করোনাভাইরাসের আক্রমণে কেবলমাত্র মানুষের জীবন, জীবিকা আর স্বাস্থ্যই বিপর্যস্ত নয়, বিপন্ন বহু শতাব্দী ধরে গড়ে তোলা চিকিৎসার মৌল কাঠামোটি। না, রোগীর সংখ্যার চাপে চিকিৎসা পরিষেবার পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার কথা বলছি না। বলছি "ক্লিনিক্যাল মেডিসিন"-এর কথা। চিকিৎসক রোগীর ইতিহাস শুনবেন এবং নিজের হাত, কান ইত্যাদির সাহায্যে রোগীকে পরীক্ষা করে একটি সম্ভাব্য ডায়াগনোসিসে পৌঁছবেন… এই পদ্ধতি বা শিল্পটির নাম "ক্লিনিক্যাল মেডিসিন"। বস্তুত এই পদ্ধতির বয়স আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের চেয়েও বেশি। পৃথিবীতে বিজ্ঞানের বিপ্লব এসেছে আনুমানিক পাঁচশ বছর আগে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সন্তান। রোগীকে পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়ের প্রচেষ্টা কিন্তু চলে আসছে তারও বহু যুগ আগে থেকে। প্রাচীন আয়ুর্বেদাচার্যদের কথা ভাবুন। তাঁরাও নিজেদের জ্ঞানের কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে এভাবেই রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করতেন। বহুদিনের চর্চায় ক্রমশ এই প্রচেষ্টাটি এক শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়, যা প্রত্যেক চিকিৎসককে দীর্ঘ অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারের পরেও এই পদ্ধতির গুরুত্ব অটুট থেকেছে। বস্তুত মানব শরীর সম্বন্ধে নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য যা জানা গেছে, তাকে কাজে লাগিয়ে রোগী দেখার শিল্পটিকে আরও পরিশীলিত করা হয়েছে দিনে দিনে। আমরা যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে, তখনও পাঠক্রমের হাতেকলমে শিক্ষা অংশের মূল লক্ষ্য ছিল ক্লিনিক্যাল মেডিসিনে ছাত্রী-ছাত্রদের দক্ষ করে তোলা। অতি সম্প্রতি মেডিক্যাল ইমেজিং (সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি), বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকিউলার বায়োলজি ইত্যাদির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বিভিন্নরকম যন্ত্র-নির্ভর ডায়াগ্নোস্টিক পরীক্ষার এক বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর ফলে একইরকম শারীরিক লক্ষণযুক্ত বিভিন্ন রোগীর শরীরে বিভিন্ন ধরণের রোগ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা (diagnostic accuracy) কিছুটা বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রে এবং কার ঠিক কোন চিকিৎসা প্রয়োজন তা আরও নিখুঁতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে, যার দরুন চিকিৎসার ফল কিছুটা হলেও ভালো হয়েছে আগের তুলনায়। এই উন্নতির পথচলা অব্যাহত। এসবের ফলে মানব শরীর, রোগি নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে পুরনো ধ্যানধারণা অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কিছুটা টলে গিয়েছে ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের আসন, যা এক বিশেষ ধরণের উন্নতির লক্ষণ হলেও একেবারে কালোহীন ভালো নয়। এই বিষয়ে কয়েক মাস আগে কিছু আলোচনা করেছিলাম।
কোভিড-১৯ এই নড়ে যাওয়া মহান ঐতিহ্যবাহী ইমারৎটির বুকে শক্তিশেল হেনেছে। "কফিনে শেষ পেরেক" বাক্যবন্ধটি ব্যবহার করলাম না, কারণ আমাদের বিশ্বাস ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের জানাজা উঠতে এখনও দেরি আছে এবং যেদিন তার মৃত্যু হবে, সে বড় সুখের সময় নয়। গালে চুমু খাওয়া বা করমর্দনের মৃত্যু হলে ক্ষতি নেই, কারণ হাত জোড় করে নমস্কার করার সংস্কৃতিটিও দিব্য সুন্দর এক বিকল্প, কিন্তু ক্লিনিক্যাল মেডিসিনকে এত সহজে মরতে দিলে ক্ষতি হবে অনেক বেশি। তবে কোভিড-১৯ এবং সোশাল ডিস্ট্যান্সিং-এর আক্রমণ থেকে আমাদের এই প্রিয় শিল্পটিকে বাঁচানো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অবশ্যই।
মানুষকে ছোঁয়া এখন মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক। অচেনা মানুষের ছয় ফুটের মধ্যে যাওয়া বারণ। কারো কোভিড-১৯ হয়েছে বা হয়ে থাকতে পারে জানলে তো তাঁর পাড়াতেই ঢুকবেন না আপনি। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা কীভাবে চলছে বা চলবে? বিশেষত যাঁদের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ, যাঁদের শরীরে কোভিড-১৯-এর লক্ষণ আছে কিন্তু পরীক্ষার ফল জানা যায়নি এখনো অথবা যে নতুন রোগীর সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্য এখনো জানা নেই, তাঁদের চিকিৎসা হবে কীভাবে? চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের বাঁচানোর তাগিদও তো আছে। তাঁরা অসুস্থ হলে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়বে এবং তাঁদের থেকে সংক্রামিত হতে পারেন অন্য রোগীরাও।
