Advertisment

দেওয়ালে পিঠ, বাংলা কি ঘুরে দাঁড়াবে?

আলো ফিরে এলেই মুঠোফোন চার্জ করে রাজনীতির কচকচি, কেবল ফিরে এলেই সন্ধেবেলায় কেবল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, বাংলা নিজের মতোই ঘুরে দাঁড়াবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
cyclone amphan west bengal

কাকদ্বীপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

রাজনীতি তো থাকবেই। তাই ত্রাণ নিয়ে আলোচনা চলবে প্রচুর। ঘরে আলো কিংবা জল না আসায় রাস্তায় উপড়ে পড়া গাছ টেনে এনে পথ অবরোধও জারি থাকবে। তবে গোটা পরিস্থিতিতে বাংলার যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কিছু দেশ প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উদাহরণ হেরে যাওয়া জাপান কিংবা জার্মানি, কিংবা জিতে ফেরা রাশিয়া বা ইংল্যান্ড। সবারই অবস্থা তখন তথৈবচ। সেই জায়গা থেকে ফিরতে সময় লেগেছে। তবে শেষমেশ ফিরেছে সবাই। আজ তারা প্রথম বিশ্বের দেশ।

Advertisment

অর্থাৎ একটা দেশ, বা জাতি, কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে সম্প্রদায়, অথবা ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়া কিছু মানুষ, খুব বিপর্যস্ত জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে - এরকম উদাহরণ ইতিহাসে প্রচুর। গত শতকের শুরুতে ব্রিটিশ বাহিত রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে প্লেগ, কলেরা অথবা কালাজ্বর পার করে বাঙালির রেনেসাঁকে ভুলে গেলেও চলবে না। সঙ্গে আজকের প্রেক্ষিতে মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার আগে-পরের দিনগুলিতে ওপার বাংলা থেকে এদেশে আসা মানুষদের। এ প্রসঙ্গে রাজনীতি এলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের কথায় এক আধবার ফিরতেই হবে। অন্য দেশ থেকে আসা বাঙালির পুনর্বাসনে তাঁর অবদান আজকের সাইক্লোন-বিধ্বস্ত সময়ে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক। মুশকিল হলো, তাঁর পর থেকে সম্ভবত আর কোন বিজ্ঞানের ছাত্র এ রাজ্যের নেতৃত্বে আসেন নি।

বিজ্ঞান সব নয়। তবে বিজ্ঞান বা অঙ্ক যেখানে পৌঁছে দেয়, তা হলো যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখা। সমাজবিজ্ঞান বা রাজনীতিতে যুক্তির সেই সোজা পথ নেই। বরং পুরোটাই সময়ের লেখচিত্রে অতীতকে খোঁড়া। আয়লার সময় কী বলেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী? সেই দিনের বামফ্রন্ট ঠিক কী কী করেছিল? বিজেপি তখন জনমতের কত শতাংশ? কংগ্রেসের বিধায়ক তখন পশ্চিমবঙ্গে ক'জন? সেই বছরের লোকসভা নির্বাচনে ঠিক কীভাবে জোট করেছিল তৃণমূল আর কংগ্রেস? বুঝতে হবে, এগুলো আজকের দিনে খুব জরুরি প্রশ্ন নয়।

আরও পড়ুন: মমতার ‘ধৈর্য্য’ প্রলেপেও অসন্তোষ মিটছে না নামখানা, কাকদ্বীপের দুর্গতদের

কলকাতার অনেক নামী এলাকায় আজ জল নেই, নেই বিদ্যুৎ। উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগণার লক্ষ বাড়িতে ছাদ খুঁজতে হচ্ছে। খড় উড়ে গেছে অনেক দূরে। যে চটিগুলো রাখা ছিল দরজার বাইরে, তারা কেউ দূরের পাড়ার ক্লাবে, কেউ প্রতিবেশীর বাগানে, কেউ বা ভেঙে পড়া আমগাছের ডালে। বুধবারের ঝড়ের পর আজ রবিবার। দুপুরে পেঁপে দিয়ে খাসি রাঁধার দিন। কিন্তু ট্যাঙ্কে সবে জল আসছে, কলে ঘোলা। আজকেও শহরে পাঁচ লিটারের বোতল কিনে ভাত, আলুসেদ্ধ, মাখন। ছোট বাথরুম করে জল দেওয়ার বিলাসিতা নেই। বড় সামলাতে সীমিত ডায়েট। গ্রামের দিকে অবশ্য খোলা মাঠ আর জল থইথই মজা পুকুর প্রাকৃতিক কাজকর্মের স্বাধীনতায় অনেক বেশি সাবলীল। তবে সেখানে খাবার কিংবা পানীয় জলের যোগান কম।

cyclone amphan west bengal উপড়ে যাওয়া গাছের ধ্বংসস্তুপ কলকাতা

এটাই প্রেক্ষিত, যেখানে একদিকে কোভিড আর অন্যদিকে আমফান। ঠিক কী বলছেন মুখ্যমন্ত্রী? বলছেন রেশন পৌঁছে দিতে হবে ঘরে ঘরে। বোঝাচ্ছেন জনসাধারণ একসঙ্গে রান্না করে খাওয়ার কথা, শহুরে উচ্চারণে 'কম্যুনিটি কিচেন'। সাহায্য চাইছেন সেই সমস্ত ধর্মীয় সংগঠনেরও, যাদের কাছে ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। সত্যিই তো, এমন পরিস্থিতি আগে আসে নি মোটেই। এখন তাই রাজনীতির দিন নয়। পুরোটাই একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর। তাই তো ৮০ দিনের বেশি ঘর থেকে না বেরোনো প্রধানমন্ত্রী উড়ে এসেছেন এই বাংলায়। বসিরহাটে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, সঙ্গে আরও অনেক মন্ত্রী আর আধিকারিক। সামাজিক দূরত্ব যতটুকু বজায় রাখা দরকার সেটা মেপে নিয়ে বাকিটা জনগণের জন্যে উৎসর্গীকৃত। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা সহযোগিতার, সেখানে মন্ত্রীর মুখোশ নামানো মুখের সামনে বুম হাতে সাংবাদিকদের ঘেঁষাঘেঁষিতে কোভিডের ভাইরাস পর্যন্ত চমকে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এর থেকে ভালো বিজ্ঞাপন আর কীই বা হতে পারে?

প্রাথমিক অনুদান এক হাজার কোটি টাকা, জানিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। ঘোষিত হয়েছে মৃত এবং আহতদের জন্যে আর্থিক সাহায্যের কথাও। সব মিলিয়ে সবটাই যে একেবারে অন্ধকার, এমন নয়। মমতা ব্যানার্জী ঘুরে বেড়াচ্ছেন দুর্গত অঞ্চলে, কান্তি গাঙ্গুলি নেমে পড়েছেন কাদামাটিতে বাঁধ গড়তে। পরিষেবা না পাওয়া তিতিবিরক্ত মানুষগুলোকে শান্ত থাকতে বারবার অনুরোধ করছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। অপেক্ষা শুধু আর কয়েকটা দিনের। স্বাভাবিকতা ফিরে আসবেই। তবে মূল্য তো দিতেই হবে। প্রচুর ব্যক্তিগত অসহায়তা, হয়রানি, অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যাবে স্মৃতিতে। তবু পশ্চিমবঙ্গ ছন্দে ফিরবেই, কারণ সেটাই শিখিয়েছে এতদিনের ইতিহাস।

আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মতো তীব্র গৃহযুদ্ধ, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অকারণ ধর্মযুদ্ধে সামিল হওয়ার মতো অর্বাচীন নয় এই বাংলা। দারিদ্র্য থাকবে, দুর্নীতি থাকবে, স্বার্থপরতা থাকবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সবকিছু অতিক্রম করে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাঙালির সহনশীলতা। কয়েকটা রাস্তায় অবরোধ হয়ত হবে, আইনরক্ষকদের দিকে উড়ে যাবে ঢিল, লাঠিচার্জের (যা নাকি সরকারের ভাষায় সবসময়েই 'মৃদু') ছবি ছড়িয়ে পড়বে সংবাদমাধ্যমে। তবে তারপর আবার শান্তি ফিরবেই, ফিরবেই স্বাভাবিকতা। তা হয়ত প্রথম বিশ্বের দেশের মত ঝকঝকে নয়, তবে আমাদের সঙ্গে মানানসই। অর্থাৎ এ বাংলা বাংলাতে ফিরবেই।

আরও পড়ুন: বিজেপি কি অন্য ভাবনা ভাববে? নাকি গৃহযুদ্ধই শ্রেয়?

আর সেখানেই থাকবে গিজগিজে রাজনীতি। এক কোটি মানুষ যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে প্রাথমিক এক হাজার কোটি মানে দুর্গত মানুষ পিছু মাত্র এক হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা তাই খুব আশাব্যঞ্জক নয়, ক্ষতির পরিমাণ যেখানে আনুমানিক এক লক্ষ কোটি। এখনও ঘোষিত হয় নি জাতীয় বিপর্যয়। সামনে এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন বলেই কি তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলেন প্রধানমন্ত্রী? দিল্লি থেকেই ছবি দেখে ত্রাণ ঘোষণা করলেই কি কাজ মিটত না?

আবার অন্যদিকে প্রশ্ন উঠছে, আগে থেকেই তো জানা ছিল তুমুল ঝড়ের কথা। তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি কেন সঠিকভাবে? কেন এখনও কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আলো নেই, নেই জল? কেন সেনাবাহিনীকে ডাকা হলো এতটা দেরিতে? বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ বিলিতে?

তৃতীয় পক্ষও বসে নেই। সেখানে আসছে কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয়েরই ব্যর্থতার কথা। তবে সাধারণ সংবাদমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি বড়ই সীমিত। বহুদিনের নেতা কান্তি গাঙ্গুলির নেতৃত্বে কাদা তুলে বাঁধ দেওয়ার ছবি হোয়াটসঅ্যাপে বাম সমর্থকদের মন ছুঁয়ে যাবে, তবে ভোটের শতাংশ এখনও অস্পষ্ট। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গান্ধী পরিবার দিল্লিতে জেগে উঠলেও কলকাতার কংগ্রেস সমর্থকদের বিক্ষোভে দু'অঙ্কের সংখ্যা গুনতে হচ্ছে খুব কষ্ট করে। ফলে রাজনীতির লড়াই এই আকালেও তৃণমূল আর বিজেপির। আর তাদের তরজাই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এত বিপদের মধ্যেও বাঙালির রাজনীতি ভাবনায় খামতি নেই মোটে। আলো ফিরে এলেই মুঠোফোন চার্জ করে রাজনীতির কচকচি, কেবল ফিরে এলেই সন্ধেবেলায় কেবল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, বাংলা নিজের মতোই ঘুরে দাঁড়াবে। যেমন চলছে গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

এখানেই প্রশ্ন হলো, এই বিপদের পর সত্যিই কি বাংলা একটু অন্যরকমভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্যই নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্গত মানুষের সাহায্যে। প্রধানমন্ত্রী উড়ে এসে পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন। কিন্তু এই বিপর্যয় কি দুই নেতানেত্রীর দলের মধ্যে ভেসে বেড়ানো মাঝের সারির রাজনৈতিক নেতাদের মানোন্নয়নে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে? কালোবাজারিতে হারিয়ে যাওয়া সরকারি জনধন খুব সহজে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছয় না এ রাজ্যে। সেই কথা গোটা দেশের নিরিখেও খুব আলাদা নয়। এই বিপদে প্রশাসন যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিতে পারে এবং তার রূপায়ণ যদি সফল হয়, তাহলে অবশ্যই বাংলার রাজনীতি কিছুটা বদলে যাওয়া সম্ভব।

সব হারানো মানুষের এই সময় দাবি আদায়ে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য পথ কিছু নেই। ফলে দুর্নীতিপরায়ণ পাড়ার মোড়লরা এই পরিস্থিতিতে খুব বেশি গোলমাল পাকিয়ে ফাঁকি দিতে পারবেন না। হাওয়া বুঝে তাঁরা দল বদলান। এখন বাধ্য হয়ে তাঁদের ভাবনা বদলানোর সময়। কোভিড ঝড় আরও অনেকদিন চলবে, আমফানের জেরও চলবে কয়েকদিন। এই অতিমারীতে রাজ্য গঠনে রাজনৈতিক কর্মীদের সদিচ্ছাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সেদিকে কড়া নজর রাখছে মাটির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আমজনতা, যাদের মাথার ওপর চাল নেই। ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইতে রেশনের চালটুকু তাই ভীষণ জরুরি।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

narendra modi Mamata Banerjee amphan
Advertisment