'মণ্ডপে মণ্ডপে উপচে পড়ছে ভিড়। পুজোর সাজে সেজে উঠেছে তিলোত্তমা।' তৃতীয়ার সন্ধেতে টেলিভিশনে এরকম ব্রেকিং দেখলে স্বাভাবিক ভাবেই চোখ চলে যায় ক্যালেন্ডারে। কিন্তু গিয়েও লাভ নেই বিশেষ। ডিসেম্বরের পাতা ঝোলানো রয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? সময়ের আগেই সময় চলে যাওয়াই এখন ট্রেন্ড। এই যেমন পুজো পুজো একটা মেজাজ এসেছে কী আসেনি, হুড়মুড়িয়ে শহরের সব হাই ভোল্টেজ মন্ডপের থিম ঘোষণা হয়ে গেল, চোখের পলক পড়তে না পড়তেই উদ্বোধন হয়ে গেল সেসব, বোধনের বহু আগেই।
"সে এক সময় ছিল, সপ্তমীর সকালে ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙত," বলার মতো মা-মাসি-ছোটকাকা-মেজপিসিদের সঙ্গেই কিন্তু আপনার দেখা হবে দ্বিতীয়ার একডালিয়া অথবা তৃতীয়ার মহম্মদ আলি পার্কে। চতুর্থী রাতের মধ্যে এরাই চষে ফেলবেন শহরের আনাচ কানাচ। পঞ্চমী থেকে দশমী তাহলে কী করে এখন বাঙালি? পূজাবার্ষিকীর পাতায় রয়ে সয়ে একটু একটু করে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামবে? সে গুড়েও বালি। ঘোর বর্ষায় এখন বাজার ছেয়ে থাকে পুজো সংখ্যা। আচ্ছা, তাহলে তো শরতের মেঘকেও একটু আগেভাগে আসতে হয়। এইখানে একটু যা গণ্ডগোল হয়ে যায় আর কী! বর্ষায় গরম, শরতে আবার 'ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস'।
আরও পড়ুন: পুজোর বই পড়া: শারদ সাহিত্য, তোমার দিন গিয়াছে?
আস্ত এক একটা শৈশব গায়েব হয়ে চলে আসছে প্রিম্যাচিওর কৈশোর, আর সেখানে প্রিম্যাচিওর পুজো এলেই যত সমস্যা? উৎসবের মেজাজ, পুজোর গন্ধে কত কিছু ভুলে-টুলে থাকা যায়। সমাজের বুকে লেগে থাকা দগদগে ঘাগুলো কোথায় হারিয়ে যায় আলোর রোশনাইয়ের মাঝে। নিত্যনতুন অফারে ছয়লাপ আকাশ বাতাস। জামা-জুতো থেকে শুরু করে ওষুধের ওপরেও পুজো ছাড়। শহরের এক হাসপাতাল আবার পুজোয় খোলা থাকছে বলে জোর বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বলা যায় না, মহালয়া থেকে লক্ষ্মী পুজোর মধ্যে বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করলেও আপনি পেয়ে যেতে পারেন 'আকর্ষণীয় উপহার'।
ভুলে যে শুধু রাখানোর চেষ্টা হয় তাও তো না। কিছুটা ভুলতে চাই আমরা নিজেরাও। ব্যক্তিগত জীবনের সব ঝুট ঝামেলা, পেশাগত জীবনের যত চাপ, রোজ রোজ বাড়তে থাকা চাওয়া-পাওয়ার মাঝের পথটা একটু ভোলার জন্য, গতিময় জীবনে তাল মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টার পরেও প্রতিটা পা ভুল ছন্দে ফেলার হতাশাগুলো বেমালুম ভোলার জন্য বুঁদ হয়ে থাকার মতো কিছু একটা তো চাই। যে কোনো উৎসব পরব তো সাময়িক একটা মলম লাগায়। মলমের ঝাঁঝ ফুরোলে যদিও যেই কে সেই। তবু ঝাঁঝ থাকতে থাকতে একটু চোখ ভরে পেঁজা তুলো-কাশ ফুল দেখে নেওয়া। আর শিউলি ভেবে বুক ভরে বারুদের ঘ্রাণ...