ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, অসহায় অবস্থায় বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক - এই দৃশ্য ভারতের স্মৃতিতে দগদগে ঘায়ের মতো থেকে যাবে চিরদিন। পুরুষ, মহিলা, শিশু নির্বিশেষে ৪৪ ডিগ্রি গরমে হেঁটে চলেছেন অবিরাম, ধুলোমাখা মাঠঘাট পেরিয়ে, প্রায়শই কপালে জুটছে পুলিশের লাঠি, আবার কখনও বা ট্রাকে-টেম্পোয় গাদাগাদি করে ঠাসা, এক যুবকের কোলে মাথা দিয়ে তাঁর মরণাপন্ন বন্ধু, রাস্তার ধারেই সন্তানের জন্ম দেওয়া মা, রেললাইনের ওপর পড়ে থাকা শুকনো রুটি, ট্রেনের তলায় চাপা পড়া ছিন্নভিন্ন দেহগুলির সকলের অগোচরে সৎকার, বিশৃঙ্খল বাস বা রেল স্টেশনে পাগলের মতো ছুটোছুটি, এ সব আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছে।
যেভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টি পরিচালিত হয়েছে, তাতে নিজেকে ব্যাপকভাবে হতাশ করেছে ভারত। আমরা ভুলে গিয়েছি যে এঁরা ভিখারি নন। ভুলে গিয়েছি যে এইসব পুরুষ ও মহিলা শহরে আসেন উন্নততর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে, গ্রামে ফেলে আসা তাঁদের পরিবারের স্বার্থে। শহুরে ভারত ভেঙে দিয়েছে তাঁদের বিশ্বাস। তাঁরা 'ভিন্ন', তাই আমরা তাঁদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি একপাশে, কিন্তু 'আমাদের মতো' যাঁরা, তাঁদের পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি।
আতঙ্কগ্রস্ত রাজ্য সরকার এবং জেলা প্রশাসনের জাঁতাকলে পড়া এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে যেভাবে তাঁদের নিজেদের ভরসায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা কি স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো নয়? সারা পৃথিবীতে এই জাতীয় সামগ্রিক এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কোনও নজির নেই। প্রথমত তাঁদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় খোদ সরকার, যার ফলে তীব্র শারীরিক এবং মানসিক ক্লেশের মধ্যে পড়েন তাঁরা। তারপর বাস ও ট্রেন আদৌ পাওয়া যাচ্ছে কিনা, সে সম্পর্কে চরম বিভ্রান্তির আবহে তাঁদের বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: বিশ্বাস করুন, আর নেওয়া যাচ্ছে না!
কীভাবে কোনও সরকার ভেবে নিতে পারল যে অমন কঠিন পরিস্থিতিতে, নামমাত্র ব্যবস্থাপনায় থেকে যাবেন তাঁরা? নিজ নিজ রাজ্যে ফেরার ট্রেন এবং বাসের ব্যবস্থা করতে এতগুলি সপ্তাহ কীভাবে কেটে গেল? তাঁদের জেলার মধ্য দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছেন ক্ষুধার্ত, হা-ক্লান্ত মানুষ, তখন কেন কিছু মাইল অন্তর জলের ট্যাংকারের বন্দোবস্ত করতে পারলেন না জেলাশাসকরা? কেন বিলি করা গেল না খাবারের প্যাকেট? পায়ে জখম বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যা নিয়েও হাঁটছিলেন যাঁরা, তাঁদের কেন দেওয়া গেল না ব্যান্ডেজ বা ওষুধ? রাতে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা কেন করা গেল না স্কুলভবন, মন্দির, বা মসজিদে? বিপুল আকারের এই মানবতার ট্র্যাজেডির দায় কে নেবে?
