পাবনার দোহারপাড়ার বাড়িতে একই উঠোনে তিন পরিবার, শেখ বংশীয়, অনেকটাই যৌথ পরিবার, ভাই বোনের সংখ্যা (চাচাতো মিলিয়ে) দুই ডজনের বেশি, ছোটদের প্রতিযোগিতা ছিল, রোজার ঈদের চাঁদ কে দেখবে আগে। ক্ষীণকায় চাঁদ, স্থায়িত্ব বেশি নয় আকাশে, মিলিয়ে যায় দ্রুত। কে দেখেছে, কেমন দেখেছে, কতটা দেখেছে, এই নিয়ে বাকবিতন্ডা। একফালি চাঁদের রূপকথনে প্রত্যেকে প্রগলভ, ছোট বোন হাসুর কথা, ‘পুকুরের পানিতে চাঁদ দেখি নাই’, অতএব তর্ক বৃথা। আরবি কি ফারসি কি উর্দু জানিনে তখন, বলতেন ‘সিয়ামের চাঁদ’। অর্থাৎ, রোজার চাঁদ। চাঁদও নামধারী তবে! যে বছর মেঘলা আকাশ, চাঁদ দেখা অসম্ভব, মেঘে ঢাকা, পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেছে, রেডিওর বুলেটিনে রোজার শুরু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগের কথা বলছি। ‘রোজার চাঁদ দেখার কমিটি’, সরকারের কমিটি, তৎকালীন পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানেও ছিল হয়তো, যৌথ কমিটি। কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে একক। মধ্যপ্রাচ্যে মেঘটেঘের বালাই কম, দিনদুপুরেই সূর্যের আলো সত্ত্বেও চাঁদ দৃশ্যত। ইউরোপেও দেখি।
আরব দেশ-সহ মধ্যপ্রাচ্যে, ইসলামি দেশে, চাঁদ দেখার সরকারি কমিটি আছে কি না, তত্ত্বতালাশ করিনি। বাংলাদেশের সরকারি খরচে ‘চাঁদ দেখার কমিটি’ কেন এই নিয়ে প্রশ্ন ও তর্ক আছে। রোজার মাস গণনায়, শুরু কোন তারিখে, সরকারের কমিটির বয়ানে চাঁদ দেখা, না-দেখা, বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে মান্য-অমান্য ঈদের দিন নিয়েও।
একবার (বছর পঁনের আগে), রোজার দুইদিন আগে আলজেরিয়ায় গিয়েছিলুম। ইসলামিক দেশ বটে। ইউরোপিয়ান কালচার দশ ভাগ। যেমন তিউনেশিয়ায়। পশ্চিমা (ইউরোপ) হাওয়া মৃদু মন্দ নয়, জোরালো। আলজেরিয়ার কবিবন্ধু বললেন, “পরশু থেকে রোজা শুরু, রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বেড়ে যাবে, পানীয়ের দামও।” বিস্ময় মানি।
প্রশ্ন: রেস্তোরাঁ, বার খোলা থাকবে? নিষেধাজ্ঞা নেই?
উত্তর: সব নয়, অনেকগুলোই। টুরিস্টরা কোথায় যাবে? এই যেমন তুমি।
প্রশ্ন: তোমার দেশে চাঁদ দেখার সরকারি কমিটি আছে?
উত্তরের বদলে কবির জিজ্ঞাসা, ‘সেটা কি জিনিস?’
তুরস্কের ইস্তান্বুলে আরো মজার অভিজ্ঞতা, সংক্ষিপ্ত এই- আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, চাঁদ দূরঅস্ত, রোজা পরদিন, দোকানপাটে নানা পসার, বিপণিবিতান সজ্জিত, রাস্তার দুইপাশে হরেক খাবারের দোকান, ক্লাব, বার, রেস্তোরাঁ সবই খোলা, পর্যটকদের ভিড়। “কাল থেকে রোজা, চাঁদ নেই আকাশে, তাতে কি, রোজার মাস তারিখ অনুযায়ী শুরু, সমস্যা একটিই, কোপ্তা (কাবাব) ও মদের দাম নাগালছাড়া একমাস। ট্যুরিস্টদের গ্যাঁটে টান। এরদোগানের হুঁশিয়ারি, রোজার মাসে বার, ক্লাব বন্ধ রাখতে হবে। শুনছে না অনেকেই। পর্যটনে বিরাট ক্ষতি।”- তুর্কি কবি জাফর সেনচাকের বয়ান।
রোজার মাসে বহু ইসলামি দেশে (করোনা ভাইরাসের আগে) পর্যটন ব্যবসায় সমূহ ক্ষতি। মালদ্বীপ ইসলামি দেশ। পর্যটন নির্ভরশীল। রোজার মাসে আয় শূন্যের কোঠায়। কঠোর নিয়মাবলী। রেস্তোরাঁ বন্ধ। কোথায় খাবে সকালে বা দুপুরে? রিসোর্টে বন্দি। খাবারের দাম দ্বিগুণ। পর্যটন ব্যবসায়ী, রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা সরকারের হাতে পায়ে ধরেও বিফল। “আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার গরজ নেই সরকারের”, গত বছর বার্লিন আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলায় মালদ্বীপেরই একজন ট্যুরিজম অপারেটর উষ্মা মাখা কণ্ঠে জানান। বলি, রোজার মাসে (মূলত গ্রীষ্মকালীন ছুটি ছাটায়, ইউরোপ-আমেরিকার) ইসলামিক দেশে পর্যটনের ক্ষতি ছত্রিশ মিলিয়ন ডলার (বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসেব)।
হোক গে তা। বাঙালি মুসলমানের ঈদ দুইদিন। ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকায় বাস যাঁদের। বাঙালি বলতে, বাংলাদেশি মুসলমান। গাছের খাবে তলার কুড়াবে। আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপ-আমেরিকায়, সৌদির তারিখে একদিন আগে ঈদ। রোজা বা কোরবানি দুই-ই। আমাদের উপমহাদেশে পরদিন। দেশিয় কালচার। বাংলাদেশ, ভারতীয় মুসলমান সৌদির অনুশাসন মেনে একদিন আগে ঈদ করে, খানাপিনার আয়োজন, পরদিন (দেশের ঈদের তারিখ) দেশিয় পরব। বিষয়টি কৌতূহলের। অর্থাৎ, কালচার ছাড়তে নারাজ বিদেশেও।
দোষারোপ বৃথা। বিদেশে থেকেও দুই কালচার একাত্ম না হলেও প্রদর্শন। দেশীয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত, বিদেশী কালচারেও। কোনটা বাদ দিয়ে দেশি না বিদেশি? এই দেলাচলে এমনই পর্যুদস্ত দুইকেই সঙ্গী করতে বাধ্য। সমস্যা মনমননে, ধর্মীয় বোধে। মঈন চৌধুরী ‘পিটু’ নামে পরিচিত বার্লিনে, সমাজকর্মী (বাংলাদেশ উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, একদা চমৎকার রবীন্দ্র সংগীত, আধুনিক, লোকগীতির গায়ক। তাঁকে ছাড়া বার্লিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অচল) বলেন, “আমার সংস্থায় নানা দেশের উদ্বাস্তু। নানা ধর্মীয়। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়, বিশেষত আমাদের উপমহাদেশের মুসলমানের ধর্মাচার আলাদা। দিক্ষণেও ফারাক। সমস্যা নেই। আমার জন্যে আনন্দ। ঈদে দুইদিন নিমন্ত্রণ। এদেশে বাঙালির দুই দিন ঈদ। একটি এদেশিয়, আরেকটি (বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয়) পরদিন। একই ঈদ দুই দিনে। দুই রকম খাওয়া-দাওয়া। দুই রকম কালচার। উপলক্ষ ঈদ।” বললুম, “তা হলে দেশভিত্তিক ঈদ ও ঈদের ধর্মীয় কালচার।” মইন চৌধুরী ওরফে পিটু বললেন, “ঈদে বাংলাদেশিরা দুই সত্বায় জাগরুক, দেশি ও বিদেশি। স্বরূপ সন্ধানে শিকড়স্থ। দেশি না বিদেশি, দোলাচলে।”
বাঙালির দুই ঈদ, বিদেশি এবং দেশীয়, মন্দ নয় সংস্কৃতির বলয়ে। বলয় আন্তর্জাতিক। ধর্মে।
চাঁদের হেরফের। পুকুরের পানিতে চাঁদ দেখেননি হাসু, বলতেই পারেন ঈদের তারিখে গোলমাল। ঈদের আনন্দে হেরফের নেই। এই যা। হাসুর কথা, “পশুও জীব, কেন হত্যা, জীবন হত্যা, ঈদ?” প্রশ্নের উত্তর দিইনি। নির্বাক।
পাবনার দোহার পাড়ার ঈদের চাঁদ এদেশে ভিন্ন। অতীত স্মৃতি বাহুল্য।