সব রোগীকে দেখার সময় সব চিকিৎসকের পক্ষে সর্বক্ষণ পুরো পিপিই (পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) পরে থাকা সম্ভব নয়, কারণ পিপিই মহার্ঘ্য এবং যত বেশি করেই তৈরি করা হোক না কেন, দৈনিক অত পিপিই সরবরাহ করা অসম্ভব। কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে কাজ করার সময় অবশ্যই পিপিই পরতে হয়, কিন্তু সেসব সুরক্ষা সত্ত্বেও সংক্রামিত ব্যক্তির খুব কাছাকাছি অনেকটা সময় কাটালে বা বারবার তাঁকে ছোঁয়াছুঁয়ি করলে, নাক-মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে গেলে সংক্রমণ হতে পারে। সুতরাং এতদিন যেভাবে রোগীদের পরীক্ষা করা হত, বিশেষত হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের যেভাবে বারবার বিশেষভাবে যত্ন নিয়ে দেখা হত, করোনা পরিস্থিতিতে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভালো লাগুক বা না লাগুক, গবেষক এবং আধিকারিকেরা চিকিৎসকদেরও পরামর্শ দিচ্ছেন রোগীদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে। আউটডোর বিভাগে রোগী ও চিকিৎসক কে কোথায় বসবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে এবং সেই জায়গাদুটি বেশ দূরে দূরে। রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি আত্মীয়ের হাসপাতালে ঢোকা বারণ। চিকিৎসকদের বলা হচ্ছে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এক-একটি ওপিডি কনসাল্টেশন শেষ করতে, রোগী ঘরে ঢোকা থেকে তাঁর বাইরে বেরোনো অব্দি কোনোভাবেই যেন পনেরো মিনিট পার না হয়।
ব্রিটেনের মতো যেসব দেশ কিছুটা রক্ষণশীল এবং স্বাস্থ্যসেবা যেখানে বাণিজ্যিক নয়, বরং সরকারের অধীন, সেসব জায়গায় ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের কদর কিছুটা বেশিই ছিল এবং বাণিজ্যিক স্বার্থে অকারণে একগাদা ডায়াগ্নোস্টিক টেস্ট করানোর সম্ভাবনা প্রায় নেই। সেসব দেশেও এসব যন্ত্র-নির্ভর পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়ছিল বেশ কিছুদিন ধরে বৈজ্ঞানিক কারণেই, তবু ক্লিনিক্যাল মেডিসিন স্বীয় মর্যাদায় আসীন ছিল। সেরকম দেশেও চিকিৎসকদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওয়ার্ড রাউন্ডের সময় খুব প্রয়োজন না হলে রোগী ও তাঁর বিছানা না ছুঁতে। স্টেথোস্কোপের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে পালস অক্সিমিটার, সিটি স্ক্যান ও বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষার ভিত্তিতেই চিকিৎসা বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। স্পষ্টতই বেশ খানিকটা পিছনে চলে গেল ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের গুরুত্ব।
এভাবেই কোভিড পরিস্থিতিতে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এক নতুন ব্যবস্থা, যা অনেক বেশি যন্ত্র-নির্ভর। নানারকম টেস্টের গুরুত্ব আরও বাড়ছে। এর ফলে চিকিৎসার খরচ আরও বাড়ল। স্বভাবতই বিভিন্ন টেস্টের যন্ত্র এবং রাসায়নিক প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো এর বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে আগ্রহী হবে এবং তাদের লবির চাপে আইনে আরও কিছু পরিবর্তন আসবে এবং চিকিৎসকদের ওপর চাপ বাড়বে আরও বেশি করে এই পরীক্ষাগুলো ব্যবহার করার জন্য। ভবিষ্যতে হয়ত বিভিন্ন পরীক্ষা না করিয়ে ওষুধ দেওয়াই বেআইনি হয়ে যাবে (যা ইতোমধ্যে অনেকটা হয়ে গেছে) এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার ভিত্তিতে রোগ সম্বন্ধে চিকিৎসকের ধারণাকে আর বৈধ বলে মানাই হবে না।
সমস্যা হল এর ফলে চিকিৎসা এতটাই মহার্ঘ্য হবে যে তা গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। অথচ সেইসব সাধারণ মানুষের জন্য ভাবার দায় চিকিৎসকেরা এড়াতে পারেন না। যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা যতদিন না একেবারে সস্তা হচ্ছে এবং সর্বত্র সমানভাবে পাওয়া যাচ্ছে ততদিন এঁদের সকলের কাছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকু পৌঁছে দেবার স্বার্থে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন নামক পুরনো হয়ে যাওয়া আধা-বৈজ্ঞানিক আর্টটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের। এদিকে বদলে যাচ্ছে ক্লিনিকের সংজ্ঞা ও পরিবেশ। নতুন পরিস্থিতিতে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুনতর পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে, যার দ্বারা কিছুটা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও যথাসম্ভব ভালো করে রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়। সেই চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। হয়ত এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে আবার নতুন জীবন খুঁজে পাবে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)