বোঝা অবশ্যই 'বোঝা' বিশেষ। না বুঝলে সে 'বোঝা' কমে। তবে "মানব সভ্যতা" গোছের যে শব্দবন্ধ, তার উন্নতিতে যুক্তি এবং বোধের কিছু অবদান আছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো সবটাই সেই রাস্তায় চলে। অবশ্য কিছু কিছু ফোঁড়াকাটা বিজ্ঞানে গল্পের গরু গাছে ওঠে, আর তাই স্বাভাবিক কারণেই মাধ্যাকর্ষণের স্রষ্টা হিসেবে নিউটন-আইনস্টাইন গুলিয়ে যায়। রাইট ভাতৃদ্বয়ের আগে রাবণ উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেন, ফলে গোমূত্রে কর্কট রোগ সারতে দেরি হয় না। গুগল আর আইবিএমের তুমুল তর্কের মাঝে বৈদিক গণিতশাস্ত্রের সাহায্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়েছে বলে জনমনে সাড়া জাগানো যায়।
তবে শিক্ষিত যুক্তিবাদী মানুষ সংখ্যায় কম হলেও জানেন যে এসব গল্প বিজ্ঞানে চলে না। আবার অন্যদিকে বিজ্ঞান দিয়ে সমাজের অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা মুশকিল। যেখানেই সম্ভাবনার বিষয় এসে যায়, সেখানেই বিজ্ঞানের অসম্পূর্ণতা। তার কারণ, যে যে বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে যা যা ঘটতে চলেছে, তার সবকিছু সারিবদ্ধভাবে লিখে ফেলা অসম্ভব। বিজ্ঞান নিজেই নিজের এই অসম্পূর্ণতার কথা স্বীকার করে। তাই বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভবিষ্যতের ঠিক-ভুল বিচার করা অনেক ক্ষেত্রেই ভগবানকে খুঁজে পাওয়ার মতো। আর যে পথটা আপনি নেবেন, শুধু সেই পথের ভালো-খারাপ আপনাকে মেনে নিতে হবে। যে পথটা নেওয়া হলো না, সেখানে যে কী অপেক্ষা করে ছিল তা জানা অসম্ভব।
আরও পড়ুন, ইউরোপীয় সাংসদদের কাশ্মীর ঘোরানোর এত তাড়া কিসের?
ফলে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন, তার মধ্যেই ভুল হয়, আর বিশ্লেষণী মন হতাশ হয়ে ভাবে যে অন্য রাস্তাটাই হয়ত সঠিক ছিল। সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বিজ্ঞান হাতের কাছে থাকলে বারবার ফিরে যাওয়া যেত পেছনের কোন সময়ে, আর আবার এগোনো যেত বিকল্প রাস্তায়। ইন্দিরা গান্ধীর প্রতাপকালে সরকারকে তুষ্ট করতে যে অর্থনীতিবিদকে তিহার জেলে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন আধিকারিক, তিনি আবার ঘড়ির কাঁটা ফিরিয়ে অন্যরকম ভাবতে পারতেন।
তবে ভাবনা কমিয়ে দিলে গোটা সমস্যার সমাধান অনেক সহজ। ভাবনা যদি হ্রাস পায়, তাহলে বিকল্প কম, সরকার যে পথ নিয়েছে, আমজনতা তাতেই খুশি। তখন কানহাইয়া কুমারকে জেলে পাঠিয়ে গোটা দেশের একটা বড় অংশের মানুষের কাছে তাকে দেশদ্রোহী সাজিয়ে দেওয়া যায়। সেই হিসেবেই কোনও দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি ভাবেন কম, সেখানে সেই সময়ে শাসকদলের সুবিধে বেশি। সেখানে জনগণের ভোটেও খুব সহজে কানহাইয়াদের হারানো যায়। আর কম ভাবা কিংবা কম বোঝা যে শুধু নিজের ভেতর থেকেই আসে এমনটা নয়। সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিও মানুষের বিশ্লেষণী শক্তি কমিয়ে দেয়।
বিশ্লেষণের অধিকার এবং বাকস্বাধীনতা থাকলেই যে সবসময় ঠিকঠাক বোঝার সুযোগ থাকে, তাও নয়। নিম্নবিত্ত মানুষের বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায় বেঁচে থাকার ন্যুনতম উপাদানগুলো জোগাড় করার লড়াইতে। সেখানে সকালবেলা সংবাদপত্র চিবোনো, কিংবা সন্ধেয় টেলিভিশনের বিতর্ক গেলার সুযোগ কম। ফলে নির্বাচনের সময় তুলনায় স্বল্প প্রচেষ্টায় তাদের ভাবনা একমুখী করিয়ে দেওয়া সহজ। ক্ষমতায় থাকা সরকার হোক, কিংবা উজ্জীবিত বিরোধীপক্ষ - নিম্নবিত্তের সমর্থন আদায় তাই কম খরচায় হয়। সরল কথায় কাজ না হলে পাড়া কিংবা অঞ্চলের শক্তিশালী নেতা পাঠিয়ে ধমকে দিলেই হলো। ভোট তো একদিনের, তারপর সারা বছর সুরক্ষা দেবে কে? ফলে গরীব মানুষদের কাছের নেতার ওপর ভরসা করা ছাড়া গতি নেই।
আরও পড়ুন, রাগের আমি, রাগের তুমি, রাগ দিয়ে যায় চেনা?