পাকাপোক্ত পরিসংখ্যান এখনই পাওয়া না গেলেও শ্রম বাজার বিশেষজ্ঞ রবি শ্রীবাস্তবের মূল্যায়ন বলছে, যেনতেন প্রকারেণ বাড়ি ফেরার মরিয়া চেষ্টা করছেন ১ থেকে ১.২ কোটি মানুষ।
তবে পরিযায়ী শ্রমিক এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের পরিবারের দুর্দশা চরমে উঠলেও, প্রস্তুতি বিহীন, কোনোরকম নোটিশ ছাড়া দেশব্যাপী এই কঠোর লকডাউন শুধুমাত্র তাঁদেরকেই আঘাত করে নি। জনগণনার অনুমানের ভিত্তিতে, দেশে এই মুহূর্তে শ্রমিকের সংখ্যা আন্দাজ ৪৫ কোটি। এঁদের মধ্যে আন্দাজ ২০ কোটি অসংগঠিত কর্মী, যাঁরা কৃষিক্ষেত্রের বাইরে রয়েছেন, এবং লকডাউন-পরবর্তী সময়ে যাঁদের হাতে আছে না কাজ, না রোজগার, না খাদ্য। এই শ্রেণীতে রয়েছেন দিনমজুর ছাড়াও কাঠমিস্ত্রি, ফেরিওয়ালা, প্লাম্বার ইত্যাদির মতো স্বনির্ভর কর্মী। এইসব অসংগঠিত কর্মী (পরিযায়ী শ্রমিক সমেত) এবং তাঁদের পরিবার মিলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় ৬০ কোটি মানুষে।
যে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন এই সমগ্র শ্রেণী, তার প্রেক্ষিতে কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী - যাঁদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন নোবেলজয়ী - সরকারকে ক্রমাগত বলে চলেছেন যে এই সঙ্কটের সময় এঁদের প্রয়োজন বিনামূল্যে খাদ্য এবং আর্থিক সহায়তা। আমাদের মধ্যে একজনের হিসেব অনুযায়ী, এই খাদ্য এবং আর্থিক সহায়তার পরিমাণ দাঁড়াবে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র স্রেফ তিন শতাংশ।
আরও পড়ুন: বিজেপি কি অন্য ভাবনা ভাববে? নাকি গৃহযুদ্ধই শ্রেয়?
এই প্রেক্ষাপটে দেখলে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ একটি জনসংযোগ বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। শুরুতে মহা আড়ম্বর করে ঘোষণা করা হয়েছিল, জিডিপি-র ১০ শতাংশ দিচ্ছে এই প্যাকেজ। তারপর দেখা গেল, বাস্তবে এই প্যাকেজের আর্থিক অনুদান জিডিপি-র স্রেফ এক থেকে দেড় শতাংশ। বাকিটা এমএসএমই, এনবিএফসি, কৃষক, ইত্যাদির মতো কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উদ্দেশে বর্ধিত ঋণের প্রতিশ্রুতি মাত্র। এই প্রতিশ্রুতি ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাখতেও পারে, নাও রাখতে পারে। এর কোনোটাই কিন্তু হাতে নগদ টাকার সামিল নয়, যা অবিলম্বে প্রয়োজন। বিশেষভাবে হতাশ করেছে মনরেগা (MGNREGA)-র খাতে বরাদ্দ ৪০ হাজার কোটি টাকা (জিডিপি-র ০.২ শতাংশ), এবং পরিযায়ীদের দুমাসের রেশন বিনামূল্যে বিতরণ করার খাতে মাত্র ৩,৫০০ কোটি টাকা (জিডিপি-র ০.০২ শতাংশ)।
আরও অবাক করা প্রশ্ন হলো, এই প্যাকেজ ঘোষণার আগেই যে প্রকৃত বড় রকমের আর্থিক অনুদান সরকার দিয়েছিল, তার কথা কেন তারা বলছে না। প্যাকেজের আগে যে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার ঘোষণা করে সরকার, সেইসঙ্গে কেন্দ্র এবং রাজ্য বাজেটে অন্তর্নিহিত আর্থিক ঘাটতি, রাজ্যগুলিকে জিডিপি-র ২ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার অনুমতি, এবং এই প্যাকেজের ১ থেকে ১.৫ শতাংশ আর্থিক অনুদান মিলিয়ে কিন্তু বড়সড় পরিমাণ দাঁড়ায়, যা জিডিপি-র ১০ শতাংশের অনেক বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, এখানেও ত্রাণের খাতে নামমাত্র বরাদ্দ করা হয়েছে পিএম-কিষান যোজনা, MGNREGA, এবং ভর্তুকি-যুক্ত রেশনের মাধ্যমে।
কেন গরীবের সমর্থনে কিছুতেই মুঠো আলগা করছে না সরকার?
এখনও আগামী কয়েক মাসের মতো "রোজগার বিহীন" মানুষগুলোর হাতে নগদ তুলে দেওয়ার সময় পেরিয়ে যায় নি। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি চাইলেই তা নিশ্চিত করতে পারে। খাদ্যশস্যের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে হয় নি। তাছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে আরও কিছুর প্রয়োজন পড়ে। পরিশেষে, হাতে নগদ এলে বাড়বে চাহিদা, যার ফলে উপকৃত হবে অর্থনীতি।
(নাজিব জং দিল্লির প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর; সুদীপ্ত মুন্ডলে চতুর্দশ ফিনান্স কমিশনের প্রাক্তন সদস্য এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চ-এর ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো। মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন