চটজলদি আমার পেট, পিঠ, ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টিপতে লাগল আর হাঁকতে লাগলো, “বৃক্ক ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, যকৃৎ ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, ফুসফুস ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, খাদ্যনালী ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, বৃহদন্ত্র ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, ক্ষুদ্রান্ত্র ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, পাকস্থলী ছাপ্পান্ন ইঞ্চি।”
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, “এ হতেই পারে না, সব মাপই ছাপ্পান্ন ইঞ্চি? আমি কি শুয়োর?”
বুড়ো বলল, “বিশ্বাস না হয়, একবার ইতিহাস বই খুলে দেখ। মনোমহনের নেতৃত্বে কংগ্রেস দশ, তারপর মোদীর দখলে বিজেপি আরও দশ, বামফ্রন্ট চৌত্রিশ বছর, তৃণমূল দশ ছুঁতে চলেছে। এর পরেও সন্দেহ আছে?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে। ঘরে হাত ধরাধরি করে ডেঙ্গুর মশা আর করোনার ভাইরাস ঢুকবে। তাই এই গরমেও দরজা জানলা সেঁটে দিলাম। গোটা ঘটনাটা ছেলেমেয়েকে বলতে গেছিলাম। তারা একটু শুনে বলল, “আসলে আবগারি দোকান বন্ধ তো, তাই তোমার পানীয় বর্জন সংক্রান্ত উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে জানাও, ওরা রেনকোট পরে এসে ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে।”
বাচ্চারা বেশি পাকা। একেবারেই পাত্তা দেয় না। আপনাদের কিনা পক্বকেশ, ঠিকঠাক পরিণতি এসেছে। তাই আপনাদের কাছে ভরসা করে এসব কথা লিখলাম। করোনার ভয়ে নিজের কলম অবরুদ্ধ, তাই বাধ্য হয়ে হযবরল থেকে ঝেড়ে টুকতেই হল।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)
এই সিরিজের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা পড়তে ক্লিক করুম এই লিংকে
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন