করোনার মোকাবিলা করতে গিয়ে দুনিয়া যখন নাজেহাল, তখনই পশ্চিমবঙ্গ আর ওড়িশায় এল কালান্তক ঝড়। আম্পান, আম্ফান বা উম্পুন… নামের সঠিক উচ্চারণ নিয়ে বঙ্গসমাজে যতই মতভেদ থাকুক, এসব আকাদেমিক তর্ক নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলার বিলাসিতা এবারে আর দেখাতে পারলেন না কেউ। সোশাল ডিস্ট্যান্সিং তার একমাত্র কারণ নয়, সুখী সোশাল মিডিয়াও এই বিষয়ে প্রায় চুপ, কারণ ঝড়টি স্তম্ভিত করে দিয়েছে সকলকেই। বর্তমান প্রজন্মের সচ্ছল শহুরে মানুষ যেসব জন্মগত অধিকারে অভ্যস্ত, সেই ইণ্টারনেট সংযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি সবকিছুই বিপর্যস্ত। রোজকার অভ্যাসমতো জলের অপচয় করতেও ভয় পাচ্ছেন নাগরিকেরা, কারণ আগামী কয়েক বছর পর যে গভীর জলসঙ্কটের সম্মুখীন আমাদের হওয়ার কথা, তার একটা আগাম আভাস বা ট্রেলার আমাদের দেখিয়ে দিল এই ঘূর্ণিঝড়।
কয়েক বছর আগে আয়লায় বিধ্বস্ত হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গ। তারপরেও মাঝেমধ্যে এসেছে বিভিন্ন ঝড়। হুড়হুড়, ফণী, বুলবুল নামের সেই ঝড়েদের পূর্বাভাস ভয় জাগালেও গতিপথ এবং শক্তিক্ষয়ের কারণে খুব বড় মাপের ক্ষতি তারা করতে পারেনি এই রাজ্যে। দুর্ভাগ্যক্রমে এবারের ঝড় ছিল অন্য পর্যায়ের। ব্যক্তিগত স্মৃতি যতদূর যায়, তার মধ্যে এত শক্তিশালী ঝড় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যদিও ১৯৯৯ সালের ওড়িশার সুপার সাইক্লোন আর ১৯৭৭ সালের অন্ধ্রপ্রদেশ সাইক্লোন সম্ভবত ছিল এর চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর, অন্তত মানুষের জীবনহানির নিরিখে, কিন্তু সেগুলো সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা নেই।
আরও পড়ুন: দেওয়ালে পিঠ, বাংলা কি ঘুরে দাঁড়াবে?
অবশ্য বায়ুর সর্বাধিক গতিবেগের বিচারে ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোন এবং ২০২০ সালের আমফান, উভয়েই ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার ছুঁয়েছে, যা অন্ধ্রের ঝড়ের চেয়ে তীব্রতায় বেশি। আমফান এই সর্বোচ্চ গতি বজায় রেখেছিল এক মিনিট (১৯৯৯-এর ঝড়ে তা ছিল তিন মিনিট) এবং সৌভাগ্যক্রমে উপকুলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সমুদ্রেই খানিক শক্তিক্ষয় হয়ে গতিবেগ কমে দাঁড়িয়েছিল ১৮০ কিলোমিটারের মধ্যে। তবু এবারের তাণ্ডব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেমন হতে পারে।
সুন্দরবন অঞ্চলের সব খবর আমরা এখনও ভালো করে জানি না, কিন্তু শহর ও শহরতলি সহ দুই ২৪ পরগণা আর পূর্ব মেদিনীপুরের যা খবর পাওয়া গেছে ইতোমধ্যে, তা করুণ এবং আতঙ্কজনক। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অভাবনীয়। আজকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাস আগের চেয়ে অনেক বেশি সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, দুর্যোগের মোকাবিলায় আগাম ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে আগের চেয়ে তৎপরভাবে। পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে এসব সম্ভব হচ্ছে। তবু সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও প্রকৃতির রোষের সামনে মানুষ আজও কত অসহায়, তা আরও একবার দেখতে পেলাম আমরা।
আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে আলোচনা করার জন্য যোগ্যতর ব্যক্তিবর্গ আছেন। আমরা ভাবিত জনস্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব নিয়ে। প্রথম ধাক্কায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে দেওয়াল বা গাছে চাপা পড়ে অথবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এরপর শুরু হবে বিভিন্ন ধরণের রোগ। যেহেতু ঝড়ের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে এবং বহু এলাকা জলমগ্ন, তাই এইসব রোগের ধরন অনেকাংশে মিলে যাবে বন্যা-পরবর্তী সময়ের অসুখের সঙ্গে। অতীতে প্লাবিত এলাকায় ত্রাণকাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ডায়েরিয়া জাতীয় পেটের রোগ, চর্মরোগ এবং ফুসফুসের সংক্রমণজনিত ব্যাধি এই সময় সবচেয়ে বেশি হয়। বিভিন্ন পোকামাকড়ের দ্বারা বাহিত রোগও বাড়বে। সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে। বিভিন্ন অঞ্চলে আরও কিছু মানুষ হয়ত বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবেন।
সুন্দরবন অঞ্চলে এমনিতেই স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করতে মানুষকে খানিক বেগ পেতে হয় ভৌগোলিক কারণে। এখন ঝড়ের ধ্বংসলীলা আর প্লাবনের পর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো খোলা রাখা এবং সেখানে পৌঁছনো, দুটোই অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, যার ফলে বিভিন্ন নিরাময়যোগ্য রোগেও কিছু মানুষের মৃত্যু হবে। ওষুধপত্রেরও সংকট দেখা দেবে। অন্যান্য রোগ, যার সঙ্গে ঝড়ের সরাসরি সম্পর্ক নেই (যেমন হৃদরোগ ইত্যাদি), তাতেও মৃত্যুর হার বাড়বে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়।
আরও পড়ুন: করোনা-যুদ্ধে আমরা যেখানে এখন
বাস্তব অভিজ্ঞতায় অবশ্য দেখেছি যে ওষুধ বা চিকিৎসার চেয়েও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বেশি প্রয়োজন খাদ্য ও আশ্রয়, অন্তত দুর্যোগের পরের প্রথম কিছুদিন। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে চিকিৎসকের ভূমিকা বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে অগণিত মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রবল সঙ্কট। সাময়িক নিরাপদ আশ্রয়, শুদ্ধ পানীয় জল, পুষ্টিকর খাদ্য এবং শুকনো কাপড় সরবরাহ করেই আপাতত বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। অতএব এটাই প্রথম কাজ। যাতে তৃষ্ণা ও ক্ষুধায় নোংরা জল বা অখাদ্য খেয়ে, জমা জলের মধ্যে সাপ, পোকামাকড়ের সঙ্গে বাস করে তাঁদের রোগগ্রস্ত হতে না হয়, সেই চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত।
তারপর চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার কাজ। এসব কথা বলা যত সহজ, কাজে করা তত সহজ নয়। এমনিতেই দুর্গম, এখন আরও দুর্গম হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলি থেকে বিপর্যস্ত মানুষকে উদ্ধার করা, নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া বেশ কঠিন কাজ। এর পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনও এক কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ হতে চলেছে।
করোনাভাইরাস অতিমারী এবং লকডাউনের আবহে এই ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় কিছু বাড়তি স্বাস্থ্য সমস্যা হবে। প্রথমত কোভিড-১৯ জনিত লকডাউন, অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা এবং মানুষের মনের ভয়ের ফলে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় কিছু সমস্যা হবে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সব কর্মীকে কাজে আনা কঠিন হবে। যেসব স্বেচ্ছাসেবীরা এরকম পরিস্থিতিতে ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদের একাংশ কোভিড-১৯ এর কারণে এবার দ্বিধান্বিত হবেন। যাঁরা আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকের রোজগার কমেছে এবং সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তহবিলে দান করেছেন বলে এখন হাতে টাকা কম।
আরও পড়ুন: করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ
ওষুধপত্র এবং অন্য বিভিন্ন জিনিসের সরবরাহ কম হওয়ায় সেসব শহরের বাজারেই অমিল। হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণে সেসব ওষুধ বা সামগ্রী সংগ্রহ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছতে বেগ পেতে হবে। অবশ্য লকডাউনের জন্য স্কুল ইত্যাদি বন্ধ থাকার সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। তাড়াহুড়ো করে স্কুল চালু করা এমনিতেই কোভিড-১৯ এর নিরিখে ভুল কাজ হতো। আপাতত সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দুই ২৪ পরগণার সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোকে পরবর্তী মাস দুয়েকের জন্য বিধ্বস্ত মানুষের আশ্রয়, ত্রাণসামগ্রী সঞ্চয় ও বণ্টনকেন্দ্র এবং ত্রাণের কাজে যাওয়া ব্যক্তিদের থাকার কাজে ব্যবহার করা যায়।
লকডাউনের কারণে ত্রাণের কাজে যেমন অসুবিধা হবে, তেমনই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে মানুষের পক্ষে নিজের ঘরে থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এর ফলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে আরও দ্রুত। এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইতেও কিছুটা পিছোলাম আমরা। বিভিন্ন জায়গায় নানারকম পরিষেবা এবং আর্থিক প্যাকেজের দাবিতে মানুষ বিনা মাস্কে দল বেঁধে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বিক্ষোভ আন্দোলনেও নেমে পড়েছেন। এর মধ্যে কিছু জনসমাবেশ অবশ্যই স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতে সংগঠিত।
ঝড় এবং কোভিড-১৯ পেরিয়ে যদি আমরা বেঁচে থাকি, তাহলে আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। কে না জানে, সাধারণ মানুষের প্রাণের চেয়ে মন্ত্রীর গদি বেশি দামি? রাজনীতি অপ্রয়োজনীয় নয়, সরকার দায়িত্ব নিয়ে কাজ না করলে দুর্যোগের আবহেও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা অবশ্যই প্রয়োজন, এবং তা সুস্থ রাজনীতি। জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে শুধুমাত্র অসুস্থ রাজনীতিটুকু তাকে তুলে রাখলেই চলবে। গদির চিন্তা সাময়িকভাবে ভুলে দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে এই দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন