Advertisment

পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতীয় শ্রমিক

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর সময় থেকে কৃষক, কারিগর, পশুচারকদের রাষ্ট্রীয় উচ্ছেদে প্রবণতা নেহরুপন্থী অর্থনীতিতে ছুঁয়ে মোদির স্মার্ট সিটি আমল অবদি বেশ কয়েক কোটি উন্নয়ন উদ্বাস্তু তৈরি করেছে, যারা শহুরেদের সেবা দেয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Lockdown Capital

ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টা (ছবি - নরেন্দ্র ভাস্কর)

চার ঘণ্টা সময় দিয়ে, বিকল্প ভাবার সুযোগ না রেখেই দেশজুড়ে লকডাউন চাপল। পুঁজি-রাষ্ট্রবন্ধু ভদ্রবিত্ত দুহাত তুলে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সমর্থন করলেও, যে শ্রমিক কর্মস্থলে মালিকের প্রভূত অপমান সয়ে কাজ চালিয়ে যায়, সে-ই সর্বভারতীয় লকডাউনে সম্পূর্ণ অনাস্থা দেখিয়ে, রোজগার বন্ধ হওয়ার আশংকা মাথায় নিয়েও, শ্রমিককৌমসিদ্ধান্তে দেশের কারখানা কেন্দ্রগুলি থেকে মৈত্র মশাই, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্র প্রধানের আশ্বাস ছুঁড়ে ফেলে দারাপুত্রস্বামী নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের পথে। অসামান্য ক্ষমতায় কেউ ২০০, কেউ ৩০০, কেউ ৫০০ কিমি হয়ত আরও দূরে বাড়ির পানে রওনা হল। যে শ্রমিকের দক্ষতা আর শ্রম-উদ্বৃত্তে মূল্যে তৈরি হয়েছে শহরের প্রত্যেকটি ঘনইঞ্চি, সে হয়ত অভিজ্ঞতায় আগাম আঁচ করেছিল, তার দুর্দশায় পুঁজিবাদীরাষ্ট্রব্যবস্থা পাশে দাঁড়াবে না; কৌমভাবে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া থেকে পরিষ্কার রাষ্ট্র নয়, পুঁজি নয়, মানুষ আজও নির্ভর করে গ্রাম সমাজে।

Advertisment

২৫০ বছর ধরে লুঠেরা খুনি এবং নজরদারি প্রযুক্তির যে কেন্দ্রীভূত রফতানি নির্ভর কারখানা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ইওরোপে, চাষি, কারিগর, পশুপালককে উচ্ছেদ করে শ্রমিকের শ্রম চুষে, হাল আমলের নব্য ন্যানো আর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স<এআই> প্রযুক্তি, আড়াইশ বছরের পুরোনো ব্যবস্থা উচ্ছেদে প্রায় তৈরি। পুঁজিবাদের কাছে সব থেকে ঘেন্নার বিষয় শ্রমিক - সে মাইনে বাড়াতে বলে, ছুটি চায়, লভ্যাংশের অংশীদারি চায়, কাজের পরিবেশের উন্নতি চায়, মালিক, ক্ষমতাকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। কারখানা ব্যবস্থা শুরু থেকেই শ্রম প্রতিস্থাপন প্রযুক্তি বিকাশে পুঁজি আজ এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যেখানে তার লুঠ কাণ্ডের সহায়ক বন্ধু ভদ্রবিত্ত সহ বিপুল সংখ্যক শ্রমিক উদ্বৃত্ত হবে। পুরোনো ব্যবস্থার রাষ্ট্র ভূমি শ্রম নির্ভর পুঁজি আর নতুন ব্যবস্থার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণবিহীন শ্রমিকের দায়বিহীন পুঁজির মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে। মিৎসুবিশি, বোয়িং ইত্যাদি শস্তার এআই প্রযুক্তি নিয়ে তৈরি। হয়ত আর মাত্র দু’দশক। করোনাক্রান্তি হয়ত সেই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। করোনা উত্তর চিন স্থানীয় বাজারে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবস্থাপনা শুরু করেছে। লকডাউনের মাধ্যমে পুরোনো পুঁজির উৎপাদন ব্যবস্থার শৃংখলাকে নব্য পুঁজি ধ্বংস করতে বদ্ধ পরিকর। ভারতে এনডিএ নব্য পুঁজির প্রতিনিধি। ক্ষমতা হারানো কংগ্রেস পুরোনো পুঁজির প্রতিনিধি হিসেবে পিকেটি তত্ত্বে তৈরি করেছিল ন্যায় প্রকল্প। পুরোনো পুঁজি স্পেনে পাল্টা প্রতিরোধ দিচ্ছে জনগণকে মাসিক নির্দিষ্ট আয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে।

ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! – কোভিড দুনিয়ার বাস্তব

পুঁজির পরিবারিক বিরোধে চোনা ফেলে দেয় বিশ্বের প্রথম শ্রমিকদের শহর ত্যাগ। পুঁজির দুপক্ষ এবং রাষ্ট্র, শ্রমিকদের পরিকল্পনা যে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারে নি, পরিষ্কার হয়ে যায় লকডাউন শ্রমিক অব্যবস্থাপনায়। পরিকল্পিত মারির সময়েও পুঁজির শ্রমিক বিরোধী চরিত্র বদলায় না। পুঁজি এবং সামগ্রিক জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার বিশ্বাসঘাতকতা বিস্তৃত হল রাস্তার শ্রমিকদের ওপরে। পদে পদে পুঁজি আর রাষ্ট্রের পরিকল্পনাহীন অসহযোগিতা। পরিবার পরিজন নিয়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে চলা মানুষদের ওপর নতুন করে রাষ্ট্র, পুঁজি ব্যবস্থা পীড়ন চাপিয়ে দিল। ২০০র বেশি শ্রমিক রাস্তাতেই দেহ রাখল। অনেককে আটকে দেওয়া হল বিভিন্ন রাজ্যের সীমান্তে। লকডাউনে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া শ্রমিকেরা প্রশাসনের সাহায্য তো পেলই না, পুলিশি ডান্ডায় সবক শিখিয়ে গায়ে কীটনাশক ছড়িয়ে কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পের মত করে তৈরি করা তথাকথিত কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে প্রায় বিনা খাদ্যে আটকে রাখা হল। দিল্লি, মুম্বই, উত্তর প্রদেশ, ব্যাঙ্গালোর সীমান্ত সব এলাকাতেই একই চিত্র। নেতারা দায় ঝেড়ে ফেলতে উৎসুক। সামগ্রিক পুঁজি ব্যবস্থা শ্রমিক ইস্যু উপেক্ষা করে পরিণত হল শ্রমিক দমনকারী পুলিশি রাষ্ট্রে। দূর দেশে আটকে পড়া ভদ্রবিত্তকে সুরক্ষা দিয়ে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে উদ্যম, তার একফোঁটাও দেখা গেল না শ্রমিক নিয়ে ভাববার। নির্দেশ গেল রাস্তায় আটকে থাকাদের অবিলম্বে কাজে যোগ দেওয়ার। চাপে পড়ে একাউন্টে ৫০০টাকা দেওয়ার সান্ত্বনা পুরস্কারের সঙ্গে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের টিকিটের দামে ৩০ টাকা, খাওয়ায় অতিরিক্ত ২০ টাকা কেটে নেওয়ার সন্ত্রাস চলতে থাকল। এই আবহতেই মাফ করে দেওয়া হল ৬৬ হাজার কোটি টাকার কর্পোরেট ঋণ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর সময় থেকে কৃষক, কারিগর, পশুচারকদের রাষ্ট্রীয় উচ্ছেদে প্রবণতা নেহরুপন্থী অর্থনীতিতে ছুঁয়ে মোদির স্মার্ট সিটি আমল অবদি বেশ কয়েক কোটি উন্নয়ন উদ্বাস্তু তৈরি করেছে, যারা শহুরেদের সেবা দেয়। করোনারপূর্ব সময়ে শহর তাত্ত্বিকদের অঙ্ক ছিল আগামী কয়েক দশকে গ্রামের থেকে বেশি মানুষ বাস করবে শহরে। শ্রম নিরপেক্ষ নব্য পুঁজি, পুরোনো পুঁজির পরিকল্পনা ওলটপালট করে দেয়। পলাশির পরে দক্ষিণ এশিয়ার বিকেন্দ্রিত বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে কেন্দ্রিভূত শাসন ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে বাংলায় ১৭৭০এ ছিয়াত্তরের গণহত্যা এবং একের পর এক মন্বন্তর নামক কয়েক কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। আজ যখন পুরোনো পুঁজি, নতুন পুঁজির লড়াইতে বিশ্ব এক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে অন্য ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তখনও বিশ্বব্যাপী গণহত্যা আর সর্বব্যাপী আতঙ্কের পরিবেশ প্রয়োজন।

অন্য একটা মে দিবস

শিল্পপুঁজির পত্রিকাগুলোতেই বলা হয়েছে অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষ শহর ছেড়েছে; হয়ত আরও অনেক বেশি। ধরে নিচ্ছি স্ত্রীস্বামীসন্তান নিয়ে এর অর্ধেক সংখ্যা গ্রামে ফিরে এসেছে। ২০০/৩০০/৪০০ কিমি হেঁটে পরিবার নিয়ে বাড়ি ফেরা, অপমানে জর্জরিত শ্রমিকদের কিছু অংশও কী গ্রামে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে? এর ফলে কী পাল্টে যেতে পারে গ্রামাঞ্চলের শ্রমের পরিবেশ – গ্রামের কৃষিতে যে যন্ত্রের আধিক্য দেখা দিচ্ছে, তাতে কী ধাক্কা লাগবে? ইতিমধ্যেই হার্ভেস্টার যন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে চাষের মাটি বসিয়ে দেওয়ার। তাদের একাংশ যদি ফিরে না যায়, তাহলে কী ধাক্কা লাগতে পারে শহরের উৎপাদন ব্যবস্থায়? নাকী বিপুল সংখ্যক গ্রামে ফিরে যাওয়া, পথে আটকে থাকা মানুষ, রাষ্ট্র এবং পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করে আবারও ফিরে আসবেন পুঁজির উৎপাদন ব্যবস্থায়?

(বিশ্বেন্দু নন্দ অপ্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান চর্চাকারী, মতামত ব্যক্তিগত)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Lockdown COVID-19
Advertisment