Advertisment

অসংখ্য গবেষণায় বাড়ছে গোলযোগ

হঠাৎ করে কোভিডের বাজারে ডেটার ছড়াছড়ি। আকাশপাতায় খুঁজলেই সংক্রমণ এবং মৃত্যু নিয়ে অসংখ্য তথ্য। আর তাতে অসংগতি প্রচুর। বিশ্বজুড়ে এখন জগৎ-মিটার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Covid 19 Research, Data

ছবি- শশী ঘোষ

লকডাউনে একটা বড় অংশের মানুষ মুশকিলে। তবে এর মধ্যেই বিশ্বজুড়ে কিছু মানুষ আছেন যাদের সত্যিই এই অবস্থাতেও খুব অসুবিধে নেই। এদেরকে সুবিধাভোগী শ্রেণ্ হিসেবে ধরা যেতে পারে। সুবিধা ভোগ করা দোষের কিছু নয়। সবসময়েই সমাজে এক অংশের মানুষ থাকবেন যাদের অসুবিধে কম। ভালো কথা হল আজ এই বিপদের সময় তাদের অনেকেই বিভিন্ন সাহায্য করছেন নিম্নবিত্তদের। উদাহরণস্বরূপ ভারতবর্ষের সরকারি চাকুরীরত মানুষদের কথা বলা যায়। তাদের আয় একেবারে সুরক্ষিত। সেটা বুঝেই কেন্দ্রীয় সরকার এ বছরের জানুয়ারি থেকে কর্মী ও পেনশনভোগীদের মহার্ঘভাতা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবশ্যই দেশের কথা ভাবলে এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এবং তা সাধারণভাবে মেনে নিয়েছেন সরকারি কর্মীরা। বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা এক্ষেত্রে বাঁচল, যা কিনা সরকার (চাইলে?) ব্যবহার করতে পারে নিম্নবিত্তের খাদ্য সুরক্ষায়।

Advertisment

কোভিড-১৯: লকডাউন বনাম হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব

মূল মুশকিল হচ্ছে এই জায়গাতেই। বেশ কিছু গবেষক সংখ্যা নিয়ে খুব সহজে নাড়াচাড়া করতে পারেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ, ফলে দেশ বিদেশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য নিয়ে ডাঁটাচচ্চরি রাঁধার সময় এখন অনেক। এতে দোষ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যে গবেষণা হয় তা তো সব নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্যে নয়। গবেষণা চলে স্বাভাবিক নিয়মে। কখনও কখনও দু একটা কালজয়ী আবিষ্কারের খবর আসে, বাকিটা এগোয় দুলকি চালেই। কিন্তু হঠাৎ করে কোভিডের বাজারে ডেটার ছড়াছড়ি। আকাশপাতায় খুঁজলেই সংক্রমণ এবং মৃত্যু নিয়ে অসংখ্য তথ্য। আর তাতে অসংগতি প্রচুর। বিশ্বজুড়ে এখন জগৎ-মিটার। কিন্তু তার গোলমাল ভয়ঙ্কর। চিনের মৃত্যুসংখ্যা ঠিক করতে গিয়ে এক দিন একগাদা সংখ্যা যোগ করে দেওয়া হল। সংবাদমাধ্যম হইচই করে উঠল, তারপর বোঝা গেল সেই হাজারোর্ধ্ব মৃত্যু এক দিনের নয়, আগের ভুল শোধরানোর প্রচেষ্টা। একই ঘটনা ঘটেছে আমেরিকার ক্ষেত্রেও। সেখানে এক রবিবারে মৃত্যু সংখ্যা ছ হাজারের বেশি করে দেওয়া হয়েছিল, সেই ভুল সংশোধন করা হয়েছে পরে। এগুলো কিন্তু সেইসব দেশের দোষ নয়, বরং যারা অন্তর্জালে আকাশপাতা সামলাচ্ছেন তাদের গোলমাল। আর এই অবস্থায় গুলিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে গাদা গাদা খবর। যার দায় নেওয়ার কেউ নেই। লকডাউন কবে উঠবে, কিভাবে উঠবে এই নিয়ে বহুবিধ বিপরীত মতামত সংক্রমিত হচ্ছে করোনার থেকেও অনেক দ্রুত হারে। বিপদ হচ্ছে একেবারে খেটে খাওয়া মানুষের, যাদের কাছে এই সমস্ত অনুমানের ঠিক ভুলের ওপর নির্ভর করে আছে বাঁচা-মরা। অর্থাৎ যিনি মত দিচ্ছেন তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি শূন্য, আর আদতে এই মতামতে যিনি লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তিনি পড়ছেন মহাবিপদে।

