১৮৮৬ তে প্রথম মে দিবস ধরলে ১৩৪ বছর পূর্ণ হল দিনটির। মে দিবসের এবার কোভিড জয়ন্তী। অন্তরীণ লং মার্চের গান, গলা ছেড়ে ইন্টারন্যাশনাল গাইতে গেলে দমকে দমকে শ্বাসরুদ্ধ কাশি, বুকের হাতুড়ি ওঠানামা করার ফুরসৎ নেই, লেনিনের দেড়শো বছরের চাকচিক্য ধার নেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে গেছে একেবারে। কলকাতার কয়েকটি জায়গায় শ্রমিক সংগঠনের ডাকে যে লাল পতাকা তোলা হত সেখানেও এবার ভিড় জমবে না। অল্প কয়েকজনের জনসভায় ভাষণ দেবেন না অশীতিপর বামপন্থী নেতা।
তবে একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন এবারের মে দিবস অন্যান্য বারের মত প্রতীকী নয়, বরং প্রাসঙ্গিক। আর সেই জায়গাটা অন্য মে দিবসের, শ্রমিকের অন্য অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের, এবং অন্য পথে। তার কারণ এই পরিস্থিতিতে জমায়েতের কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে অন্যান্য মে দিবসের মত শহিদ মিনারে কিংবা রেড স্কোয়ারে এবার লাখো মানুষ একসঙ্গে শ্লোগান তোলার সুযোগ নেই। গণআন্দোলনের চেনা রাস্তাটা আজকের দিনে পুরোপুরি বন্ধ। এদিকে অন্যান্য সময়ের মতই আজকের দিনেও শ্রম দিতে প্রস্তুত শ্রমিক। কিন্তু শ্রম কেনার খরিদ্দার যদি না থাকে, তাহলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর এই জায়গায় ঠিক কি করার আছে সুবিধাভোগী শ্রেণির? যাদের মধ্যে অনেকে পুঁজিবাদের আশ্রয়ে থেকেও সৎভাবে নিম্নবিত্তের কথা ভাবেন। যাঁরা কিনা নিজেরটুকু সামলে নেওয়ার পর অবশ্যই প্রার্থনা করেন যে এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সবাই দুমুঠো খেতে পাক।
অসংখ্য গবেষণায় বাড়ছে গোলযোগ
প্রথমেই এখানে উদাহরণ আসবে সারা দেশের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের। প্রধানমন্ত্রী গত জানুয়ারি থেকে মহার্ঘভাতা বৃদ্ধি স্থগিত রেখেছেন শুনেও তাঁরা কেউ টুঁ শব্দটি করেন নি। এর ফলে ঠিক কত হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার বাঁচাতে পারল সে অঙ্ক না কষেও এ প্রশ্ন তোলাই যায় যে সেই টাকা অভুক্ত মানুষের কাছে পৌঁছবে তো? আর পৌঁছলেও কবে পৌঁছবে? সেই পরিসংখ্যান ছাপা হবে সরকারের কোন আকাশপাতায়? মাঝখান থেকে পাড়ার দাদারা সেই টাকার ভাগ নিয়ে নেবেন না তো? প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে সেই একই কানাগলিতে ঢুকে পড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে উত্তর খোঁজার দায়টাকে তো এড়িয়ে গেলে চলবে না। সেই দায়টুকু সুবিধাভোগী শ্রেণিকেই নিতে হবে।
কারণ জমায়েতহীন জগতে নিম্নবিত্তদের দাবি জানানোর পথ একেবারেই বন্ধ। তাই সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সেটুকু রাজনীতি করতে হবে সরকারি কর্মচারিদেরই। যাঁরা এইসময় সবথেকে সুরক্ষিত, যাঁরা নিজেদের বেতনবৃদ্ধি চাইছেন না আজকের এই কালবেলায়, তাঁরাই তো অনেক নিশ্চিন্তে প্রশ্ন তোলার জায়গায়। যে সরকারি কর্মচারী মন দিয়ে নিজের কাজটুকু করেন, তিনি সরকারের সমালোচনা করলে ক্ষতিটা কী?
এই প্রসঙ্গেই উঠবে দেশের শুল্ক বিভাগের পঞ্চাশ জন আধিকারিকের কথা। যে পরীক্ষা পাশ করে তাঁরা চাকরি পেয়েছেন তা হল আইএএস। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় হয়ত প্রথম কয়েকজনের থেকে এক দুটো নম্বর কম পেয়ে আইআরএস (ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসেস) এর যোগ্যতা অর্জন করেছেন। অসাধারণ মেধাবী এই মানুষগুলো। সরকারকে তাঁরা আবেদন জানিয়েছিলেন যে বছরে যারা এক কোটি টাকার বেশি রোজগার করেন তাঁদের আয়কর বাড়িয়ে চল্লিশ শতাংশ করা হোক। সম্পত্তি ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ কোটির বেশি হলে আগের মতই সম্পদকর ফিরিয়ে আনায় মত দিয়েছিলেন। এছাড়াও যাদের করযোগ্য আয় বছরে দশ লাখ টাকার বেশি তাদের ক্ষেত্রে সেসের মাধ্যমে সামান্য কিছুটা আয়কর বাড়ানোর কথা বলেছিলেন তাঁরা। অন্যদিকে পুঁজির পক্ষেও রায় দিয়েছিলেন এই আধিকারিকরা। জানিয়েছিলেন যে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগকে কর ছাড় দেওয়া যেতে পারে সামনের বছরগুলিতে। তবে সম্ভবত যে বিষয়টা বন্ধুত্বপূর্ণ পুঁজিবাদের চালিকাশক্তির একেবারেই পছন্দ হয় নি তা হল এই আকালে সারা দেশের গরিব মানুষদের হাতে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়মিত পৌঁছে দেওয়ার দাবি। আধিকারিকরা ধমক খেয়েছেন আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্যে। তা হোক, সুবিধাভোগী শ্রেণির কিছুটা মে দিবস তো পালন করা হল।
ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! – কোভিড দুনিয়ার বাস্তব
এবার আসা যাক বেসরকারি ক্ষেত্রের আলোচনায়। অনেক কোম্পানিতেই মালিকপক্ষ নিজেদের বেতন কমানোর কথা বলেছেন। বলেছেন কর্মীদের বেতন না বাড়লেও কর্মী সংকোচন করা হবে না। একেবারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। পুঁজির বেড়াজালে থেকে এর থেকে বেশি কি-ই বা করতে পারেন মুনাফা গোছানো উচ্চশিক্ষিত এবং স্ফীত বেতনের বেসরকারি আধিকারিক? সেটুকুই তো মে দিবসের পাওনা।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের বহুজাতিক সংস্থাগুলো প্রচুর লাভ করে এসেছে এতদিন। তাদের না হয় কয়েকটা ত্রৈমাসিকে লভ্যাংশ ঋণাত্মক হল। মে দিবসের কথা ভেবে খাতার কোণায় কিংবা এক্সেল শিটে বাড়তি কয়েকটা লাল দাগ পড়লে ক্ষতি কি? বেসরকারি ক্ষেত্রে লাভের গুড় চটচটে করে সরকারি ঋণ। অনেক বহুজাতিক সংস্থার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে লেজে এক ডজন শূন্য লাগানো আমদানি, হাজার বা লক্ষ কোটির হিসেবে। উড়োজাহাজ কিংবা হিরে, সমরাস্ত্র অথবা আয়ুর্বেদিক ওষুধ — সরকারি ঋণ যেন ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক। যেকোন ব্যবসায় পুঁজিপতির কাজে দেয়। এর সবটা কি মালিক নেন? অবশ্যই নয়। বিমান সংস্থার মেঘবালিকারাও মাইনে পান, মাইনে পান পাইলট, আবার একেবারে কমদামি টিকিট কেটে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেন মধ্যবিত্ত।
অন্যদিকে আকাশে কার্বনের মাত্রা বাড়িয়ে যে তেল পোড়ে, তার দাম মোটেও ফেরত যায় না সরকারের ভাণ্ডারে। তারপর কোন একদিন যখন ব্যাবসা লাটে ওঠে, ততদিনে লাভের টাকার ভগ্নাংশ আর তার মালিক রপ্তানি হয়ে গেছেন। দক্ষিণপন্থার সঠিক ইংরিজিতেই তাই লোন রাইট-অফ। সে ঋণ থাকুক কি না থাকুক, আজকের কোভিড আক্রান্ত গ্রীষ্মে বেসরকারি ব্যবসা ধ্বসে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেখানে অর্থনীতি বাঁচাতে গেলে শুধু নিম্নবিত্তকে মাসে হাজার পাঁচেক দিলে সব সমস্যার সমাধান নয়। সঙ্গে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের মালিক এবং কর্মীদের জীবিকা রক্ষায় সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি। সেখানে মালিক যাতে সবটুকু নিয়ে বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল কিংবা হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং প্যাড না বানিয়ে ফেলেন, সেটুকু নজর রাখার জন্যে শ্রমিক সংগঠন লাগে। সেই সংগঠনের নেতা অনেক সময়েই মালিকের কাছে বিক্রি হয়ে যান। তবুও ট্রেড ইউনিয়ন যে প্রয়োজন, সুবিধাভোগীদের সেই বোধোদয়টুকুর মধ্যেই পালিত হোক এবারের মে দিবস।
পুঁজিবাদের কবর খুঁড়তেই যেন করোনাভাইরাসের আবির্ভাব
উপসংহারে ফিরে আসা যাক শুরুর কথায়, যেখানে শ্রম দিতে চান শ্রমিক কিংবা কৃষক। কিন্তু ক্ষেত্র অসংগঠিত। তাই করোনার কালবেলায় শ্রম বেচার সুযোগ নেই বললেই চলে। একা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কাজ করা কল মিস্তিরি থেকে লোকাল ট্রেনের ফেরিওয়ালা, এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্যে যে অর্থনীতি লাগে সেখানে বোঝাই করা বিদ্যা কম, তবে পরিকল্পনা আর রূপায়ণের দায় থাকে। সেটাই জনমুখী সরকারের কাজ। উদাহরণ অবশ্যই গোটা সমাজ নয়, তবে এক একটা ছবি তো কথা বলে।
কলকাতার রাস্তায় দুপুরের খাবারের জন্যে সব হারানোদের লম্বা সারি। খাবারের প্যাকেটের চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা শক্ত। জয়নগর থেকে আট-ন ঘণ্টা হেঁটে কেউ হয়ত কলকাতা চলে আসছেন আজকেও। কোভিডের চক্করেও মাথা না ঘুরে পথ সেই নগরমুখী। কারণ স্বাভাবিক সময়ে ট্রেনে করে এই শহরেই তো তিনি কাজ করতে আসতেন। পরপর দুদিন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থেকেছেন ভদ্রলোক, রাস্তার ধারের রেলিঙে ভর করে। এখনও কাড়াকাড়ি করে খাবার জোটাতে শেখেন নি। রাজমিস্ত্রির কাজ জানেন, ইলেকট্রিকেরও। সঙ্গের মুঠোফোনে এখনও রিচার্জ করা আছে আগামীর পারানি। কারণ গত ফেব্রুয়ারিতেও বেশ ভালোই কাজ ছিল। সেই সময়েই মোবাইলে ভরা ছিল এক বছর চালু রাখার টাকা। নেবেন নাকি ওঁর দশ অঙ্কের নম্বর? ডাকবেন মে দিবসে ফোন করে?
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন