লক ডাউনের চার সপ্তাহ পেরোলো। COVID-19 এর মোকাবিলায় বাধ্য হয়ে এই লক-ডাউনের পথ নিতে হয়েছে অন্যান্য বেশ কিছু দেশের মতোই আমাদের দেশকেও। মহামারীর ঝুঁকি এড়াতে মেনে নিতে হয়েছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি। সেই ঝুঁকিও নেহাৎ সামান্য নয়। নির্দিষ্ট কিছু সূত্র মেনে কিছুটা দীর্ঘ হয়েছে এই লক-ডাউন, কিন্তু অতি দীর্ঘ সময় ধরে এমন সার্বিক লক-ডাউন বজায় রাখা সম্ভব নয়। শিল্প, বাণিজ্য, যাতায়াত বহুদিন বন্ধ থাকলে ভাইরাসের যথেচ্ছ বিহার প্রতিহত হবে এবং পরিবেশ রক্ষা পাবে দূষণের হাত থেকে, এসব কথা সত্যি, কিন্তু অনুৎপাদক সময়কাল যত দীর্ঘ হবে, ততই বাড়বে অর্থনৈতিক সংকট। বিভিন্ন আবশ্যক পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে, কমবে মানুষের হাতে অর্থের জোগান।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সুপ্রাচীন অতীতে যেসব সুবিধা, পরিষেবা ও পণ্য ছাড়াও আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম (সেগুলো তখন ছিলই না বলে), সেসব ছাড়া আজ আমাদের চলে না। অন্তত দীর্ঘদিন সেই সবকিছু বাদ দিয়ে এই আধুনিক সমাজে মানবজীবনের গতি অব্যাহত রাখা দুষ্কর। ভারতীয় অর্থনীতি এখনও মূলত কৃষিভিত্তিক বলে আমাদের দেশ (মূলত গ্রামীণ ভারত) হয়ত এই ধাক্কায় কিছুটা কম আহত হবে ইউরোপ আমেরিকার তুলনায়, তবু ক্ষতি তো হবেই। এমনকি কৃষিও সংকটাপন্ন হতে পারে সহায়ক শিল্প ও পরিষেবাগুলো বিপর্যস্ত হলে।
অতএব লক-ডাউনের মেয়াদ হয়ত খুব বেশিদিন বাড়াতে পারবে না সরকার। এপ্রিলের কুড়ি তারিখের পর থেকেই একটু ঢিলে হবার কথা বাঁধুনি। মে মাসের তিন তারিখের পর থেকে সম্ভবত ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হবে লক ডাউন। তারপর একটু একটু করে কাজে ফিরতে হবে সবাইকে, সচল রাখতে হবে দেশের অর্থনীতিকে।
করোনা অতিমারী: লক ডাউনের উদ্দেশ্য, প্রাপ্তি এবং উত্তরণের পথ
অথচ লক ডাউন উঠে গেলেই করোনাভাইরাস ট্রেনের টিকিট কেটে কৈলাসে গিয়ে সন্ন্যাস নেবে, এমন সম্ভাবনা নেই। বাস্তবে হবে ঠিক বিপরীত। বেশি মানুষ রাস্তায় বেরোলে, কাজে গেলে তার পোয়া বারো। অনেক মানুষ যত পরস্পরের কাছাকাছি আসবে শারীরিকভাবে, ততই সংক্রমণ নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। তখনই শুরু হবে আমাদের আরও কঠিন এক পরীক্ষা। কীভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর মহামারীকে একসঙ্গে এড়াতে পারি আমরা, তার লড়াই শুরু হবে মে মাসে।
এই পরীক্ষা মূলত সচেতনতা, বিচক্ষণতা আর দায়িত্ববোধের। পরীক্ষার্থী রাষ্ট্র এবং নাগরিক উভয়েই। এখন পর্যন্ত সেইসব ক্ষেত্রে আমাদের যা পারফরম্যান্স, তাতে পরবর্তী ধাপের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে কিছুটা চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। প্রথমে রাষ্ট্রের কথা বলা যাক। লক ডাউন ঘোষণা করতে ভারত রাষ্ট্র দেরি করেনি। COVID-19 আন্তর্জাতিক মহামারীর বাস্তবতা বোঝার পর সঠিক সময়েই লক ডাউন করেছে। তবে মহামারীটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে দেরি করেছে সরকার।
তেরোই মার্চের ঘোষণাতেও দেখা গেছে সরকার একে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মনে করছে না, অথচ তার কয়েক দিনের মধ্যেই জনতা কার্ফু এবং তারপর লক ডাউন ঘোষণা করতে হল। প্রাথমিক ঢিলেমির জেরে আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করতে দেরি হল এবং ভাইরাসটি ভালো পরিমাণে ভারতে আমদানি হবার পথ উন্মুক্ত রইল। সভা-সমাবেশ বা তিরুমালা থেকে নিজামুদ্দিনে ধর্মস্থানের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতেও দেরি হয়েছে। প্রথমেই নির্দিষ্ট কিছু সম্ভাব্য হটস্পটকে আলাদাভাবে ঘিরে ফেলে বড় সমস্যা এড়ানো যেত, যা করা হয়ে ওঠেনি। আন্তঃরাজ্য পরিবহনও প্রথমে নিয়ন্ত্রণ না করায় সব রাজ্যে ভাইরাস ছড়াতে পেরেছে সহজেই। দরিদ্র সাধারণ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যও কোনো আগাম সুবন্দোবস্ত করা হয়নি বা পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। এর ফলে তাঁদের ক্লেশ ও আতঙ্কের মধ্যে পড়তে হয়েছে এবং বাঁচার তাগিদে নিজেদের গ্রামে ফেরার চেষ্টা করতে হয়েছে, হয়ত ভাইরাস শরীরে বয়েই।
লক ডাউনের সময়টা কাজে লাগিয়ে তাড়াতাড়ি রোগী ও বাহকদের চিহ্নিত করতে যে প্রচুর পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল, যাতে লক ডাউন উঠে গেলে অচিহ্নিত রোগী ও বাহক খুব বেশি না থাকেন এবং নতুন করে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে। এই কাজটি করার জন্যও আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, কারণ সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিতে দেরি করার ফলে যথেষ্ট সংখ্যক পরীক্ষার কিট তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো এক মাস পিছিয়ে থেকেছে।
‘যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন, তাঁদের জন্য সরকার হাত খুলে খরচ না করলে পথ হারাব আমরা’
ঠিক একই সমস্যা হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট বা বিশেষ পোশাকের ক্ষেত্রেও। পিপিই না পাবার ফলে বহু চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারান্টাইনে যেতে হয়েছে, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের। পরীক্ষার ক্ষেত্রে অপ্রতুল কিট কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার পরিকল্পনা নিয়ে সমস্যায় পরীক্ষার পরিমাণ আরও কমেছে। কিছু রাজ্যে দেখা গেছে যেটুকু পরীক্ষার কিট আছে, তার মধ্যেও অতি সামান্য অংশ ব্যবহৃত হয়েছে, যার ফলে খানিক অন্ধকারে থাকতে হয়েছে সরকার এবং জনগণকে। লক ডাউনের চার সপ্তাহ পার করে এতদিনে আমরা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াবার তোড়জোড় করছি, অর্থাৎ এই সময় আর সুযোগকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলাম না। এর জন্য অনেক মূল্য না দিতে হলেই খুশি হব।
সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ না করলেই নয়। লক ডাউনের সময়কাল কম রাখার জন্য আমাদের কর্তব্য ছিল লক ডাউনের উদ্দেশ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সফল করার জন্য সচেষ্ট হওয়া। তার জন্য আমাদের কর্তব্য ছিল নিজেদের গৃহবন্দী রাখা। জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত নন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যাঁদের বেরোতে হচ্ছে না, তাঁরা স্রেফ ঘরে বসে থেকেই দেশের মানুষকে সাহায্য করতে পারতেন। এই সহজ কাজটা করতেও তীব্র অনীহা দেখা গেল। বাজারের ভিড় প্রতিদিনই চমকে দিল। যাঁরা এমনিতে সপ্তাহে দুবার বাজারে যেতেন, তাঁদের অনেকে রোজ দুবার যাওয়া শুরু করলেন। সেই জটলার সুযোগে কে কাকে ভাইরাস উপহার দিলেন, কেউ জানে না। ছুটির মেজাজে পাড়ায় আড্ডাও কম হল না। টিভি ক্যামেরার সামনে ধরা পড়লে ভুল স্বীকার করে আর না করার শপথ নিয়ে ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন এবং ফুরসৎ পেলে আবার বেরিয়ে পড়ছেন বাবুরা। অথচ লক-ডাউনের জন্য সমস্যায় পড়েছেন যাঁরা, তাঁদের সহায়তা করার জন্য এত উৎসাহী লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
যাঁরা বেশি বুদ্ধিমান, তাঁদের ভুল ধরতে গেলেই তাঁরা গরিব মানুষদের দোহাই দিয়ে কথা ঘোরাচ্ছেন, কিন্তু সত্যি হল মাছ আর মিষ্টির দোকানের সামনে যাঁরা ভিড় জমাচ্ছেন, তাঁরা "দিন আনি দিন খাই" মানুষ নন। প্রকৃত দরিদ্র যাঁরা, তাঁরা জানেন যে এই লক ডাউন দীর্ঘ হলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ভুগবেন এবং বহু ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক বেশি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিচ্ছেন। অবশ্য দরিদ্র মেহনতি মানুষের দায়িত্বশীলতার উপর ভর করেই চিরকাল আমাদের দেশ আর অর্থনীতি চলতে থাকে, কিন্তু সে এক অন্য আলোচনা।
জাতি হিসেবে নিয়মানুবর্তিতার প্রতি আমাদের মজ্জাগত বিরাগ আমরা প্রকাশ করলাম এই দুঃসময়েও। নিজের ভালোর জন্য সামান্য কিছু নিয়ম মানাতেও আমাদের পিছনে ডাণ্ডা হাতে পুলিশকে দৌড়তে হয়। যতদিন তাঁরা গান-টান গেয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ততদিন আমরা বিশেষ পাত্তা দিইনি। লক ডাউনের মেয়াদ ফুরোলে যখন বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হবে, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর অনুশাসনের ভরসাতেই দেশকে বাঁচতে হবে, তখন সেই পরীক্ষায় এই দায়িত্ববোধ নিয়ে আমরা উত্তীর্ণ হতে পারব তো? নাকি আমাদের স্বাস্থ্যের দায়িত্বও পুলিশের হাতেই থাকবে?
ভেবে দেখুন, এইভাবে নিজেদের অজান্তেই আমরা রাষ্ট্রকে ব্যক্তিজীবনে আরও বেশি করে ডেকে নিচ্ছি, আমাদের জোর করে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছি রাষ্ট্রের হাতে এবং বাড়াচ্ছি তার ক্ষমতা, বৈধতা দিচ্ছি সম্ভাব্য "পোলিস স্টেট"কে। এরপর যদি এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হয়, তবে তার জন্য অংশত আমরাও দায়ী থাকব, যেমন থাকব মহামারী হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার জন্যেও। সুনাগরিক হবার চেষ্টা করলে আমাদের স্বাস্থ্য আর স্বাধীনতা, দুটোই আরও ভালো করে রক্ষা করতে পারতাম।
(লেখক আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন