Advertisment

সিপিএম, কংগ্রেস ও সাঁইবাড়ির ভূত

যে ছিল দূরে, সময়ের সহজ প্রয়োজনে সে এসে গিয়েছে কাছে। সিপিএম ও কংগ্রেস আজ বন্ধু। কিন্তু জলের একটু নীচে হাত ডোবালেই পাওয়া যায় রক্তের স্পর্শ। ইতিহাসের ভূত জ্যান্ত হয়ে তাড়া করতে থাকে তখন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
CPM Congress and the restive ghost of Sainbari west bengal

পঞ্চাশটা বছর পেরিয়েছে। কংগ্রেস-সিপিএমের দ্বন্দ্ব, রক্তপাতের এই অধ্যায় আবার ঘাই মেরে উঠেছে।

যে ছিল দূরে, সময়ের সহজ প্রয়োজনে সে এসে গিয়েছে কাছে। সিপিএম ও কংগ্রেস আজ বন্ধু। ভোটে একে অপরকে ছাড়া তাদের চলে না। কিন্তু জলের একটু নীচে হাত ডোবালেই পাওয়া যায় রক্তের স্পর্শ। মাঝে মধ্যে যা উপরের তলে চলে এসে বেশ অবাকই করে দেয়। ইতিহাসের ভূত জ্যান্ত হয়ে তাড়া করতে থাকে তখন। সাঁই বাড়ি হত্যাকাণ্ড। পঞ্চাশটা বছর পেরিয়েছে। কংগ্রেস-সিপিএমের দ্বন্দ্ব, রক্তপাতের এই অধ্যায় আবার ঘাই মেরে উঠেছে। প্রথমে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়া মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, তার পর সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের ফেসবুক পোস্ট থেকে সাঁইবাড়ির সেই ভূত রাজ্য রাজনীতিতে।

Advertisment

ইতিহাসের পাতায় রক্ত

১৭ মার্চ, ১৯৭০। বর্ধমানের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনের সাঁইবাড়িতে সে দিন আনন্দের ঢেউ। মেয়ে স্বর্ণলতার ছেলের অন্নপ্রাশন। চলছিল যজ্ঞানুষ্ঠান। কিন্তু সব খান খান করে হামলা। বয়ে গেল রক্তস্রোত। সে সময় রাজ্যে যে রাজনৈতিক ঢেউ ভেঙেছিল, তাতে প্রত্যক্ষ নাম লেখা ছিল না কংগ্রেসের। তবুও সাঁইবাড়িতে নিহত হলেন যাঁরা, তাঁরা কংগ্রেস করতেন। কাঠড়ায় উঠল সিপিএম। যারা সেই ঘটনার এক দিন আগে মসনদ হারিয়েছে। যদিও সাঁইবাড়ির মুখে মুখে ফেরা ইতিহাস সিপিএম মানে না। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বিরাট পোস্টে সেই না-মানার খতিয়ান। নতুন মাধ্যমে পুরনো বিবরণ। সিপিএম-কংগ্রেস দুই বন্ধুর মধ্যে ফাটলের পথ তৈরি করেছে। সাঁইবাড়ি-কাণ্ডের এক বছর পর, কংগ্রেসি গুন্ডা নব সাঁইয়ের নেতৃত্বে আল্লাদিপুরে হামলার রোমহর্ষক-কথা বিকাশের পোস্টে। সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড নিয়ে অতীতের সেই দাবিও,‘…বোমার ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সাঁইবাড়িতে হামলা চালায়। মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই ও জিতেন সাঁই মারা যান।…’

রাজনীতির গলিতে

১৯৭০-এর ১৬ মার্চ। কংগ্রেসে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলা কংগ্রেস গড়ে তোলা অজয় মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সে দিন তোলপাড়। বামপন্থীদের সঙ্গে জোট বেঁধে যুক্তফ্রন্ট তৈরি করেছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সিপিএমের সঙ্গে অ-বনিবনা উঠেছিল চরমে, তার জেরে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফার চরম সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন তিনি। অজয়বাবু সেন্ট্রাল গবর্নমেন্ট কোয়ার্টার্সে থাকতেন সে সময়। পদত্যাগপত্র হাতে করে সেখান থেকে মুখ্যসচিব এম এম বসুকে নিয়ে রওনা দিলেন রাজভবনের উদ্দেশে। গাড়িতে ওঠার পর অপেক্ষমাণ রিপোর্টারদের বললেন, ‘… লাটসাহেবের কাছে যাচ্ছি। ইস্তফা দেব। অনেক হয়েছে। আর বর্বর সরকারের চিফ মিনিস্টার নয়।’ সন্ধ্যায় রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ানের বিবৃতি তাতে সিলমোহর দিল। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের ইস্তফায় দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটল। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে প্রমোদ দাশগুপ্ত ও জ্যোতি বসু সাংবাদিক বৈঠক করলেন। বললেন ‘কংগ্রেসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মন্ত্রিসভা ভেঙে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অজয় মুখোপাধ্যায়।’ প্রতিবাদে সিপিএম রাজ্য জুড়ে হরতাল ডাকল। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, বর্ধমান শহরে এক দল কংগ্রেস কর্মী সিপিএমের পার্টি অফিসের সামনে যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের খবরে আনন্দে পটকা ফাটিয়েছিলেন। আরও কোথাও কোথাও এমন বহিঃপ্রকাশ হয়তো ঘটেছিল। এবং সরকার পড়ার পর, হরতালের প্রথম দিন, ১৭ মার্চ, শুধু সাঁইবাড়ি নয়, সারা রাজ্যেই বয়ে গিয়েছিল হিংসার ঝড়। ১৮ মার্চ যুগান্তরের হেডিং: হরতালের দিনে সারা পশ্চিমবঙ্গে দলীয় সংঘর্ষে ৩০ জন নিহত।

সাঁইবাড়িতে সে দিন

খবর বলছে: বিশাল মিছিল সাঁইবাড়ির শিবতলা লেনে ঢুকল। দেড়-দু’হাজার লোক ছিল সেই মিছিলে। অনেকেই সশস্ত্র। তখন সকাল ৮টা বাজে। এক দল ঢুকে পড়ল অন্নপ্রাশনে ব্যস্ত কংগ্রেসি হিসেবে পরিচিত সাঁইদের বাড়িতে। ঘটনাস্থলে নিহত হলেন প্রণব সাঁই, তাঁদের পারিবারিক বন্ধু জিতেন রায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ছাত্র জিতেন। ওই বাড়িতে পড়াতে যেতেন। গুরুতর আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন প্রণবের ভাই মলয়, তিনিও মারা গেলেন। গোটা ঘটনাটা ঘটে তাঁদের মা মৃগনয়না দেবীর চোখের সামনে। অভিযোগ: দুই সন্তানের রক্ত মাখা ভাত নাকি জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয় তাঁকে। যে শিশুটির অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান, তাকে যজ্ঞের আগুনে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টারও অভিযোগ ওঠে। মৃগনয়না সেই দেখে বাকরহিত, চোখ অশ্রুশূন্য। ঘটনায় অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর বড় ছেলে নব।

তাঁর কী হল?

এক বছর পর প্রত্যক্ষদর্শী নব সাঁই নিহত হলেন আহ্লাদিপুরে। হ্যাঁ, যে নব সাঁইকে কংগ্রেসি গুন্ডা বলেছেন বিকাশরঞ্জন। ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন,’এই নব সাঁই খুন হলেন রায়নার আহ্লাদিপুর গ্রামে হামলা করতে গিয়ে।’ ২০৭১-এর ১২ জুন। আহ্লাদিপুরে চার গ্রামবাসী ‘শহিদ’। লেখা সে গ্রামের ফলকে। যাঁদের স্মরণ করে সিপিএম, প্রতি বছর। সেই স্মরণ সংক্রান্ত বিকাশের পোস্টেই তো বিপত্তি। কংগ্রেস বিকাশ-বক্তব্য মানছে না। মিথ্যা ও অর্ধসত্য বলছে। বিকাশের ফেসবুক পোস্টে সেই পুরনো দাবি, ‘সাঁইরা ছিল অর্থ, ক্ষমতা ও বন্দুকের জোরে বর্ধমান জেলার অত্যাচার, সন্ত্রাস ও নৃসংশতার প্রতীক। ‘ওই মলয়-প্রণব আসছে’ গোটা বর্ধমানে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সাঁইরা। মলয় সাঁই ও প্রণব সাঁই দু’দফায় পিভি অ্যাক্টে বন্দি ছিল। বহু খুন, জখম মামলার আসামি ছিল সাঁইরা।’ কোন ইতিহাস সত্য, কোনটা অসত্য। অজানার ধোঁয়ায় ঢাকা।

তৎকালীন সদ্য-প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ও তার পর বিধানসভার স্পিকার, প্রয়াত হাসিম আবদুল হালিমের এ সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদপত্রে। সাঁইবাড়ি-কাণ্ডের ৪০ বছরে। সেই অনুযায়ী, সাঁইবাড়ি হত্যা মামলায় জনৈক দিলীপকুমার ভট্টাচার্য এফআইআর করেন। সেই এফআইআরে সিপিএমের হামলায় হত্যার অভিযোগ করা হয়। যদিও সিপিএমের নাম করা হয়নি, যে দল হরতালের ডাক দিয়েছে, তারাই এই ঘটনায় জড়িত, প্রায় এমনই বলা হয়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ১১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়।… বোমা ছোড়া হয় সাঁইবাড়ি থেকে, আহত হয় একটি কিশোর। তার বিরুদ্ধে গণরোষ তৈরি হয়, তাতেই ঘটনা।…


মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বসার পর সাঁইবাড়ি কাণ্ডে কমিশন গঠন হল। ১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কমিশন বলে: “ প্রমাণ যদি সত্যি হয়, তা হলে এই অমানিক ঘটনার নিন্দার কোনও ভাষা নেই।… যদিও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। মৃগনয়নার গায়ে রক্ত কী করে লাগল, এ নিয়ে তাঁর ও নব সাঁইয়ের বয়ানের ফারাক রয়েছে।… জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যর্থতার দায়ে কাঠগড়ায় তোলে কমিশন। চার্জশিটে প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা নিরুপম সেনের নাম ছিল। বিনয় কোঙার, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস রায় সহ একশো জনের বেশি নাম চার্জশিটে ছিল। বর্ধমানের প্রবীণ সিপিএম নেতা অমল হালদার বলছেন, ‘অভিযুক্তদের ৯৮ শতাংশই আজ মৃত।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১-তে ক্ষমতায় আসার পর সাঁইবাড়ি কাণ্ডে আরেকটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। সেই প্যানেলের রিপোর্ট এখনও দিনের আলো দেখেনি। বিজয় সাঁই, যিনি সাঁই-ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, বিচার চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত। সেই পুরনো কথা আবারও বলছেন, ‘কোনও উস্কানি ছাড়াই আমার ভাইদের উপর হামলা করা হল। জোর করে বার করে এনে খুন করা হয়। আমাদের বাড়ি এবং বাঁচার জন্য মলয় যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল, তা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ সামান্য চুপ… বিজয় যেন ফুঁসে উঠে বললেন, ‘কেউ আমাদের বিচার দেয়নি। অনেক দিন কংগ্রেস সরকার ছিল, কিচ্ছু করেনি। প্রহসন চলছে। ৫০ বছর পর কি বিচার আর পাব? আমরা সরকারের থেকে টাকা, চাকরি নিইনি। আমরা বিচারই চাই।’

যে শিশুটির অন্নপ্রাশন ছিল সে দিন, অমৃত নাম তাঁর, অমৃত যশ। তিনি এখন ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির মধ্যবয়সী লোক। পরিবারের নানা জনের থেকে সে দিনের ঘটনা শুনে আসছেন। ‘আমি শুনেছি দিদার (মৃগনয়না) দিকে রক্ত ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল।’ চোখমুখে বিস্ময়। ৫০ বছর পেরিয়েও তামাদি না-হওয়া। পরিবার বলছে, ঘটনার পর থেকে মৃগনয়না নাকি নিজের সন্তানদের ছাড়া আর কারওর সঙ্গে কথা বলতেন না। কেমন থম মেরে গিয়েছিলেন। বেরতেনও খুব কম। কয়েক বছর পর, তাঁর ব্রেন টিউমার হয়। মৃগনয়না মারা যান ১৯৭৯ সালের ১১ ডিসেম্বর।

Read in English

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

CONGRESS CPIM west bengal politics
Advertisment