Advertisment

ইঞ্চিতে মাপা সামাজিক দূরত্ব

বস্তিতে একজন মানুষও যদি কোভিড আক্রান্ত হন তাহলে গোটা জায়গায় তা ছেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি, এবং সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মিটারে বা ফুটে সেখানে হিসেব হয় না, হয় সেন্টিমিটার কিংবা ইঞ্চিতে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Social Distance, Lockdown

ফুলবাগানে খড়ির গণ্ডি মাপা সামাজিক দূরত্ব (ছবি- পার্থ পাল)

একটাই প্রশ্ন আমাদের চারিদিকে। দেশ বিদেশে বিভিন্ন ধরণের মানুষ বিভিন্ন ভাবে ভাবছেন। এ এমন এক সমস্যা যার সোজা পথে সমাধান কিছু নেই। বদল এর মধ্যেই এসে গেছে বিশ্বব্যবস্থায়। দেশনেতারা যথেষ্ট দুশ্চিন্তায়। তাঁরাও ভাবার চেষ্টা করছেন কিভাবে এই গোলমাল থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে। এর মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষের হাতের কাজ কমছে প্রতিদিন। অবশ্যই যে বিপুল অংশের শ্রমিক অন্যের জন্যে খাটেন, তাঁদের কাজ একেবারে কমেছে। কারণ কারখানা বন্ধ, মধ্যবিত্ত বাড়িতেও ঘর মোছা বাসন মাজার কাজে বিধিনিষেধ। সব মিলিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে ভাঁটা পড়েছে পুরোপুরি। এর অনুসিদ্ধান্তে যে মূল দুশ্চিন্তা হানা দেয় তা খাবারের। সরকারি সুরক্ষা ছাড়া যে আর কোন পথ তাঁদের নেই সেটা বুঝছেন সবাই। সরকারও চেষ্টা করছেন। সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে কাজ না থাকলে, তাঁদের বসিয়ে খেতে দেওয়াটা যে সভ্যতার একটা দায়িত্ব এটা বোঝার মত সময় আগে কখনও আসে নি। ফলে সে সমস্যা সমাধানের সুযোগ পান নি শাসক কিংবা প্রশাসকেরা। এবার সেটাই একেবারে প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে ঘাড়ে পড়েছে। এখান থেকে সরকারের মুক্তি পাওয়া অসম্ভব, সে তিনি যে পন্থারই হোন না কেন।

Advertisment

এই অসুখ থেকে মুক্তির মূল উপায় সামাজিক দূরত্ব এবং অসুস্থ হলে ঘরে অন্তরীণ থাকা। যাঁদের কাছে ঘর সংজ্ঞায়িত এমন মানুষ এদেশে প্রচুর। তাঁদের মধ্যে যেমন উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা আছেন, তেমনই আছেন গ্রামের দিকে বসবাস করা কৃষিজীবী নিম্নবিত্ত কৃষক। এই জায়গায় আলাদা থেকে রোগ না ছড়ানোর উপায় একেবারে পরিষ্কার। মানুষকে তা মানতেই হবে, এবং দায়ে পড়লে জনগণ তা মানবেনও।

মহামারীকালে দায়িত্ব ভাগাভাগি

এর অন্যদিকটা নিম্নবিত্তের নগরকেন্দ্রিকতা, আর সেই জায়গাটাই ভয়ঙ্কর। এদেশের ঠিক কত মানুষ শহরের বস্তিতে থাকেন সে পরিসংখ্যান সঠিক ভাবে খুঁজে বার করা শক্ত। তবে তা যে খুব সহজেই কুড়ি কোটি টপকে যাবে সে খবর কারও অজানা নয়। এদের থাকার জায়গাটা ঠিক কেমন? অঙ্কের হিসেবে একটা দশফুট গুণ দশফুট ঘরে অনেক সময়েই কমপক্ষে জনাপাঁচেক মানুষ থাকেন। এমনকি কলকাতা, দিল্লি বা মুম্বাইয়ের এমন বস্তি আছে যেখানে চব্বিশ ঘণ্টার দিনে তিন ভাগে ভাগ হয়ে মানুষ কাজে বেরোন এবং ঘরে ঘুমোন।

অর্থাৎ ভর দুপুরবেলা ঘুমনোর ছ ঘণ্টা সময় পাবেন, এরকম মানুষও আছেন, যাদের কাজটা রাতে। কলকাতায় শীত কম, কিন্তু দিল্লির মত জায়গায় শীতকালে রাতে ফুটপাথে শোয়ার জন্যে কম্বল ভাড়া পাওয়া যায় এরকম তথ্য খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হয় না। আপাতত শীতের কথা থাক। কলকাতার এই গরমে বিভিন্ন বস্তিতে যারা থাকেন তারা বেশিরভাগ সময়টাই ঘরের বাইরে কাটান। কখনও তা কাজের জায়গায়, কখনও বা বস্তির গলিপথে। আজকে অন্তরীণ থাকার সময়ে সেখানে ঠিক কী ধরণের মুশকিল হতে পারে তার তালিকা না বানানোই যুক্তিগ্রাহ্য কাজ। একটা ঘরে রান্না হওয়ার সময় যদি সকলকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হয়, তাহলে দমবন্ধ হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এই জায়গাটা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁদের খুব দোষ দেওয়া যাবে না। যে রাজনীতি আমাদের দেশে চলছিল, বা যে রাজনীতি বিশ্বের বেশ কিছু তুলনায় কম উন্নত দেশে চলে, তাতে ক্ষমতায় যিনি থাকেন তিনি চলতি ব্যবস্থাটাকেই কোনক্রমে টানতে থাকেন। ভারতবর্ষ নিয়ে ককিয়ে উঠে লাভ নেই, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এরকম কয়েকটি জায়গা বাদ দিলে বাকি বিশ্বে নিম্নবিত্ত মানুষেরা খুব কষ্টেই বেঁচে থাকেন। তাদের উন্নতি করতে গেলে ঠিক যে ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা একদিনে সম্ভব নয়।

একটু অঙ্ক কষলেই বোঝা যাবে যে দেশের অত্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় সমস্ত মানুষকে একটা মোটের ওপর ভালো জায়গায় পৌঁছে দিতে অন্তত দশ বছর লাগে। সেখানে বিশ্বজোড়া অস্থির কোভিড পরিস্থিতিতে চটজলদি এই ধরণের সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব। দেশের মানুষকে কোন কাগজ না দেখালেও খাবার দিতে হবে এই দাবি উঠছে সব জায়গায়। বিপুল চাপ পড়ছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলোর ওপর। তবে দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত আছে এবং সামনের দিনে যে রকমভাবে ভালো ফসল ওঠার কথা শোনা যাচ্ছে তাতে অসহায় মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সেই জায়গাটা অবশ্যই দেশনেতাদের চিন্তাভাবনার ওপর নির্ভর করবে। ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা সামাল দেওয়াটাও খুব মুশকিলের কাজ নয়। কিন্তু অসম্ভব হল ঘিঞ্জি বসতিতে থাকা কুড়ি কোটি মানুষকে সংক্রমণমুক্ত রাখা।

‘যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন, তাঁদের জন্য সরকার হাত খুলে খরচ না করলে পথ হারাব আমরা’

অর্থাৎ কয়েকটি বিষয় একেবারে পরিষ্কার। বস্তিতে একজন মানুষও যদি কোভিড আক্রান্ত হন তাহলে গোটা জায়গায় তা ছেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি, এবং সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মিটারে বা ফুটে সেখানে হিসেব হয় না, হয় সেন্টিমিটার কিংবা ইঞ্চিতে। যে বস্তিতে কোন আক্রান্ত মানুষ নেই, সেখানকার লোকজনকে আলাদা করে রাখাটাও শক্ত। গোটা জায়গাটাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার যে তত্ত্ব সেটাও বেশিদিন চালু রাখা সম্ভব নয়। ভাবুন তো কলকাতার অতিপরিচিত কোন বস্তি বা মুম্বাইয়ের ধারাভির চারদিক দিয়ে যদি আটকে দেওয়া হয় সমস্ত মানুষকে, তাহলে ভেতরের পরিস্থিতিটা ঠিক কী হবে? শুধু খাবার দিয়ে কি সামলানো যাবে এই গোলমাল? উল্টে গোটা বিষয়টা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিলে বিপদ আরও বাড়বে।

জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সঙ্গে গত কয়েকশো বছর ধরে তৈরি করা সমস্যা কোনভাবেই কয়েকমাসে সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই বারবার মনে রাখতে হবে এইসময় রাজনীতিবিদদের একেবারেই দায়ী করে লাভ নেই। লাভ নেই তাঁদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ বাড়িয়েও। বরং মাঝের সারির নেতারা এই পরিস্থিতিতে নিজের অঞ্চল সামাল দেওয়ার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন। যেখানে সমাধান নেই, সেখানে সমাধান খোঁজার চেষ্টা না করাই ভালো। যতটুকু ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় সমস্যাগুলোকে, সেটাই সম্ভবত আশু সমাধানের অন্ধগলি।

করোনা অতিমারী: লক ডাউনের উদ্দেশ্য, প্রাপ্তি এবং উত্তরণের পথ

ইঞ্চিতে মাপা বাসস্থানে করোনা সংক্রমণ রুখতে পারে একমাত্র আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আর এই দেশের আবহাওয়ায় ভাইরাসের দুর্বলতা। যদি দুটিই সত্যি হয় তবেই সামনে আছে সামান্য আশার আলো। তার বাইরে মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব বেশি আর নাই বা ভাবলেন। এই অবসরে বরং বারান্দায় উড়ে এসে পড়া একটা সাদাফুল দেখেই সময় কাটুক। ফুলটা মাটিতে, আর উল্লম্ব হয়ে আছে সবুজ বোঁটাটা। প্রকৃতির নিয়মেই বিশ্ব স্থিতিশীলতা খোঁজে, ঝরে পড়া সাদা ফুলটার মতই। সেটুকুই ভরসা ইঞ্চিতে মাপা ঘর বাঁচাতে।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Anyo Paksha coronavirus Lockdown
Advertisment