বহু দিন ধরেই শুনছি, “চিন নিন চিনে”, কিন্তু চিনকে তাও চেনা হল না। তবে সে শুধু ভারতের দোষ নয়। বিশ্বজুড়ে দেশনেতারা চিনকে নিয়ে ভুগছেন। সোভিয়েত ভেঙে পড়ার পর থেকে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ, গোটা দুনিয়ায় রাজত্ব করেছে মার্কিন দেশ। খুব কম দেশ আছে যাদের মার্কিনিদের দাদাগিরি সহ্য করতে হয় নি। ভারতেও তার প্রভাব পড়েছে। পাকিস্তানকে বহু বছর ধরে অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য করে সন্ত্রাসবাদে পরোক্ষ সমর্থন করেছে আমেরিকা। ভারতকে তার ফল ভোগ করতে হয়েছে। সোজা কথায় মার্কিনিদের লম্বা নাক অনেক দেশেই বিভিন্ন গোলমাল পাকিয়েছে।
উদাহরণে শুরুতে ভারতের কথাই ধরা যাক। মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার থেকে বামদের বেরিয়ে আসার একটা বড় কারণ ছিল আন্তর্জাতিক স্তরে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে আমেরিকার কাছে ভারতের আংশিক আত্মসমর্পণ। বামেদের তখন লোকসভায় ষাটের আশেপাশে আসন ছিল। তাদের চাপেই বেশ কিছু জনমুখী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল ইউপিএ সরকার। তবে ভারতের নিম্নবিত্ত খেতে পেল কি না পেল তা ভেবে তো আর বিশ্বের অস্ত্রবাজারে ব্যবসা চলে না। ফলে বামেরা সরকারের সঙ্গে আড়ি করায় দক্ষিণপন্থী ভাবনাচিন্তা অবশ্যই অনেকটা বেশি জায়গা পেল। অর্থাৎ বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দখল যে অন্যান্য দেশে প্রভাব ফেলে তা বলাই বাহুল্য। ভারতের গণতন্ত্র অনেক পোক্ত। তাই প্রভাবটা হয়ত কম। কিন্তু উগ্রবাদী ইসলামের সঙ্গে দর কষাকষি করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটা বড় অংশকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে আমেরিকা। প্রাচীন সংস্কৃতি এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারী এই দেশগুলো এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ।
সংক্রমণ না কমলেও অবশেষে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হয়েছে
তবে মার্কিনিদের দাদাগিরির মাঝেই কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ঘুঁটি সাজিয়েছে চিন। দেশটি নামেই কম্যুনিস্ট। আসলে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর প্রচুর বিধিনিষেধ। প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করার অধিকার নেই বললেই চলে। অন্তর্জালেও বিভিন্ন বাঁধন। মুখে বামপন্থী ব্যবস্থার কথা বলা হলেও সে দেশের অন্দরে উদারনীতির চিহ্নমাত্র নেই। তবে শুধু নিজের দেশ কেন? তাদের দখলদারিতে থাকা হংকং কিংবা তাইওয়ানেও তাদের আগ্রাসন ভয়ঙ্কর। চিন অবশ্য এই ভূখণ্ডগুলোকে নিজের দেশ বলেই মনে করে।
তবে এতেই তারা ক্ষান্ত নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে তাদের নজর বহুদিনের। বারো বছরের বেশি হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতা বন্দর বানানোর কাজ করছে তারা। বলতে গেলে অঞ্চলটা এখন চিনেরই দখলে। পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সম্পর্কও বেশ মধুর। মনে রাখতে হবে এই বিষয়টিকে আমেরিকা উৎসাহ দিয়ে এসেছে বহু বছর ধরে। এখন চিনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় ট্রাম্প সাহেব হয়ত অনেক কথা শোনাচ্ছেন। কিন্তু ভারত সরকার বারবার আপত্তি করা সত্ত্বেও চিন এবং আমেরিকা থেকে একযোগে সাহায্য পেয়ে এসেছে সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান। সেখানে আবার এখন গণতন্ত্র নড়বড় করছে, সেনাবাহিনী আর কদিন ইমরান খানকে টিকতে দেবে সেটাই বোঝা দায়। তবে জম্মু-কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের দৈনিক সন্ত্রাসবাদের রুটিন বজায় আছে। আজও খবর আছে গোলাগুলি এবং মৃত্যুর। এই পাকিস্তানের সঙ্গে রাস্তাঘাট বানিয়েই ক্ষান্ত হয় নি চিন। তাদের স্বপ্নের পরিকল্পনা ওবর (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড)। শি জিনপিং এর বিদেশনীতির মধ্যে অন্যতম এই দুনিয়াজোড়া রাস্তা। সত্তরটি দেশে ব্যবসা বাণিজ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর জন্যে চিনের এই প্রস্তাব। এর মধ্যে শুধু এশিয়া নয়, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করার ভাবনাও আছে। স্বভাবতই ভারত এর বিরুদ্ধে, কারণ এই ধরণের দখলদারিত্বে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত লাগার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
কোভিড সংক্রমণের জন্যে চিনের ওপর বিরক্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকা। বিষয়টা যে চিন ইচ্ছা করে বাঁধিয়েছে এমন অকাট্য প্রমাণ অবশ্য মেলেনি। তবে কোভিড পরিস্থিতিতে যখন বিভিন্ন কোম্পানির অবস্থা কেরোসিন, তখন অন্যান্য দেশের সে সব সংস্থা কম পয়সায় কেনার সুযোগ নিচ্ছে চিন। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে চিনের প্রভাব এখন অনস্বীকার্য। সেই জায়গা থেকেই এটা মনে হচ্ছে যে প্রথম বিশ্বের দেশগুলির বিরক্তিকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না মাওয়ের দেশ। আর আগ্রাসী কোন শক্তি যে তার আশেপাশের দেশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করবেই। নেহেরুর সময় থেকেই চিন ভারতীয় ভূখণ্ড খাবলা মারার চেষ্টা করছে। তাদের রোখার ক্ষেত্রে এত বছর কেন্দ্রে রাজত্ব করা কংগ্রেসের ভূমিকাও খুব দৃঢ় নয়। বর্তমান বিজেপি সরকার অনেক বেশি হম্বিতম্বি করলেও সত্যি যে চিনকে কতটা সামলাতে পারছে তা বোঝা মুশকিল। এই নিয়ে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বিজেপির যুক্তি-তর্ক-গল্প অব্যাহত। তবে দেশের সীমানা রক্ষায় তো আর লোক দেখানো রাজনৈতিক তরজা কাজ করবে না। সেখানে চিনকে কড়া হাতে সামলানোটাই একমাত্র পথ। মুশকিল হল সকলেই জানেন যে চিনের সামরিক শক্তি অত্যন্ত বেশি, এবং তাদের দেশনেতা এবং সেনাবাহিনী অত্যন্ত আগ্রাসী। ফলে ভারত সরকার যে একসঙ্গে গাজর আর লাঠি দুই দিয়েই বিষয়টি সামলানোর চেষ্টা করবে তা বলাই বাহুল্য।
ভারত কি খুঁজে পেয়েছে তার ‘জর্জ ফ্লয়েড মুহূর্ত’?
বর্তমানে এই অঞ্চলে চিনের আগ্রাসনের আর একটা বড় প্রমাণ নেপালের বাড়াবাড়ি। গত বেশ কয়েকবছর ধরেই নেপালের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখছে চিন। বর্তমানে ভারত নির্মাণ করেছে তাওয়াঘাট-লিপুলেখ আশি কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক। চিনের অবশ্যই টনক নড়েছে এতে। তাই নেপালকে উসকে দিয়েছে তারা। নেপালের নিম্নকক্ষে সব রাজনৈতিক দল মিলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হয়েছে নতুন মানচিত্র। তাতে ভারতীয় এলাকা লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি আর লিপুলেখকে নেপালের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই ভারত প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু নেপাল যে সে কথা শুনবে তার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
কাকতালীয় কিনা জানা নেই, কিন্তু বিহার নেপাল সীমান্তে নেপাল পুলিশের গুলিতে ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুর বিষয়টিও যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। মনে রাখতে হবে যে চিনের তথাকথিত কম্যুনিজম আদতে তাদের দেশনেতাদের ভাবধারা নয়, তা মূলত সামরিক জাতীয়তাবাদী। তিব্বতকে যেভাবে চিন দখল করেছে তাতে এই বিষয়টি বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে ভারতের শাসক বিজেপিও দক্ষিণপন্থী এবং তীব্র জাতীয়তাবাদী। ফলে যুক্তি দিয়ে এই দ্বন্দ্ব মেটার সুযোগ কম। বাজপেয়ী সরকারের সময় তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে চিন ভারতের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। মনমোহন সিং আমেরিকার দিকে ঢলে পড়ে চিনের ওপর চাপ রেখেছিলেন। এখন দেখা যাক পাকিস্তানকে চরম শত্রু বলে চালানো বিজেপি চিন্তনদল চিন সম্পর্কে ঠিক কি বলে।
আর উপসংহার সবার জানা। পড়শি দুই দেশে দ্বন্দ্ব চললে দু জায়গারই নিম্নবিত্ত মানুষদের প্রচুর আত্মত্যাগ করতে হয়। চিনের খবর বিশেষ পাওয়া যায় না, তবে সেখানে “মানবাধিকার” বলে কোন শব্দের অস্তিত্ব নেই বলেই মনে করেন বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা। তুলনায় ভালো হলেও, ভারতও গণতন্ত্রের সূচকে নামছে। আমাদের দেশের অর্থনীতি গত আর্থিক বছরের শেষ ত্রৈমাসিকে এমনিতেই কোঁকাচ্ছিল, এখন তার ওপর কোভিড। আশি কোটি নিম্নবিত্তের জন্যে বিশেষ ত্রাণের ব্যবস্থা হয়েছে বলে কোন খবর নেই। এখন একটাই সুবিধে। চিন ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। ফলে তাদের রুখতে গিয়ে ভারতের আমজনতাকে কৃচ্ছ্রসাধন করতেই হবে।
বলিহারি চিনকেও। বিশ্বজুড়ে এমন এক ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির জন্যে তারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। কিন্তু তাতেও আগ্রাসনের কমতি নেই। জনগণতন্ত্রী চিন এখন বিশ্বজুড়ে বেসরকারি সংস্থার শেয়ার কেনে আর নিজেদের প্রায় এক কোটি বর্গকিলোমিটার ক্ষেত্রফলে সন্তুষ্ট না হয়ে ভারতের মধ্যে আরও আট কিলোমিটার ঢোকার চেষ্টা করে। একেই তো বলে কোভিড সংক্রমিত সভ্যতা।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)