Advertisment

কোভিডকে হারাচ্ছেন বেসরকারি স্কুলের নাচের দিদিমণি

লক্ষ্য একটাই, বেঁচে থাকতে হবে। লক্ষ্য একটাই, ফিরতে হবে আগের সেই দিনগুলোতে। যেদিন দিদিমণির শেখানো নাচের অনুষ্ঠানে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে বাবা-মা-দের ভিড়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Online Teaching

গোটা অনলাইন প্রক্রিয়াটাই একটা বাজার চালু রাখার চেষ্টা, সে তথ্য-প্রযুক্তিতেই হোক, কিংবা শিক্ষায়

কোভিড-১৯ ভাইরাসের দাপটে মানুষজন দিশেহারা। এর মধ্যেই বিশেষভাবে আসছে শিক্ষার কথা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামান্য কিছুটা পড়াশোনা হচ্ছে শহরাঞ্চলে এবং মধ্যবিত্তের ঘরে। আর অন্যদিকে দিশাহারা দেশের বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, যার সংখ্যা স্কুল কলেজ মিলিয়ে চল্লিশ কোটি হলেও অবাক হবেন না। অর্থাৎ অন্তর্জালে পড়াশোনাও যেমন নামমাত্র, তা দিয়ে পৌঁছনোও যাচ্ছে খুব সামান্য কিছু পড়ুয়ার কাছে। সে সংখ্যা চল্লিশ কোটির মধ্যে দশ কোটি হওয়াও খুব শক্ত। অর্থাৎ একদম সহজ অঙ্কে বুঝতে পারবেন যে তিরিশ কোটি ছাত্রছাত্রী গত চারমাস ধরে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে না। এর সমাধানের পথ অবশ্যই দুটো। এক অন্তর্জালের পরিষেবা দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া আর দুই, প্রচুর ছাপানো বই, এবং পড়াশোনার সামগ্রী, অর্থাৎ খাতা, কলম ইত্যাদি নিম্নবিত্তের দরজায় রেখে আসা। তবে বাস্তব তো বুঝতে হবে। দেশ জুড়ে অনেক হইচই-এর পর কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার বিনামূল্যে রেশনের কথা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যেই সেই খাদ্যশস্য মানুষের কাছে কতটা পৌঁছচ্ছে তা নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক তরজা। ফলে এই বাজারে কেউ যে আর খাতা-বই-পেন্সিল নিয়ে ভাববে না তা বলাই বাহুল্য। শিক্ষা ঠিক কোন পথে এগোবে সেই বিষয়টাই এখন পেছনের সারিতে, সংবাদমাধ্যমেও তা জায়গা পাচ্ছে কম। শুধু বোর্ডের পরীক্ষায় নম্বর দেওয়া নিয়ে কিছুটা হইচই চলছে। সেটা অবশ্যই একটা সমস্যা, কিন্তু হিমশৈলের চূড়া মাত্র।

Advertisment

এবার একেবারে আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন শহর এবং শহরতলির পরিস্থিতিতে আসা যাক। দিনরাতের বালাই নেই, যখন তখন অনলাইন ক্লাস। এমনিতেই বাড়ি থেকে অফিস করছেন বহু মধ্যবিত্ত। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পড়াশোনা। স্মার্টফোনের বিক্রি বেড়েছে। আম্ফানের পর কিছুদিন ইন্টারনেট নিয়ে যে গোলমাল তা মিটেছে আপাতত। কিন্তু প্রযুক্তির নিয়ম মেনেই সবসময় যে মোবাইল ফোনের সংযোগ খুব ভালো মানের থাকবে এমনটা নয়। তাই ছাত্রছাত্রীদের পোয়াবারো। পড়তে ইচ্ছা না করলেই কোন একটা ছুতোয় ইন্টারনেট কাজ করছে না বলে দিলেই হল। মজার কথা, যে ইন্টারনেট চলছে না, তাই দিয়েই কিন্তু পড়ুয়ার হ্যোয়াটসঅ্যাপ চলে যাচ্ছে দিদিমণির কাছে। “কানেকশন কাজ করছে না ম্যাম”, গোছের কথা লেখা হচ্ছে বারবার। সেখানেও যুক্তি আছে। ছবি কিংবা শব্দ যেতে অন্তর্জালের জোর লাগে বেশি, তুলনায় টিমটিমে যোগাযোগ থাকলেই চলে যায় অক্ষররাশি। ফলে ছাত্রছাত্রী দুষ্টুমি করলে শিক্ষক-শিক্ষিকার তা সামলানোর উপায় নেই। বরং মাস্টারমশাই ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎ অন্তর্জাল গোলমাল করলে তাঁর হাঁ-মুখ সেঁটে থাকছে স্ক্রিনের ওপর। ছাত্র লিখছে, “স্যার, আপনি আবার ছবি হয়ে গেছেন”।

এই স্যার-ম্যামদের কথা একবার ভেবেছেন কি? সরকারি স্কুল হলে তো মুশকিল বিশেষ নেই। মাসের শেষে মাইনে আসছে এখনও। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে অন্যান্য চাকরির মতই সাংঘাতিক খারাপ অবস্থা। বছর ঘুরলে মাইনে বাড়ায় বেসরকারি স্কুল, তাই নিয়ে চলছে প্রচুর গোলমাল। আবার অভিভাবকরা বলছেন যে কম্পিউটার বা ল্যাবোরেটরির জন্যে টাকা দেবো কেন? ক্লাস তো হচ্ছেই না। এই জাঁতাকলে বেসরকারি স্কুলের মালিকও পড়ছেন। মাস ঘুরলে মুনাফা ছিল প্রচুর। সেটা কমে যাওয়ায় তিনিও বিপাকে। ফলে কোপ পড়ছে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর। তাদের মাইনে কমা থেকে চাকরি যাওয়া সবটাই ভবিতব্য, কারণ গোটাটাই সমাজের অংশ। কিন্তু তার আগে ভীষণ এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে তাঁদের। শারীরশিক্ষার শিক্ষক মোবাইল ফোন কাত করে রেখে পিটি করছেন নিজের ঘরের কোণে। তাই দেখে নাকি হাত-পা ছুঁড়বে কম্পিউটার বা মুঠোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা। শুধু তাতেই হবে না। শিক্ষককে প্রমাণ দিতে হবে যে ছেলেমেয়েরা ক্লাস করেছে। সেই সব ছবির স্ক্রিনশট নিয়ে পাঠাতে হবে স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের কাছে। হাতের কাজের দিদিমণি একগাদা পেনসিল স্কেচ স্ক্যান করে পাঠিয়েছেন বাচ্ছা বাচ্ছা ছেলেমেয়েদের। তারা আবার সেই ছবি দেখে রঙ দেবে। এই গোটা প্রক্রিয়ায় ঠিক কোন জায়গায় যে তোতা পাখির পেটে কতটা কাগজ খসখস করছে তার পরিমাপ অনুমান করা কঠিন।

সোজা কথায় বেসরকারি স্কুলের যে অনলাইন ক্লাস, তাতে পড়াশোনার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি বাঁচানো। গোটা অনলাইন প্রক্রিয়াটাই একটা বাজার চালু রাখার চেষ্টা, সে তথ্য-প্রযুক্তিতেই হোক, কিংবা শিক্ষায়। এমনটাই চলবে এখন বেশ কিছুদিন। সমস্যা এতো জটিল যে সমাধানের একটা পথ বাতলালে অন্যদিকের ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে যাবে। বেসরকারি ইস্কুলকে ছোট বা মাঝারি শিল্পের মতই মাঝের সারির পরিষেবা ক্ষেত্র হিসেবে ধরতে হবে, যা মুনাফাভিত্তিক বাজারে কিছুটা হলেও সম্পদ জোটায়। তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রক্রিয়া জারি আছে। পুঁজিবাদের প্রেক্ষিতে তাই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সদ্য কাজ হারানো স্বামী গালে হাত রেখে জানলা দিয়ে গলিপথ দেখছেন। দিদিমণি মুঠোফোনটাকে ফুলদানিতে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে নাচ শেখাচ্ছেন অদৃশ্য সূচীছিদ্র ক্যামেরার সামনে। পাটভাঙা শাড়ি একদিকে, অন্যদিকে আরও কত মোবাইলের সামনে ইস্কুলের পোশাক পরা একঝাঁক কিশোরী। একটু দূরে খাটের পাশে খেলনা নিয়ে মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ছোট্ট শিশু।

সেই নাচ, সেই গান, সেই সব ছোট ছোট টুকরো ছবি একসঙ্গে ভিড় করে ছড়িয়ে পড়ছে বৈদ্যুতিন কণার হাত ধরে। লক্ষ্য একটাই, বেঁচে থাকতে হবে। লক্ষ্য একটাই, ফিরতে হবে আগের সেই দিনগুলোতে। যেদিন দিদিমণির শেখানো নাচের অনুষ্ঠানে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে বাবা-মা-দের ভিড়। অফিস ছুটি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মী ছোট্ট শিশুকে পাশে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছেন সেখানে। কিশোরীদের ঝাঁকের মধ্যে হঠাৎ করে মঞ্চে এসে একধার থেকে অন্য ধারে ভেসে গেলেন দিদিমণি, ছোটদের মতই নাচের তালে ছিটকে যাচ্ছে তাঁর বেণী। অন্ধকার আসন থেকে শিশু হইচই করে উঠছে, “ঐ তো আমার মা।” বাবা বলছে, “ওরে চেঁচাস না, চুপ কর”। অনুষ্ঠান শেষে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফেরা, নাচের দিদিমণি, প্রযুক্তিবিদ কর্তা, আর ছোট্ট এক শিশু। সে দিন তো ফিরতেই হবে। তাই এই লেখাতেও ফিরছে ইতালিয়ান আর ইংরিজি মিশিয়ে গাওয়া একটি অতিপরিচিত গান “আন্দ্রা তুতো বেনে, এভরিথিং উইল বি অলরাইট” এর ভাবানুবাদ।

“নগরে নির্জনতা এমন, দেখি নই তো কোনদিন
হারালো কোথায় আমার শহর, ছিল যা আপসহীন
স্বপ্ন ছিল যত মোদের হারাল নালার নীচে,
জীবন যে থমকে
তবু স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? সব হয়ে যাবে ঠিক
— সত্যি বলছি।
একসাথে দেখো বাঁচছি আমরা সবাই
মুদির দোকানে চাল-ডাল আর শুকনো কিছুটা মুড়ি
নিস্তব্ধতা চেঁচিয়ে উঠছে, সুতো ছেঁড়া কাটা ঘুড়ি।
স্বপ্ন বেচো না বন্ধু,
আলো নিভিও না বন্ধু,
একসাথে মোরা পার হব এই অন্ধকারের দিন।
দু-তিনটে আর মাস
বলছে তো ওরা খবরে,
কটা দিন আর ঘরে থাকো তুমি তারপর বেলা মুক্তি।
আগামীর দিনে ফিরে দেখব পিছিয়ে কঠিন এই সময়
দূরত্ব দিয়ে ভালোবাসা কেনা, আমরা করব জয়।
ডাক্তারবাবু নার্সদিদি
লড়ছ যারা সবাই,
পড়াশোনা ফেলে রাস্তায় নামা,
সবজি বেচা ভাই,
ভালোবাসা তাই রইল
সব দেওয়ালে তোমার নাম।
আমাদেরই ভাইবোন
তাই তোমাদেরই পাশে আমরা,
দায় নাও ভালোবাসা বাঁচানোর
তোমার দৃঢ় সাহসী শপথে;
তোমার শক্ত চোয়াল জ্বালবে যে আলো আগামী দিনের পথে।
সব অসুখটুকু সেরে যাবে যবে, পুরোটাই ফিকে স্মৃতি
যারা চলে গেল রেখে ফুল মালা আর শুকনো ডাঁটির বৃতি,
মাত্র কটা মাস
নোঙ্গর ধরেছ তুমি
দূরত্ব রেখে লড়ছি আমরা মন থেকে হাতে হাত।
আগামীর দিনে ফিরে দেখব পিছিয়ে কঠিন এই সময়
দূরত্ব দিয়ে ভালোবাসা কেনা, আমরা করব জয়।”

নাচের দিদিমণি হারছেন না, কোভিডকে হারাচ্ছেন। তাঁর অর্ধেক হয়ে যাওয়া মাইনের টাকাতেই এখন সংসার চলছে। স্বামীর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স যতটুকু বাঁচিয়ে রাখা যায়, যেখান থেকে শোধ হবে গাড়ি কিংবা ছোট্ট বাসার ইএমআই।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Anyo Paksha COVID-19
Advertisment