Advertisment

ধর্মসংকট - একটি অনলাইন বৈঠকের বিবরণ

"আসলে জনগণকে নিয়ে তো বিশেষ অসুবিধে নেই। কিন্তু এ জগৎ যারা চালাচ্ছে তাদের সে ব্যাটাগুলো আমাদের এমনভাবে বেচে দেয় যে জনগণ গুলিয়ে গণেশ।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
lockdown 5.0 places of worship

অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

বিধাতার পুরো ধর্মসংকট। শপিং মলের সঙ্গে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, ইত্যাদি খুলতে চলেছে। শপিং মলে মানুষ না এলে তাও বিপদ কম, অর্থনীতি চটকে গেছে বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ধর্মস্থান খোলার পরেও যদি লোকজন না যায়, সেক্ষেত্রে শিব, দুর্গা, আল্লা, যিশু অবশ্যই অস্বস্তিতে পড়বেন। আর জনগণ ছুটলে গাল ফোলানো কাঁটাওলা ভাইরাসের পোয়াবারো।

Advertisment

বিজ্ঞানকে অস্বীকার করার মত বোকা বিধাতা নন। তাই বারোটার কাঁটা পেরিয়ে রবিবার শুরু হওয়ার পর বেশি রাতে ঘুমোতে গিয়েও শুনি মুঠোফোনের পিঁকপিঁক। উঠে দেখি অন্তর্জালে বৈঠকের ঠিকানা। সঙ্গে ছোট্ট বৈদ্যুতিন চিরকুট - “তোর তো কাজ নেই বিশেষ, আর পড়ে পড়ে নাক ডাকছিস সকাল দশটা পর্যন্ত। তাই একটু বেশি রাত অবধি জেগে আলোচনাটা শুনে নে”। পটাং করে লিঙ্ক দিলুম টিপে, একদিকে নিজের সোনামুখ, বাকিগুলো সব তেনাদের। দুর্গা মা ভীষণ চিন্তিত মুখে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছছেন। কারণ পরিষ্কার, শিব এই অতিমারীর বাজারেও গাঁজা খেয়ে চিৎপাত। ফলে ঘরের কাজ তো আছেই, সঙ্গে ছেলেমেয়ের ই-স্কুল কিংবা কলেজ। বাড়িতে তারাও যে খুব কাজ করে এমন নয়।

আরও পড়ুন: উত্তমকুমার অথবা বটুরামদার কাঁচি

যিশুর একমুখ দাড়ি। শুরুতেই ম্লানমুখে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। “এইসব গির্জা টির্জা খোলার জন্যে একেবারেই আমার অনুমতি নেয় নি ওরা। শুনলাম বাংলার একটা মন্দিরে নাকি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হয়েছে। সেটাই তো ভালো ছিল।”

নিরাকার আল্লা ক্লান্ত স্বরে জানালেন, “আমিও তো বারবার মৌলবিগুলোকে বলছি যে ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করতে। কয়েকজন মাত্র শুনেছে। বাকিরা তো খুব গা করছে না।”

মা দুর্গা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন, “কালীর সঙ্গে কথা হয়েছে। রূপ বদলে দুবার দুদিকে দাঁড়িয়ে ডবল রোল করার সময় এখন কম। তবু জানলাম দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড় লোকজনের জন্যে খুব একটা খুলে দেয় নি। রামকৃষ্ণ মিশন কাজ করছে চারদিকে। নরেনকে বলেছি একশো বছর আগে প্লেগের অভিজ্ঞতা সাধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। জগন্নাথের সাথেও বহু কষ্টে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হলো। রথযাত্রায় ঘেঁষাঘেঁষি করে দড়ি টানতে মানা করে দিয়েছে। আসলে জনগণকে নিয়ে তো বিশেষ অসুবিধে নেই। কিন্তু এ জগৎ যারা চালাচ্ছে তাদের সে ব্যাটাগুলো আমাদের এমনভাবে বেচে দেয় যে জনগণ গুলিয়ে গণেশ।

"এই রে দাঁড়ান, একটু ঘুরে আসি। লাইনটা চালু থাকল। আমি শুনছি। গণেশের আবার দুটো বোর্ডের পরীক্ষা বাকি। রাত জেগে পড়ছে। ওকে একটু হেলথ ড্রিঙ্ক গুলে দিই গিয়ে। ওর বাপটা সেই যে সপ্তাহান্তের ঢুকু ঢুকু শুরু করেছে, কোন দায়িত্ববোধ নেই। সোম থেকে শুক্কুর সারাদিন কুটকুট করে ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম, আর শনি-রবি মোচ্ছব। সরকার একেবারে ঠিক করেছিল মদের দোকানগুলো বন্ধ করে। কিন্তু ও হরি, পাড়ার নেতা ধরে ব্ল্যাকে বোতল কিনে ঘরে ঢুকল। কী যে করি, ওঁর দেশে তো এমনটাই ভবিতব্য। যাই হোক হ্যান্ড-স্যানিটাইজার দিয়ে বোতল ঘষিয়ে তবে ঘরে ঢুকিয়েছি। একটু গাঁইগুঁই করছিল। তখন বুঝিয়ে দিলাম, সবই তো অ্যালকোহল।”

দুর্গা থেমে যাওয়ায় কথা বলার সুযোগ পেয়ে যিশু খুশি। “আমাকে একটানা অন্তত দুমিনিট বলতে দিতে হবে। না হলে পুরো বিষয়টা বোঝা যাবে না। এ ব্যাপারে মার্ক্সের সঙ্গেও আমি আলোচনা সেরে নিয়েছি। অর্থনীতির মূল জায়গাটা নেতানেত্রীরা গুলিয়ে দিচ্ছে। ধরা যাক অটোর ভাড়া দশ টাকা। আগে লোক নিত চারটে। গোটা ট্রিপে চল্লিশ। এখন দুজন নিতে গেলে ভাড়া দ্বিগুণ করা ছাড়া গতি নেই। এদিকে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা কম, নেই বললেই চলে। তারা প্রত্যেকে কুড়ি টাকা ভাড়া দিতে চাইছে না। একই কথা গ্রামে ফেরা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। একে তো সংক্রমণের ভয়। তার ওপর তারা আগে অন্য জায়গায় কাজ করে বেশি রোজগার করত, ফলে কিছু মানবিক হিংসার ব্যাপার তো আছেই।

"এর সঙ্গে জুড়ে গেছে এই সব লোক গ্রামে ফেরার পর একশো দিনের কাজে ভাগ বসাবে। অর্থাৎ অল্প যেটুকু পুঁজি সেখানেও মানুষ বাড়ছে। তারা নিজেদের মধ্যে ব্যাপক মারামারি করছে। এই জায়গায় সরকারের টাকা দেওয়া ছাড়া গতি নেই। ট্রাম্পকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম লোক মারফত। ইউরোপেও জনসন, ম্যাক্রঁ, মার্কেলের কাছে খবর গেছে। বিষয়টা কিছুটা ওরা বুঝেছে। সরকারের টাকা ঢালছে বিভিন্ন জায়গায়। উন্নত দেশ তো, ব্যাটারা সামলায় ভালো। আর চুরির ব্যাপারটাও ওসব দেশে অনেকটা কম। তবে ট্রাম্প সব সময় কথা শুনছে এমনটা নয়। আমেরিকায় লোক মরছে প্রচুর। ওষুধ নিয়েও রাজনীতি আছে। এর মধ্যে অন্য গোলমালে পুলিশের হাতে মারা গেছেন একজন নিরীহ মানুষ। প্রচুর আন্দোলন চলছে বিভিন্ন শহরে। এর সঙ্গে মার্কিন দেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে ……”

আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ ও ক্লিনিক্যাল মেডিসিন

আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, এদিকে সঙ্গে আবার মার্কিন দেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি। আমি তাই একেবারে সঞ্চালকের ভূমিকা নিয়ে টুক করে ফোড়ন কাটলাম, “দেশের কথায় আসা যাক। আল্লা স্যার, আপনি কি ভারতবর্ষের আশি কোটি নিম্নবিত্ত মানুষ নিয়ে কিছু বলবেন?”

“এই রে, দেশের কথা? আমি যে মধ্যপ্রাচ্যে মৌলবাদী ধর্মগুরুগুলো ইসলামের নামে কিভাবে যুদ্ধ বাধাচ্ছে তাই নিয়ে পড়ে এসেছিলাম। আর ভারতে তো এখন হিন্দুদের রমরমা। মোদীজি কি আমার কথায় পাত্তা দেবেন? তবে অঙ্ক এখানে সহজ। এক শতাংশ মানুষের হাতে তিয়াত্তর শতাংশ সম্পদ। এতে বেশিরভাগ মানুষ যে খেতে পাবে না সেটুকু অঙ্ক মাদ্রাসার প্রাথমিকেও শেখানো হয়। মৌলবিরা দুহাজার টাকা ভাতা পেলেও সেটা সত্যি, না পেলেও। অর্থনীতির নোবেল জেতা লোকগুলো তো বলেই দিয়েছে, গরিবের কাছে টাকা পাঠাও, আর খাবার। আপাতত এটুকুই চলুক। এর বেশি আমার বলার কিছু নেই। একটাই ভালো লক্ষণ, এক মাসের রোজা গেল, গেল ঈদ। আমজনতা কিন্তু খুব সাবধানেই ধর্মপালন করেছেন। লকডাউনের দুমাসের বেশি সময় ভারতের সাধারণ মানুষ এত কষ্ট সহ্য করে যে সংক্রমণ সামলে রেখেছে, তা অসাধারণ। বিশেষ করে শাসক এবং প্রশাসকদের একগাদা গোলমেলে সিদ্ধান্তের পরেও।”

সাধারণ মানুষ হিসেবে বেশ গর্ববোধ করতে শুরু করে আমিও দুমিনিট সময় চাইব ভাবছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই মা ফিরে এসেছেন। আমার হাঁ মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, “শোন, বাকিটা আমরা যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করে বলব। তুই একটু কাজ করে দে। আজকে দিদিকে বলোতে ফোন করবি। বলবি, এক - রাজ্যে অনেক বেশি করে সাইকেল চলার ব্যবস্থা করতে। এতে যাতায়াতের সব সমস্যার সমাধান হবে না, তবে যেটুকু পারা যায়। দুই, ইস্কুল খোলার এখন কোনও দরকার নেই। মিড-ডে মিলটুকু চালিয়ে গেলেই হলো। পড়াশোনা আবার সামনের বছর দেখা যাবে। সরস্বতী তো বইখাতা তুলেই রেখেছে। বলছে ওর অনুপ্রেরণা ছবি লেখা আর কবিতা আঁকায়।

"সে কথা থাক। এবার তিন নম্বর পয়েন্টে আয়। সরকারি কর্মী যে যেখানে থাকে তাকে তার বাড়ির কাছের অফিসে কাজে লাগাতে বল। আজকাল কম্পিউটারের যুগ। এক দুদিনে এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যায়। একটু পরিকল্পনা জরুরি। তাহলে সেই যাতায়াতের প্রয়োজনটুকু কমবে। বাড়ি থেকে কাজের জন্যে বাড়াতে হবে ইন্টারনেট পরিষেবা। এটুকু কথা বলতেই যা অবস্থা! চার, পুলিশের নিচের তলায় আর সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ঘোর অসন্তোষ। আজকের লড়াইতে সীমান্তের সৈন্যবাহিনীর থেকে এদের কাজের দাম এতটুকু কম নয়। ফালতু চটিয়ে দিলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না।”

এই বলে যিশুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের যৌথ বিবৃতির কী খবর? কটা সই হলো? ওটা অন্য দেশে পাঠানোর আগে হিন্দি খসড়াটা তাড়াতাড়ি বিজেপি আর আরএসএসের চিন্তনদলকে পাঠাতে হবে। সেটায় রাম আর আমি বড় করে সই করব। তাতে যদি কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার গল্পটা ওরা একটু ঠিকঠাক করে লেখে।”

“নেটে তো দিয়ে দিয়েছি দুর্গাদিদি, আর মাত্র একটা সই-ই বাকি। রাম, কৃষ্ণ, কবীর, নানক, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা, মহম্মদ, সব মিলিয়ে তিরিশ কোটি সাতাত্তর লক্ষ তেষট্টি হাজার দুশো পঞ্চান্নটা সই কমপ্লিট। শুধু চৈতন্য বাদ। ফোন করেছিলাম। রেগে কাঁই। বলেছে রাজনীতির যে কারবারিগুলো ধর্ম নিয়ে গোলমাল পাকাচ্ছে তাদের কাছে কোন আবেদনে ও সই করবে না। কারণ তাদের নাকি চৈতন্যটাই নেই। এই সময় যে দেশনেতাদের মাথায় ধর্মস্থান খোলা নিয়ে ভাবনা আসতে পারে এটা শুনেই তাঁর আকাশের দিকে ছড়ানো হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আটকে গেছে। ফলে চাইলেও আঙুল নাড়িয়ে সই করা অসম্ভব। তাই গণআন্দোলনে নামার জন্যে এখন ভাঙা কলসির কানা জোগাড় করছে। খোল করতাল নিয়ে বামেদের মিছিল চাঙ্গা করতে যাবে বলছে। ওকে আপনি যদি একটু সামলে নেন। আমাদেরই হয়েছে যত ধর্মসংকট!”

এইসব ম্যাড়মেড়ে আলোচনা আর কতক্ষণ শোনা যায়? তাই এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রবির সকাল থেকেই ভাবছি দিদিকে বলোতে ফোন করা ঠিক হবে কিনা। আপনারা কী বলছেন? মন্দির, মসজিদ, গুরুদোয়ারা, গির্জা, সিনাগগ এরা তো ইঁট-কাঠ-পাথরে বানানো ধর্মস্থান। তাই ওদের ধর্মসংকটের কথাটা বোধহয় আমাদেরই বলতে হবে। দিদিকে কিংবা দাদাকে।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Anyo Paksha Lockdown COVID-19
Advertisment