Advertisment

চিকিৎসক ও সমাজ - মহামারীর দ্বিপ্রহরে 

ক্যানেস্তারা পেটানোর সময় আপনারা চিকিৎসক, হাসপাতালের ট্রলি ঠেলা ওয়ার্ড বয় বা মিউনিসিপ্যালিটির সাফাই কর্মচারীদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছিলেন না। বিশ্বাস করছিলেন যে ট্যাংট্যাং আওয়াজে বিরক্ত হয়ে করোনা পালাবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pandemic, Doctor-Patient

মেঘালয়ের চিকিৎসককে ৩৬ ঘণ্টা ধরে কবর দেওয়া যায়নি, পাড়া-পড়শীর প্রতিবাদে (ছবি- ট্যুইটার)

  চিকিৎসকদের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা এই সামাজিক সম্পর্কটিকে  "রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক" নামে অভিহিত করতে ভালবাসি। ইতিপূর্বে এই সম্পর্কের টানাপোড়েন বা চিকিৎসকদের নিয়ে সামাজিক অশান্তি ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্লেষণ করার বা প্রবন্ধ লেখার সময় আমিও "রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক" পরিভাষাটিই ব্যবহার করেছি এবং বেশিরভাগ সময় ধরে নিয়েছি যে এই সম্পর্কের অবনতির ফলেই সব সমস্যা তৈরি হয়েছে। মূলত আত্মসমালোচনা এবং এই সম্পর্কের অবনতির কারণ অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছি। এর কারণ আমরা (চিকিৎসকেরা) ছাত্রজীবনে 'ক্লিনিকাল মেডিসিন' পড়ার এবং ওয়ার্ডে রোগী দেখতে শেখা শুরু করার প্রথম দিন থেকেই "doctor-patient relationship" কথাটিকে মাথায় ঢুকিয়ে ফেলেছি। গির্জার পাদ্রি যেমনভাবে যিশুর নাম অন্তরে গেঁথে দেন, তেমনিভাবে আমাদের বই এবং শিক্ষকেরা এই সম্পর্কের নাম আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন পবিত্রতম কোনো স্বর্গীয় বন্ধনের মতো করে, যার কাছে আমরা বলিপ্রদত্ত থাকব, যে সম্পর্ক আমাদের পরিবারকেও পিছনের সারিতে ঠেলে দেবে।

Advertisment

এই শিক্ষার দ্বারা আমরা এতটাই মোহগ্রস্ত যে এই শব্দবন্ধটির বাইরে বেরিয়ে ভাবতে পারিনি। না, এই সম্পর্কের পবিত্রতাকে অস্বীকার করার কথা ভাবছি না, ভাবছি এই শব্দটির সর্বব্যাপী প্রয়োগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা। অন্যরকম কিছু সামাজিক সম্পর্ক বা আদান-প্রদানের ঘাড়ে এই শব্দবন্ধটি এবং তার আনুষঙ্গিক পবিত্রতা আরোপ করে সেগুলোর প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করা হচ্ছে এবং সেগুলোর বিষয়ে চিকিৎসকদের বস্তুত বিভ্রান্ত করে রাখা হচ্ছে যাতে একতরফা তাঁরাই বিবেকের আদালতে সারাজীবন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন।  COVID-19 আন্তর্জাতিক মহামারী আশ্চর্যজনকভাবে এই বিভ্রান্তি কাটাতে সাহায্য করল। একথা ঠিক যে বাণিজ্য, রাজনীতি আর আইন যৌথ উদ্যোগে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ককে বিষাক্ত করার চেষ্টা করেছে এবং কিছু চিকিৎসক সেই ফাঁদে পা দেওয়ায় কাজটি সহজতর হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। যেখানে বিষ ছড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি, তা হল চিকিৎসক-সমাজ সম্পর্ক (doctor-society relationship)। বিষ বাইরে থেকে ছড়িয়েছে না সমাজের ভেতরেই ছিল, তা বিস্তৃততর বিশ্লেষণের বিষয়। প্রাথমিকভাবে এই ক্ষেত্রটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করা এবং রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের থেকে একে আলাদা করতে শেখা জরুরি।

ভারতের যে ‘করোনা যোদ্ধাদের’ কথা কেউ বলছেন না

এর আগে চিকিৎসকদের যাবতীয় সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা প্রায় সকলেই ঘুরেফিরে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কটির স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ব্যক্ত করেছি এবং একে সুস্থ করে তোলার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি, সব সমস্যার সমাধান খুঁজেছি এরই মধ্যে। এরকম হয়েছে কারণ এই সম্পর্কটুকুই আমাদের কাছে পবিত্র এবং একমাত্র একে বাঁচাতেই আমরা উদগ্রীব। এই একগামী প্রেম পবিত্র হলেও এর মোহ আমাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছিল। এভাবে আমরা নিজেদের বোকা বানিয়েছি। যেসব অচিকিৎসক সমাজকর্মী এবং বিশ্লেষক এই বিষয়ে সত্যিকারের আন্তরিকতা নিয়ে লিখেছেন বা বলেছেন, তাঁরাও আমাদের মতোই এই শব্দবন্ধটির দ্বারা মোহগ্রস্ত ছিলেন। এর ফলে তাঁরাও সমস্যার একটিমাত্র দিক নিয়ে আলোচনা করতে পেরেছেন। ফলে সমস্যাটি বজায় থেকেছে এবং গভীরতর হয়েছে।

আসল সমস্যাকে ছেড়ে অন্যদিকে তাকালে ঠকতে হবেই। এটাই নিয়ম। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন নব করোনাভাইরাসের রোগকে মামুলি সর্দিকাশি ভাবলে বিপদ, ঠিক তেমনি। ঠকানোর প্রয়োজনে ইচ্ছে করেও দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। যেমন করেন ম্যাজিশিয়ানরা। তাঁদের হাতসাফাই অনেকটাই নির্ভর করে দর্শকের নজর আকর্ষণীয় কিন্তু অবান্তর অন্যকিছুতে আটকে রাখতে পারার ওপর। গার্হস্থ্য হিংসার মতো ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অত্যাচারী স্বামী অত্যাচারিতা স্ত্রীর চিন্তাভাবনাকে ভুল দিকে পরিচালিত করেন, যাতে তিনি ভুল কারণের সমাধান খুঁজে জীবন কাটিয়ে দেন এবং স্বামীর আধিপত্য আজীবন অক্ষুণ্ণ থাকে। যাঁরা গার্হস্থ্য হিংসার অবসানকল্পে কাজ করেন, তাঁদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হল এ সংক্রান্ত আজগুবি মিথগুলো সরিয়ে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে সঠিক দিকে তাকাতে বাধ্য করা। মিথগুলো এতই আকর্ষণীয়, আপাতভাবে বিশ্বাসযোগ্য এবং দীর্ঘদিন ধরে এমনভাবে তারা মনের গভীরে গেঁথে গেছে যে তাদের অস্বীকার করা এবং আসল সমস্যাকে চেনা কঠিন হয়। এক্ষেত্রেও রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের সর্বময়তা এবং তার মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান লুকিয়ে থাকার রূপকথা আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে তার বাইরে কিছু খোঁজা কঠিন হবে। এমনকি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার কারণে প্রথম থেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করছি।

COVID-19 অতিমারী আমাদের সুযোগ দিল ব্যাপারটাকে অন্য আলোয় দেখার। এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পালন করছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিভিন্ন মিডিয়ায় সেকথা বারবার স্পষ্টভাবে শোনাও গেছে বিভিন্ন মানুষের মুখে। মন্দির-মসজিদ-গীর্জা বন্ধ, কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে, সেখানেই লড়াই চলছে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা... একথা মৌখিকভাবে স্বীকার করেছেন প্রায় সকলেই। চিকিৎসা পরিষেবা যে আসলে এখনও পুরোপুরি ব্যবসা নয়, মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদটাই মুখ্য, তা স্পষ্ট হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক দৃঢ়তর হবে এবং চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ কমবে। প্রত্যাশার প্রথম অংশটুকুই সঠিক ছিল, দ্বিতীয় অংশটা নয়। তাই প্রথমটা ঘটল, দ্বিতীয়টা ঘটল না। প্রথমটার সঙ্গে দ্বিতীয়টা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত নয় আসলে। মৃত্যুভয় তীব্র হলে চিকিৎসকের উপর রোগীর নির্ভরশীলতা বাড়ে, সেই লগ্নে চিকিৎসক রোগীকে আগলে রাখতে চেষ্টা করেন এবং এর ফলে উভয়ের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়, এই অব্দি ঠিক। তা বলে এর ফলে বৃহত্তর সমাজের স্বার্থপরতা, অসূয়া, ক্রূরতা ইত্যাদি হঠাৎই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশা করা অনেকটা দুই শালিক দেখলে দিন ভালো যাবে ভাবার মতো। এই দুটোর মধ্যে যথেষ্ট কার্যকারণ সম্পর্ক নেই, সমাপতন আর কল্পনাই এসব ধারণার ভিত্তি।

হার্ড ইমিউনিটিই কি অনিবার্যতা?

এই মহামারীর সময়ে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের লড়াই যখন পুরো দমে চলছে, তখনও কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষে সমানভাবে চলতে থাকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর আক্রমণ। বহুক্ষেত্রে বরং নতুনতর ও চমকপ্রদ হিংস্রতা আমরা দেখতে পেলাম। ডাক্তার পেটানোর নিয়মিত ব্যায়াম বন্ধ হল না। করোনাভাইরাস রোগীর খোঁজে বা সচেতনতা প্রসারের চেষ্টায় বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে আক্রান্ত হলেন চিকিৎসকেরা। পয়সার লোভে তাঁরা এই কাজ করছিলেন, এই মনোহর গল্পটি এই মুহূর্তে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশন করার কোনো উপায় নেই বলে অনেক বুদ্ধিজীবী আমতাআমতা করে মাথা চুলকোচ্ছেন।

সীমান্তে কর্মরত সৈনিকদের যে সম্মান দেওয়া হয়, তার উল্টোটা দেওয়া হল করোনা-যুদ্ধের সৈনিকদের। ডাক্তার-নার্সদের আবাসন বা পাড়া থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন শহুরে শিক্ষিত মাতব্বর শ্রেণির মানুষেরাও, যাঁদের অনেকেই চায়ের আড্ডায় মানবতাবাদের তত্ত্বকথা আউড়ে থাকেন। চিকিৎসক ও নার্সদের সংগঠনের তরফ থেকে সরকারের কাছে আপদকালীন আর্তি জানিয়ে রীতিমতো সরকারি নির্দেশিকা জারি করিয়ে শাস্তির ভয় দেখিয়ে তাঁদের থামাতে হল, যদিও বৈষম্যমূলক আচরণ বা দৈনন্দিন দুর্ব্যবহার বন্ধ হল না। ডাক্তার জানলে পাড়ার মুদি দোকান দূর করে দেয়, পরিচয় গোপন করে অন্য পাড়ায় গিয়ে জিনিস কিনতে হয়। এমন দুঃসময়ে চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিবাদ আন্দোলন করতে পারবেন না, মানবিকতার দায়ে তাঁরা সব সয়েই কাজ করতে থাকবেন, এই ভরসায় অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানোর সাহস পেয়েছেন অনেকে।

না, জনতা কার্ফুর বিকেলে দেশব্যাপী থালা-বাটি বাজানোর গল্পটাকে ঢাল বানাবেন না। ক্যানেস্তারা পেটানোর সময় আপনারা চিকিৎসক, হাসপাতালের ট্রলি ঠেলা ওয়ার্ড বয় বা মিউনিসিপ্যালিটির সাফাই কর্মচারীদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছিলেন না। একজন রাজনৈতিক নেতার আজ্ঞা পালন করে তাঁর প্রতি সংহতি ব্যক্ত করছিলেন অথবা বিশ্বাস করছিলেন যে ট্যাংট্যাং আওয়াজে বিরক্ত হয়ে করোনা পালাবে। মানুষের ফুসফুস বা মনে বাসা বাঁধা ভাইরাসের উপর এই বাজনার কোনো প্রভাবই পড়েনি। বাড়তে থেকেছে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর আক্রমণ।

পুঁজিবাদের কবর খুঁড়তেই যেন করোনাভাইরাসের আবির্ভাব

সহ্য করতে করতে আর না পেরে শেষে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন মহামারীর মধ্যেও প্রতিবাদে ফেটে পড়তে বাধ্য হল ডঃ সাইমন হারকিউলিসের মৃত্যুর পর। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইতে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। যাঁদের বাঁচাতে গিয়ে তিনি প্রাণ দিলেন, তাঁরাই হতভাগ্য মানুষটিকে কবরের মাটিটুকু থেকেও বঞ্চিত করতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। শববাহী যান আটকে তাঁর অন্তিম যাত্রার সঙ্গীদের নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। শেষে ডঃ প্রদীপ নামে এক চিকিৎসক কোনোক্রমে একা হাতে বারো ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে তাঁকে চিরবিশ্রামের শয্যাটুকু পেতে দেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন ডঃ প্রদীপ সহ অনেকেই। ভেঙে পড়ছে চিকিৎসক-নার্সদের মনোবল।

লক্ষণীয় বিষয় হল এসব নিয়ে সমাজের বিদগ্ধজনেদের তেমন হেলদোল নেই। পরীক্ষামূলকভাবে নিজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কথা জানিয়ে দেখলাম তাঁরা পাত্তাই দিলেন না। চিকিৎসকদের প্রতি এহেন আচরণকে স্বাভাবিক বলেই গণ্য করতে অভ্যস্ত তাঁরা। আপনি যদি রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের মধ্যেই এসব সমস্যার কারণ ও সমাধান খুঁজে পাবার ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত হন, তবে এবার আপনার স্তম্ভিত হবার পালা। গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসবেন, কেন এমন হচ্ছে? আলোচনা বা মন্তব্যের সময় যেসব অজুহাতকে অবলম্বন করে অপছন্দের বিষয়গুলোকে এতদিন সহজে এড়িয়ে গেছেন, সেসব অজুহাত করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছে। তাই আপনাকে হতচকিত দেখাচ্ছে। আমরা চিকিৎসকেরাও স্তম্ভিত একই কারণে। আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম, যতক্ষণ না মিথের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাবার অভ্যাস থেকে মুক্তি পেয়েছি। আসলে অবাক হবার কিছু নেই। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সামাজিক হিংসা একটা স্বতন্ত্র বিষয়, যার সব রহস্য রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের পবিত্রতায় লুকিয়ে নেই, এই সত্যটা বুঝলেই হতভম্ব ভাব কেটে যাবে।

অনেক আগেই আমাদের বোঝা উচিত ছিল। বোঝার সুযোগ আগেও এসেছিল। কয়েক বছর আগে কানপুরের রাস্তায় এক রাজনৈতিক নেতার আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ফলস্বরূপ গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজের ছাত্র-চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হন গুণ্ডাদের হাতে। ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া থেকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত সবকিছুই হয়েছিল সেদিন। প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে গুণ্ডাদের মদত দিয়েছিল। ভারত জুড়ে চিকিৎসকদের প্রতিবাদ শুরু হতেই কিছু বিদ্বান ব্যক্তি এই আক্রমণকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়ে বলতে লাগলেন, 'কিন্তু ডাক্তারদের গাফিলতি থাকে।" ঘটনাটির সঙ্গে চিকিৎসা বা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের কোনো সম্পর্কই ছিল না, তবু বুদ্ধিজীবীদের অজুহাত একই থেকে গিয়েছিল। তখন খটকা লেগেছিল, কিন্তু ধাঁধাটার গিঁট খুলতে পারিনি। হাসপাতালে কর্মরতা মহিলা চিকিৎসকেরা বহিরাগতদের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হলে যখন শিক্ষিতা নারীবাদীরাও মহিলা চিকিৎসকটিরই দোষ আছে ধরে নিয়ে ভিক্টিম ব্লেমিং-এ নেমে পড়েন, তখনও বোঝা উচিত ছিল যে আমাদের ভাবনার প্রক্রিয়াটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলেই আমরা ক্রমাগত বিপথে চালিত হচ্ছি।

লকডাউনে কেন বাড়িই অনেক মহিলার পক্ষে হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বিপজ্জনক

করোনাভাইরাস আমাদের কুসংস্কারকে হত্যা করল। চোখে হাত দেওয়া বারণ বলে চোখের ঠুলিটা খুলে পড়ে যাবার মুহূর্তে আমরা সেটাকে এঁটে নিতে পারিনি চিরকালের মতো। সেই সুযোগে সত্য সামনে এসে দাঁড়াল। এর পরেও রোগীর জীবন এবং রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ককে বাঁচানোর জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব, কারণ তা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। পার্থক্য হবে এটুকুই যে তার মধ্যে কোনো অবান্তর প্রত্যাশা থাকবে না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর নানাধরণের আক্রমণ এক পৃথক সামাজিক সমস্যা। তার স্বরূপ স্বতন্ত্রভাবে বুঝতে হবে গুলিয়ে দেবার চেষ্টাকে পরাজিত করে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আইনগত স্তরে। এতদিন এসব নির্যাতনকে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের সঙ্গে সংযুক্ত ভাবতাম বলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমরা দুর্বল ও ভাবালুতায় আক্রান্ত ছিলাম। সেই ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে করোনাভাইরাস আমাদের মুক্ত করল, তাই ভবিষ্যতে প্রতিরোধটি ভিন্ন চরিত্রের, জোরদার এবং সফলতর হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

 

এই কলামের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Jon O Swasthyo coronavirus COVID-19
Advertisment