Advertisment

COVID-19: সমষ্টির লড়াই

দরিদ্র, গৃহহীন, পরিযায়ী শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও কর্মহীনদের খাদ্য, বাসস্থান, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী আর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধ মেনে চলার মতো যথেষ্ট স্থান না দিতে পারলে সর্বনাশ হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Migrant Labour

লক ডাউনের মধ্যে গাজিয়াবাদে বাসে উঠে বাড়ি ফিরতে চাইছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা (ছবি- অভিনব সাহা)

অতি ক্ষুদ্রের ভয়ে গুহায় ঢুকে গেছে এই গ্রহের সবচেয়ে প্রতাপশালী প্রজাতি। মানব-দুনিয়া খোলসবন্দী হচ্ছে ত্রস্ত শামুকের মতো। ভারত জুড়ে একুশ দিনের লক ডাউন। এ বড় সুখের সময় নয়। COVID-19 অতিমারী থেকে আমরা প্রতিদিন অনেককিছু শিখছি, যা ছাপ ফেলছে আমাদের জীবনদর্শনে। সেসব শিক্ষা আমরা কাজে লাগাতে পারব, যদি বেঁচে থাকি আরও কয়েক মাস। আপাতত বেঁচে থাকাই গোটা পৃথিবীর প্রথম লক্ষ্য। এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই শিক্ষাগুলো, যা এই ভাইরাসটিকে এবং দুঃসময়কে  হারিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে মানুষকে। সব দেশের, সব শ্রেণির, সব ধরনের মানুষকে বাঁচানোর কথা ভাবতে হবে। এটাও বুঝতে হবে শুধু ভাইরাস আটকালেই প্রাণ বাঁচবে না, সংকটের দিনগুলোতে পেটের ভাতটাও জুটতে হবে… সবার।

Advertisment

লক-ডাউন নিয়ে মতবিরোধ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ভারতে যাঁদের কথা শোনা বা পড়া যাচ্ছে প্রচার মাধ্যমে, তাঁদের বেশিরভাগ মানুষ মনে করছেন লক-ডাউন জরুরি। ভিন্ন মতও পোষণ করছেন। লক-ডাউনের ফলে নিম্নবিত্ত মানুষের অনটন চরমে উঠবে, এই যুক্তিতে বিরোধিতা। এই অপ্রিয় কথাটা চরম সত্যি বলেই তা আরও বেশি অস্বস্তিদায়ক।    লক-ডাউন পদ্ধতি হিসেবে অকার্যকর, একথাও বলছেন অনেকে। এই যুক্তিটি অংশত ঠিক, অংশত ভুল। অনেকে বলছেন ডায়েরিয়া, যক্ষায় আরও বেশি মানুষ মারা যান, তার জন্য তো লক-ডাউন হয় না। কথাটা সত্যি, কিন্তু সেই রোগগুলির চরিত্র আলাদা এবং সেসব রোগ প্রতিরোধের পদ্ধতি আলাদা, যা পরে আলোচনা করা যাবে। কেউ কেউ এই অতিমারীকে আদৌ গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, এটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মামুলি এক রোগ। প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জাতেই প্রচুর লোক মারা যায়, এতেও না হয় যাবে। এত হৈচৈ করে কাজ বন্ধ করার কী আছে? এই ভাবনাটি বিপজ্জনক। ইনফ্লুয়েঞ্জায় মানুষ মারা যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু সেটি একটি নিয়মিত রোগ, তার বিরুদ্ধে টিকা আছে, কিছু ওষুধ আছে, তার মারণ ক্ষমতা অনেকটাই কম এবং অনেকদিন ধরে তুলনায় অল্প হারে গুরুতর অসুস্থ রোগী আসেন বলে হাসপাতালের বর্তমান পরিকাঠামোয় তাঁদের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়।

নগর পুড়িলে… করোনার সময়ে আমরা

মার্কিন বিলিয়নেয়ার শিল্পপতি ব্যবসায়ীরাও লক-ডাউন জাতীয় পদক্ষেপের বিরোধী। তাঁদের যুক্তি অর্থনৈতিক। কোনো লুকোচুরি না করে তাঁরা জানাচ্ছেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্মচারীদের কাজে ফেরত চান। স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, এমনকি কিছু মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও তাঁরা রাজি। কিছু লোক মরবে, বাকিরা বাঁচবে আর তার সঙ্গে বাঁচবে অর্থনীতি (মানে ব্যবসা আর মুনাফা)। গুটিকয়েক বিজ্ঞানী আর গোঁয়ার চিকিৎসকের কথা শুনে দেশের অর্থনীতিকে ডুবতে দেবার মানে হয় না, সেকথা মার্কিন দেশের দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাও বলছেন। বৃদ্ধ পেনশনারদের মনে একধরণের অপরাধবোধ জাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার স্বার্থে নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করতে তাঁদের প্ররোচিত করছেন।

ভারতে যাঁরা মহামারী রোধে কঠোর ব্যবস্থার বিরোধী, তাঁদের অনেকে বামপন্থী বা জনদরদী হলেও একাংশ নানারকম ছোট-বড় ব্যবসা বা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কর্মীরা না আসতে পারায় তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন, কিন্তু এদেশে এখনো ঠোঁটকাটার মতো আর্থিক লাভ-লোকসানের কথা বলা যায় না। তাই ঘুরিয়ে বলতে হয় অর্থনৈতিক মন্দার জন্য দেশের ও দশের সমস্যার কথা আর প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হয় যে রোগটা মামুলি। প্রশ্ন করতে হয়, এত কম সংখ্যক মৃত্যুতেই লক-ডাউনের মতো বড় সিদ্ধান্ত নেবার কী প্রয়োজন ছিল? ক্ষণিকের জন্য ভুলে যেতে হয় যে শুধু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদেরই নয়, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীদেরও অধিকার আছে ভাইরাসের ভয়ে লুকিয়ে থাকার এবং নিরাপদে বাঁচার। তাঁদের নিম্নবিত্ত অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সমস্যা এক জটিল সামাজিক নির্মাণ। তাই এই ধরণের অতিমারীর লগ্নে তাঁদের জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষার দায়ও সমাজের এবং রাষ্ট্রের।

তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না, বরং বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে দেরী হয়েছে। চীনে COVID-19 এর তাণ্ডবের সূত্রপাত এবং ইউরোপ, ইরান, থাইল্যান্ডের মতো জায়গায় রোগটি ছড়িয়ে পড়ার পরে আমরা বেশ কিছুটা সময় পেয়েছিলাম প্রস্তুত হবার। সময়টা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি। ত্রিশে জানুয়ারি ২০২০ ভারতের প্রথম নব-করোনাভাইরাস ঘটিত রোগীকে চিহ্নিত করার পরেই আন্তর্জাতিক বিমান ও জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। অভারতীয়দের প্রবেশ একপ্রকার নিষিদ্ধ করা এবং ভারতীয় পাসপোর্টের অধিকারীদের দেশে ফেরামাত্র সরকারি তত্ত্বাবধানে অন্তত দুই সপ্তাহের বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। এই কাজে রীতিমতো ঢিলেমি হয়েছে এবং মানুষের সদিচ্ছার উপর অতিরিক্ত আস্থা রাখা হয়েছে। পজিটিভ কেসের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সকলকে খুঁজে বের করে কোয়ারান্টাইন ও পরীক্ষা করা এবং তখন থেকেই সামাজিক (শারীরিক) দূরত্ব বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত ছিল।

করোনার দিনগুলোয় বাস্তবায়িত হোক নিম্নবিত্তের সুরক্ষা 

একইসঙ্গে পরীক্ষার কিট তৈরি করা, হাসপাতালের শয্যা ও যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করা ইত্যাদি জরুরি কাজ সেরে ফেলা উচিত ছিল, যাতে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে দেশ এই যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে পারত। ওটাই আদর্শ সময় ছিল। আমরা সেদিকে নজর দিইনি। যে সময়ে আন্তর্জাতিক আনাগোনা বন্ধ করার কথা ছিল, তখন আমাদের রাজনৈতিক প্রকল্প ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে আপ্যায়ন করা। অজস্র দেশ যখন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছিল বা লড়ার জন্য জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখন ভারতের রাজধানীতে ভারতবাসীরা লড়ছিল নিজেদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে। দেশের মানুষকে বাঁচানোর তোড়জোড় করার বদলে আমরা ব্যস্ত ছিলাম কে নাগরিক আর কে নয়, তার বাছাবাছিতে। সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল CAA-NPR-NRC করে কিছু মানুষকে অনাগরিক ঘোষণা করে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে ফেলা আর বিরোধীরাও ব্যস্ত ছিলেন এর বিরোধিতাতেই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সমস্যা রাজনীতি সমেত মানুষকেই কোণঠাসা করে ফেলতে পারে, ডিটেনশন ক্যাম্প আর জেলখানা রাষ্ট্রের প্রিয় হলেও হাসপাতাল আর কোয়ারান্টাইন সেণ্টার যে দেশের মানুষের বেশি প্রয়োজন, সেসব কথা কাউকেই ভাবায়নি।

মার্চে লক-ডাউন ঘোষণা করতে হল, কারণ সমস্যা বাস্তবে কতটা গভীরে পৌঁছে গেছে, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না এবং তার মোকাবিলার জন্য আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত নই। এখন এরকম বড় পদক্ষেপ নিয়ে রোগের বিস্তারকে কিছুটা স্লথ না করলে মহামারীকে আর সামলানো যাবে না। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে লক-ডাউনের মতো একটি ব্যবস্থাকে সমর্থন করি, অবশ্যই কিছু 'কিন্তু' ও 'যদি' সমেত।

COVID-19 জাতীয় সংক্রমণ রোধের সেরা উপায় হল TTTI (trace, test, treat, isolate) পদ্ধতি অবলম্বন করা, যা করে দারুণ ফল পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এর জন্য চাই একটি কার্যকর প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং প্রচুর সংখ্যায় পরীক্ষা করার বন্দোবস্ত। প্রথমটি বহু বছর ধরেই তৈরি করে রাখা উচিত ছিল, অথচ দল নির্বিশেষে প্রায় সব শাসক তাকে অবহেলা করেছেন। দ্বিতীয়টির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল ফেব্রুয়ারির মধ্যে। শহর-মফস্বল-গ্রামে বহু মানুষকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন ছিল সত্যিই কতটা ছড়িয়েছে ভাইরাস। সব সংক্রামিত ব্যক্তিকে আইসোলেট করে ফেলা এবং ইতোমধ্যে তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাঁদেরও পরীক্ষা এবং আইসোলেশন। গুরুতর অসুস্থদের চিকিৎসা। এটাই সঠিক পদ্ধতি। যেসব জায়গায় বেশি সংখ্যায় সংক্রামিত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে (cluster) সেসব স্থানকে ঘিরে "রিঙ কণ্টেইনমেন্ট" করা দরকার। ক্লাস্টার অঞ্চল ঘিরে তিন বা পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি "কোর" অংশে সম্পূর্ণ লক ডাউন এবং তাকে ঘিরে আরও তিন কিলোমিটারের "বাফার জোন"। রিঙের মধ্যে কেউ বেরোবে না বাড়ি থেকে, বাজারেও যাবে না। প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ ও অন্য সামগ্রী তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন পুরসভা বা পঞ্চায়েতের কর্মীরা সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করে এবং বিশেষ পোশাক (personal protective equipment বা PPE) পরে। এই জাতীয় ব্যবস্থা খুব তাড়াতাড়ি কোনো দেশ নিতে পারলে, সেখানে সামগ্রিক লক-ডাউনের মতো ব্যবস্থা এড়ানো যেতে পারে, যেমনটা করে দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর। আমরা পারিনি, তাই আজ পুরো দেশ থেমে গেছে।

সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ায় যেখানে প্রতি দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৬০০০ এর বেশি মানুষের পরীক্ষা হয়েছে SARS-CoV-2-এর খোঁজে, সেখানে ভারতে পরীক্ষার হার ১৮ মাত্র। প্রায় সাড়ে তিনশ ভাগের একভাগ কাজ করেছি আমরা। আমাদের হাতে পরীক্ষার কিট সীমিত এবং তা মহার্ঘ্য বলে সংক্রমণের সবরকম লক্ষণ দেখা না দিলে পরীক্ষা করতে দ্বিধা করেছেন আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য আধিকারিকরা। ফলে কম অসুস্থ ব্যক্তি এবং সুস্থ বাহক (asymptomatic carrier)-দের সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। আজ যে মনে হচ্ছে ভারত এখনও স্টেজ-২ তে আছে, সামাজিক স্তরে সংক্রমণ তেমনভাবে শুরু হয়নি এখনও, তা হয়ত কম পরীক্ষার দরুন অনেককিছু না জানার ফল। সুতরাং পরিস্থিতিকে লঘুভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বহু মানুষকে পরীক্ষা করে এব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।

যেহেতু আইসোলেশন আর চিকিৎসা দাঁড়িয়ে আছে রোগী ও জীবাণুবাহকদের চিহ্নিত করতে পারার ওপর, তাই পরীক্ষার এই ফাঁকটা পূর্ণ করতেই হবে। আমদানি বা বিশেষ সংস্থার মনোপলির উপর নির্ভর করে স্বল্প সংখ্যক দামী কিট দিয়ে এই কাজ সম্ভব নয়। PCR (polymerase chain reaction) ভিত্তিক পরীক্ষা উন্নতমানের হলেও শুধুমাত্র এর উপর নির্ভর করে এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে ভুল হবে। ব্যাপক হারে স্ক্রিনিংয়ের জন্য প্রয়োজন সস্তা র‍্যাপিড টেস্ট, যার জন্য দ্রুত প্রচুর কিট তৈরি করা সম্ভব। এই টেস্ট কতটা নির্ভুল হবে? নতুন টেস্টের ক্ষেত্রে আমরা বিচার করি তার সেন্সিটিভিটি (রোগ/জীবাণু থাকলে তা ধরতে পারার ক্ষমতা), স্পেসিফিসিটি (অর্থাৎ জীবাণু না থাকলে "ফলস পজিটিভ" কত কম হবে) এবং পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রেডিক্টিভ ভ্যালু ইত্যাদি। এক্ষেত্রে স্ক্রিনিংয়ে ব্যবহৃত পরীক্ষার স্পেসিফিসিটি নিয়ে ভাবিত হবার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষাটি সেন্সিটিভ হলেই হল, অর্থাৎ ফলস নেগেটিভ যেন কম হয়। ফলস পজিটিভ কিছু আসুক, ক্ষতি নেই। এই স্ক্রিনিংয়ে যাঁদের ফল পজিটিভ আসবে, তাঁদেরকে আলাদা করে উন্নততর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাবে সত্যিই জীবাণু আছে কিনা। সৌভাগ্যক্রমে কিছু দেশীয় সংস্থা সস্তায় বিপুল পরিমাণ কিট তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করেছে কয়েকদিনের চেষ্টাতেই। এখন সরকারের দায়িত্ব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর গুণমান পরীক্ষা করে এগুলোকে কাজে লাগানো।

লক-ডাউনের সময়েও নিষ্ঠা ও দ্রুততার সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা অনুসারে এই পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। নাহলে লক-ডাউনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। হাসপাতালগুলোকে এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত সঠিক গুণমানের PPE-র ব্যবস্থা না করলে তাঁরা অসুস্থ হবেন, স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়বে এবং তাঁরা জীবাণুও ছড়াবেন অন্য রোগীদের মধ্যে। এঁদের বাসস্থান আর পরিবহনের ব্যবস্থাও করতে হবে। বাজারে জটলা করলেও ব্যর্থ হবে লক-ডাউন। এমনিতেই একুশ দিনের লক-ডাউন সম্ভবত যথেষ্ট নয়। আরও প্রলম্বিত করতে হবে একে, যার নানা গাণিতিক হিসেব আছে। তবে ব্রিটেনের মতো ছয়মাসের লক-ডাউনের ভাবনা আমাদের দেশে অসম্ভব। আমাদের লড়াইটা শেষ করতে হবে তাড়াতাড়ি। লড়াইটা ব্যক্তির নয়, সমষ্টির। তাই গোষ্ঠী-চেতনাকে জাগাতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নয়, চাই শারীরিক দূরত্ব, মানসিক সাহচর্য আর সামাজিক মেলবন্ধন। মেলবন্ধনটা হলে তবেই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারব, কীভাবে গাদাগাদি না করেও সকলে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সুষ্ঠুভাবে পেতে পারেন। প্রতিযোগিতাকে সহযোগিতায় রূপান্তরিত করতে হবে।

সমাজচেতনা আর সকলের জন্য খাদ্য ইত্যাদির কথা তুলে মধ্যবিত্তের কথাটুকু বলে থেমে গেলে হাস্যকর হবে। দরিদ্র, গৃহহীন, পরিযায়ী শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও কর্মহীনদের খাদ্য, বাসস্থান, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী আর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধ মেনে চলার মতো যথেষ্ট স্থান না দিতে পারলে সর্বনাশ হবে। সেক্ষেত্রে অনাহারে বহু মৃত্যু হবে, অপুষ্টিজনিত অসুখ বাড়বে, এমনকি করোনাভাইরাসও বেশি করে ছড়াবে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক মুম্বাই-দিল্লির মতো শহরে কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের সেইসব শহরেই রেখে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত ছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর যৌথ উদ্যোগে। সেসব কিছুই না পেয়ে অনেকে ফিরে গেছেন নিজদের দেশ-গাঁয়ে ট্রেনে গাদাগাদি করে। এঁদের মধ্যে কতজন সংক্রামিত হলেন এভাবে, তা কেউ জানে না। তাঁদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা করা দুঃসাধ্য। যাঁরা ফিরতে পারেননি আচমকা লক-ডাউনের আগে, তাঁদের হাতে যথেষ্ট অর্থ নেই এই কদিন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো। শ্রমজীবী মানুষদের হঠাৎই নির্ভর করতে হচ্ছে দয়ালু ধনীদের দানের উপর, কারণ রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব নেয়নি। একশ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীকে লজ্জা দিয়ে অনেকে দল বেঁধে বেরিয়েছেন কয়েকশ' মাইল হেঁটে স্বগ্রামে ফিরবেন বলে। লক-ডাউনের সুফলকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল্লি সংলগ্ন আনন্দ বিহার আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসে কয়েক হাজার মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়। এঁরা বাড়ি ফিরবেন কোনোক্রমে, শরীরে ক্লান্তির সঙ্গে হয়ত ভাইরাস নিয়েও। ঘনিয়ে উঠবে সংকট।

এই সংকট এড়ানো যেত সহজেই। অনাগরিক চিহ্নিত করার মোহ ছেড়ে সরকার সঠিক সময়ে দেশবাসীর দায়িত্ব নিলে ভারতকে নিরাপদে রাখা যেত আরও সহজে। এরপর গ্রামাঞ্চলে রোগ ছড়িয়ে পড়লে তা সামলানোর প্রক্রিয়াটি হবে দীর্ঘতর, জটিল এবং আর্থসামাজিকভাবে চ্যালেঞ্জিং। অপেক্ষাকৃত সহজ কাজটিকে কঠিন করে নেওয়া হল, কিন্তু এখনও তা হাতের বাইরে যায়নি। এই মুহূর্তে সরকার এবং সমাজ একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লে এই লড়াই আমরা জিতব এবং অল্প সময়ের মধ্যেই জিতব।

সমষ্টিচেতনার পাশাপাশি প্রয়োজন হবে বিজ্ঞানেরও। আমাদের সীমিত জিনিসপত্র, অর্থ, সামর্থ আমরা কীভাবে ব্যয় করব এই সংকটের মোকাবিলায়, তা স্থির করতে হবে বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া থেকে শারীরিক দূরত্ব সবকিছুর পিছনে আছে জীববিজ্ঞানের যুক্তি। সেই বিজ্ঞানটুকু সংক্ষেপে আলোচনা করা যাবে পরের পর্বে।

(কৌশিক দত্ত আংরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Jon O Swasthyo coronavirus
Advertisment