এই অবস্থায় কলকাতার কয়েকজন অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিচিত শিক্ষাবিদ অন্তর্জালে একটি আবেদন রেখেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন পরিসংখ্যানবিদ প্রবাল চৌধুরী এবং দেবাশিস সেনগুপ্ত, সম্ভাবনাতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ রজত হাজরা, যথাক্রমে গণকবিদ্যা এবং সংকেতবিদ্যায় পারদর্শী অরিজিত বিষ্ণু এবং দেবরূপ চক্রবর্তী। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এঁদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। বিজ্ঞানী এবং বিদ্বজ্জনদের কাছে তাঁদের আবেদন খুব পরিষ্কার। সকলের প্রতি সম্মান রেখে তাঁরা বলছেন যে এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক যে বিশেষজ্ঞদের পরস্পরবিরোধী এবং বিভ্রান্তিকর (কনফ্লিক্টিং অ্যান্ড কনফিউসিং) বক্তব্য এই অভূতপূর্ব বিশ্বব্যাপী লকডাউনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে গবেষণার যে সীমাবদ্ধতা, তার কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া শক্ত। তাই হঠাৎ করে কোভিড নিয়ে প্রকাশিত অসংখ্য অপরিণত গবেষণাপত্র মোটেও কালোপযোগী নয়। সকল বিজ্ঞানীদের কাছে তাঁদের আবেদন যে সবাই সময় নিয়ে কাজ করুন, এবং তাড়াহুড়ো না করে নিজ নিজ গবেষণা কিছুটা পরিপক্ক হতে দিন, যার থেকে ভবিষ্যতের অনুমান কিছুটা সত্যি হয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি যদি সত্যিই খুব তাড়াতাড়ি কোভিডমুক্ত পৃথিবীতে আমাদের পৌঁছে না দিতে পারে, সেক্ষেত্রে বাস্তবকে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। তাহলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তি সরিয়ে এবং মিথ্যে আশায় ভর না করে কোভিড আক্রান্ত পৃথিবীতে চলার প্রস্তুতি নেবেন। সমাজবিজ্ঞানে কিছুই চরম সত্য নয়। তবে এই কথা কিন্তু গত প্রায় দুমাস ধরে বারবার বলছেন হু-এর পরামর্শদাতা ডঃ ডেভিড নাবারো। সেই কথারই প্রতিধ্বনি এই কলকাতার কয়েকজন বিজ্ঞানীর কলমে।

চিকিৎসক ও সমাজ – মহামারীর দ্বিপ্রহরে 

আসলে সমাজের গোটা বিষয়টাই খুব জটিল। আমার এক সমাজমনস্ক এবং সংবেদনশীল ছাত্রবন্ধু মন্মথ রায় ফেসবুকে নিচের কথাগুলি লিখেছেন। উনি শুধু ফেসবুকে নেই, সংক্রমণের দিনগুলিতে সহমর্মীদের সাথে নিয়ে নিম্নবিত্তদের পাশে আছেন রাস্তাতেও।

“গরীব বলে কোটায় কোচিং নিতে যেতে পারে নি। কোটা থেকে ফিরছিল না বলে গভর্নমেন্ট ব্যবস্থা করে নি ফেরার। পায়ে হাঁটছিল বলে শেষ অবধি প্রাণটা রাখতে পারে নি। মেরিট ছেড়ে দিন। প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারাটার জন্যেও প্রিভিলেজ লাগে। ওটাকে ক্লাস প্রিভিলেজ বলে।”

যারা প্রিভিলেজড, তাঁরা উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্ক বিজ্ঞান মুখস্থ করে সাধারণ মানুষদের গুলিয়ে না দেওয়াটাই ভালো। ফিরব বললেই ফেরা যায় না, কোভিড দুনিয়ার নিউ নর্মাল  — এই অনুসিদ্ধান্ত একমাত্র সত্যিকারের মহান আবিষ্কারের মাধ্যমেই ভুল প্রমাণ করা যায়। যদি আদৌ আসে, কোভিডমুক্ত পৃথিবী আজকের দিনে নাম না জানা বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই আসবে। তাঁরা ঘাড় গুঁজে কাজ করছেন পরীক্ষাগারে, প্রচার সেখানে গৌণ। দিনে দুবার উৎপন্ন করা আধকাঁচা গবেষণাপত্র কোভিড মুক্ত দুনিয়া দখলে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Anyo Paksha Coonavirus COVID-19
Advertisment