ভারতের রাজনীতিতে এই চিত্র বেশ পরিষ্কার। তবু শাসক বদল হয়, তার কারণ ক্ষমতাশালীদের নিজেদের মধ্যেই গোলমাল বাঁধে। তাদেরই একটা অংশ বিরোধী রূপ নেয়। নির্বাচনে একসঙ্গে লড়াই করা দুই দল একে অপরের বিরোধিতা করে, আবার বিরোধী দুই দল তৃতীয় দলের জুজু দেখিয়ে ভোটের পর মিলিজুলি সরকার গড়ে। একই দলের মধ্যেও চলে বিভিন্ন দড়ি টানাটানি। কেন্দ্রে বিজেপি হোক, বা কংগ্রেস, রাজ্যে তৃণমূল কিংবা সিপিএম, সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই এই ধরনের উদাহরণ আছে।
অর্থাৎ প্রথমত নিম্নবিত্ত মানুষদের সমর্থন তো সহজে যোগাড় হয়েই গেল, তারপরেও ক্ষমতাশালী নেতানেত্রীরা নিজেদের সুবিধেমত আসন ভাগাভাগি করে নেন। স্বাভাবিকভাবেই অল্প বুঝলেও এই ধরনের পথ এবং মত বদলের যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া শক্ত। অবশ্য মাথায় বুদ্ধির পোকা যদি না নড়ে, তাহলে সমাজের এক বিশাল নিম্নবিত্ত জনগণকে অবান্তর অনুসিদ্ধান্তগুলো একেবারেই ভাবায় না।
মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। তাঁদের কাছে বোঝার কিছুটা সময় থাকে, এবং অবসর সময়ে তাঁরা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবেন। সেখান থেকেই শুরু হয় আলোচনা কিংবা তর্কবিতর্ক। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন চিৎকার করা থামিয়ে দেয়, তখন মহাবিপদ। বিশেষ করে আজকের দিনে সেই পরিস্থিতি খুব প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞানে আঙ্কিক প্রমাণ হয় না, তবে উদাহরণ হয়। একটি ব্যাঙ্কে কয়েক হাজার কোটি টাকার এমন গোলমাল হয়েছে যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হস্তক্ষেপে গ্রাহকেরা অল্প কিছু টাকার বেশি তুলতেই পারছেন না। সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে জানা নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাসবইতে নাকি সীলমোহর মারা হচ্ছে যে ব্যাঙ্কের দায়িত্ব এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত। তার বেশি দায় সরকার নেবে না। বিষয়গুলি অত্যন্ত অস্পষ্ট হলেও এটা পরিষ্কার যে মধ্যবিত্তদের সামনে ভীষণ বিপদ। কলকাতা শহরেই সামান্য খোঁজ নিলে যখন তখন এক লক্ষ পরিবার পাওয়া যাবে যাদের ব্যাঙ্কে দশ লক্ষের বেশি টাকা আছে। সেই টাকা তামাদি হয়ে গেলে বুদ্ধিজীবি বাঙালি পথে বসবেন।
অতএব ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত খবরে সকলে চিন্তিত, কিন্তু জোটবদ্ধ হইচই নেই। কোনও রাজনৈতিক দলও বিষয়টি নিয়ে বিশেষ ভাবছে বলে মনে হয় না। যাঁরা বেশি বুঝছেন, তাঁরাই শুধু শিউরে উঠছেন, বাকি বোধের নির্বিকল্প সমাধি। তাই বোধহয় পাঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা মহারাষ্ট্রের ভোটে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি। সমর্থন কমলেও জিতেছে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি জোট। এখন বিজেপি-শিবসেনার কিছু লোকদেখানো দরাদরি চলছে, এবং আমরা সেটা বিশ্বাস করছি। ভারতের অন্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও এমনটা হয়, আগেও হয়েছে অনেকবার। কিন্তু তাই নিয়ে আগে হইচই হয়েছে যথেষ্ট। ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কতন্ত্রের দিনগুলিতে প্রতিবাদ করে যেমন নোবেলজয়ী জেলে গেছেন, তেমনই সদ্যপ্রয়াত অরুণ জেটলিও বাদ যান নি।
আরও পড়ুন, বর্ধমানে ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর উপর হামলা: গভীর অসুখের বার্তা
বিজেপির দ্বিতীয় ইনিংসে আওয়াজটাই বেমালুম গায়েব। বিরোধীশূন্য রাজনীতিতে সেই জন্যেই বোধহয় বিজেপি কিছু অদ্ভুতুড়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আজকাল। যেমন হরিয়ানার ভোট পরবর্তী অঙ্ক। বিজেপি পেল ৪০টি আসন, জেজেপি ১০টি। বাকি দল-ভাঙ্গানিয়া বা নির্দলদের মধ্যে চটজলদি ছ'জন বিধায়ক জোগাড় করে বিজেপির সরকার গড়তে কোনও অসুবিধে ছিল না। অবাক হয়ে সবাই দেখলাম, যে জোটে জেজেপিও ঢুকে গেল। সারা দেশের অনুগত সংবাদমাধ্যম হঠাৎ করে দুষ্যন্তকে নিয়ে শুরু করল বিপুল প্রচার। নবীন নেতার বহুদিন জেলে থাকা বাবা ছাড়া পেয়ে সোজাসুজি শপথগ্রহণে। কেউ বিজেপিকে জিজ্ঞেস করল না যে, যেখানে এমনিতেই সরকার গড়া যেত, সেখানে হঠাৎ করে এত জটিলতার প্রয়োজন কী ছিল? নাকি অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রী রেখে জাঠদের খুশি করার সমীকরণ এই জেজেপি-প্রীতি?
দেশ থেকে আসা যাক আমাদের রাজ্যে। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে দারুণ ফল করার পর এনআরসি নিয়ে হুঙ্কার বাড়িয়ে দিল বিজেপি। সাদা চোখে দেখে তো মনে হচ্ছেই যে এই ধরনের বক্তব্যে বাংলার মানুষ খুব খুশি হবেন না, কারণ এনআরসি-র আওতায় পড়ে যেতে পারেন হিন্দু বাঙালিরাও। এই প্রসঙ্গে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে অনেক কথা হলেও, তার অনুসিদ্ধান্ত কী দাঁড়াবে সেই নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন আছে। সংখ্যালঘু বিশেষ একটি সম্প্রদায় অবশ্যই অনেক বেশি বিপদে পড়বে এই সমস্ত ঝামেলায়। তাদের সংখ্যা এই বাংলায় যথেষ্ট। তাহলে বিজেপি জনগণকে সন্ত্রস্ত করে ভোটে সুবিধে পাবে মনে করছে, নাকি এই রাজ্যে তৃণমূল সরকারে থাকাই তাদের পক্ষে সুবিধের মনে করে নিজেদের সমর্থনের কিছু অংশ সুকৌশলে হস্তান্তর করছে?
সেই কারণেই কি রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো নিয়েও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় (এখানে সম্প্রদায়ে ধর্ম কম, জাতপাত বেশি) মাতছে বিজেপি? বাঙালিদের অত্যধিক বিরক্ত করার মধ্যে ঠিক কী ধরনের রাজনৈতিক সুফল দল হিসেবে বিজেপি আশা করছে, সেটা একেবারেই অবোধ্য। আর সবশেষে আর একবার বুঝে নেওয়া যাক কাশ্মীরে নিহত পাঁচ বাঙালি শ্রমিক সম্পর্কে বিজেপি রাজ্যনেতার কালজয়ী উক্তি - যেখানে গুলি খাওয়া মানুষগুলোর পরিচয় শুধু বাঙালি নয়, বরং শ্রমিক।
আরও পড়ুন, দুষ্টু ছেলে এবং গরম ভোটের গল্প
তবে সবটা না বোঝার 'বোঝা' তো শুধু বিজেপির ঘাড়ে চাপালে চলবে না। নিজেদের দিকেও মাঝেমাঝে আঙুল তুলতে হয়, সজ্ঞানে কিংবা অজান্তে। তাই হ্যালোউইনের মাঝরাতে দরজায় ঠকঠক শুনে ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে দিই। ওঁরা পাঁচজন ঘরে ঢোকার অনুমতি চান। জিজ্ঞেস করেন, মুখোশ পরে আমাদের ছোটছোট ছেলেমেয়েগুলো মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় আপনাদের ভয় দেখাতে এলে তাদের হাতে বিদেশী 'ক্যান্ডি' তুলে দেবে কোন সরকারের মন্ত্রীরা? কিছুই না বোঝার ভান করে হতচকিত হয়ে বসে থাকি। সবশেষে বলি, এবার একটু ঘুমোতে দিন, কাল বিকেলেই নন্দন চত্বরে মোমবাতি মিছিলে হাঁটব। ভূত চতুর্দশীতে অব্যবহৃত সরু মোমবাতিগুলো খুঁজে বেড়াই সকাল হলে। এখানেই আমাদের বোধ বিসর্জন।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)