Advertisment

মারণ নেশার নাম এখন স্মার্টফোন, কিন্তু আমি জানি, মুক্তি সম্ভব

স্কুলের শিক্ষককে নিয়মাবলি তৈরি করে ক্লাসে সেলফোন চর্চা বন্ধ করাতে হচ্ছে। সিনেমা হলে অনুরোধ করতে হয়, ফোন বন্ধ রেখে যেন দয়া করে ছবি দেখেন সকলে। অপারেশনের রোগীর পেটে সেলফোন মেলে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
mobile phone addiction

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

বছর কয়েক আগের কথা। এক সকালে আমাদের বাংলা সংবাদপত্র জগতের অনেকেই স্তব্ধ হয়ে যাই এক আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ফল সেই মৃত্যু। এক তরুণ চিত্র সাংবাদিক দক্ষিণ কলকাতার একটি অঞ্চলে কাজ করছেন। সঙ্গে তাঁর সহকর্মীরাও আছেন। কাছেই লেভেল ক্রসিংবিহীন রেললাইন। সেলফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনের ওপরে চলে যান তিনি। ঠিক তখনই লাইনে ট্রেন ঢুকছে। যেমন হয়, হুইসিলও দিচ্ছে। কিন্তু কে শোনে সেই শব্দ!

Advertisment

প্রত্যক্ষদর্শী তথা সহকর্মীরা সকলেই প্রবল চেঁচিয়ে তাকে অবহিত করার চেষ্টা করে যান। কিন্তু ওই যে কানে ফোন। ফোন তো নয়, মরণ ফাঁদ। সব কিছু একদিকে, ফোনে মগ্ন হওয়া আর একদিকে। ফলে ওই মৃত্যুর ডাকে জীবন ছেড়ে যাওয়া। ট্রেনের শব্দ, সহকর্মীদের চিৎকার, কিছুই থামাতে পারে না তাঁকে।

তখনও স্মার্টফোনের যত্রতত্র ব্যবহার শুরু হয়নি। সেলফোন তখনও শুধু বার্তা বিনিময়ের মাধ্যম। তাতেই এই হাল। স্মার্ট হওয়ার পর তাতে কত না আমোদের উপকরণ। প্রথম ও প্রধান আকর্ষণ হলো ইন্টারনেট। হাতের মুঠোয় দুনিয়া। সেই ফোন নিয়ে পাগলামি যে বাড়বে, তা তো অত্যন্ত স্বাভাবিক। আক্ষেপ, এই স্বাভাবিক পরিণতিটাই আমাদের জীবনে ডেকে আনছে চরম অস্বাভাবিকতা।

এই তো কিছুদিন আগের কথা, ছিনতাইকারীর হাত থেকে আইফোন বাঁচাতে নিজের জীবনই খুইয়ে বসলেন এক যুবক। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলেন তিনি। আচমকা এক ছিনতাইকারী তাঁর হাত থেকে ফোন নিয়ে চম্পট দিতেই যুবক তাড়া করার চেষ্টা করেন ছিনতাইকারীকে। ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে এবং প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। ফল মারাত্মক। তৎক্ষণাৎ ওই যুবক ট্রেন থেকে পড়ে যান, পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।

আরও পড়ুন: ঘরের হিংসা ঘরেই শেষ হয় না

কানে ফোন নিয়ে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা, এক বা একাধিক মানুষের মৃত্যু, ইদানীংকালের অতি চেনা ঘটনা। রাস্তায় চলতে ফিরতে ফোন কানে বা ফোন হাতে মগ্ন হয়ে লোককে ধাক্কা মেরে চলে যাওয়া, নিজে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়া বা অন্য যে কোনও বড় দুর্ঘটনা, এটাও এখন জলভাত। স্মার্ট হওয়ার পর থেকে যেন শরীরের একটা অংশই হয়ে গেছে ফোন। দিনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে, মায় বাথরুমে পর্যন্ত, ফোন এখন আমাদের কর্ম ও নর্ম সহচর। অঙ্গাঙ্গী জড়ানো এই বস্তুটি এখনকার বহু জটিল ও কঠিন রোগের উৎস জানার পরও এক মুহূর্তও এর সঙ্গ ছাড়তে অক্ষম আমরা, সেলফোন মোহ আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, পথ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ড্রাইভারদের সেলফোন কানে দিয়ে গাড়ি চালানো সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দায়ী। আর এই সংখ্যা প্রত্যেক বছর বাড়ছে। এই নিয়ে প্রচুর সতর্কতামূলক প্রচার, আইন-আদালত, ফাইন বা চোখের সামনে দেখা প্রিয়জনের মৃত্যু, কিছুই ঠেকাতে পারছে না ফোন কানে গাড়ি চালানোর প্রবণতা।

আমার নিজেরই সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা কলকাতার পথে, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করব। শহরের এদিক-ওদিক যেতে এখন ওলা-উবারই ভরসা। গত কয়েকদিনে কার্যকারণে, না হোক গোটা পনেরো রাইড নিতে হয়েছে আমায়। ড্রাইভাররা সবাই বেশ ভালো। কিন্তু ওই কানে ফোন। বললেও শোনেন না। তর্কাতর্কি করে অশান্তি বাড়াব না ভেবে চুপ করে যাই। কিন্তু এটা আমাদের, মানে যাত্রীদের, ভুল। এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কঠোর হব কী করে? গাড়িতে উঠে, ব্যাগ রেখেই তো আমিও (এটাই ট্রেন্ড) ডুবে গেছি স্মার্ট দুনিয়ায়। ফেসবুক আপডেট থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের জবাব, এইসব অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করব, না ড্রাইভারকে ফোন কানে দিয়ে গাড়ি না চালানোর বিষয়ে অবহিত করব!

গত বছরের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ডুয়ার্স বেড়াতে গেছি। বাতাবাড়ি অঞ্চলের এক রিসর্টে উঠেছি। সেখান থেকে গরুবাথান হয়ে চেল নদী দেখতে গেছি। নদী এখানে পাহাড় থেকে নেমে উপত্যকায় বহমান। খুবই সুন্দর স্পট। কিন্তু গিয়েই একটা খবর শুনে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। গতকাল সেখানে এক তরুণ দম্পতি সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকায় খেয়াল রাখতে পারেন নি, কখন তাঁদের বাচ্চা ছেলেটি নদীতে পড়ে গিয়ে ভেসে গেছে। পাহাড়ী নদী খরস্রোতা হয়। বাচ্চাটির দেহ তখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। পরে পাওয়া গিয়েছিল কিনা জানি না। বিষয় সেই সেলফোন অবসেশন, এবং সেলফির নেশা বোধহয় এর সবচেয়ে ক্ষতিকারক চ্যাপ্টার। সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনা আকছার ঘটে। তাতে মৃত্যুর শতাংশও কিছু কম নয়।

আরও পড়ুন: ‘তাতে আমার কী?’ বলার সময় শেষ

আমাদের যাপনে প্রথম যখন টিভি নামক বস্তুটি প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়ে, বলা হয়, তখন থেকেই সমাজবদ্ধ মানুষ অসামাজিক হতে শুরু করে। সেই সময় কে জানত, সেই টিভিই পরে হাতের মুঠোয় ঘুরবে? শুধু টিভি? টিভি, রেডিও, খবরের কাগজ, মিউজিক সিস্টেম, সিনেমা, তথ্যভান্ডার, আরও কত কী? আমরা যাতে বুঁদ হয়ে থাকি, তার অজস্র উপকরণ থরে থরে সাজানো ওই ছোট্ট এক যন্ত্রে। ফলে আমরা অহোরাত্র তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জগৎসংসার ভুলে স্পর্শকাতরতার (স্পর্শ অর্থাৎ ছোঁয়ার মাধ্যমেই বিশ্বদর্শন, বিশ্বের যাবতীয় কর্ম) চূড়ান্ত নিদর্শন রাখব, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?

নাহ, অবাক আমরা হচ্ছি না। আমরা দাস হয়ে পড়েছি। আমরা যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা হারাচ্ছি। ছেলেমেয়েকে স্মার্টফোনের সর্বনাশা নেশা ছাড়ানোর উপদেশ দিয়েই নিজেরা ডুবে যাচ্ছি ফোনে। স্কুলের শিক্ষককে নিয়মাবলি তৈরি করে ক্লাসে সেলফোন চর্চা বন্ধ করাতে হচ্ছে। সিনেমা হলে অনুরোধ করতে হয়, ফোন বন্ধ রেখে যেন দয়া করে ছবি দেখেন সকলে। অপারেশনের রোগীর পেটে সেলফোন মেলে। আর কত বলব?

আজকাল প্রাইভেট টিউটররা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নোট দেন। ছাত্রছাত্রীরা নোট নেওয়ার জন্য অনলাইন হতে বাধ্য (এটা ধরে নিচ্ছি জরুরি ভিত্তি)। অনলাইন হব আর একবার ফেসবুক চেক করব না? ওদের দোষ দেব কী, আমরা বড়রাও অহরহ এটা করি। অর্থাৎ, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই স্মার্টফোনের কব্জায়। এ কোন ভয়ানক পরাধীনতার নাগপাশ, যার হাত থেকে কিছুতেই মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না!

কিন্তু মুক্তি সম্ভব। এ প্রসঙ্গে সামান্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেব। নিছক তথ্য জানানো নয়। আত্মবিশ্লেষণও বটে। কলকাতা ছেড়ে উত্তরবঙ্গের একেবারে প্রান্তিক এক গ্রাম চুইখিমে যখন পাকাপাকি ভাবে থাকতে যাই, তখন সেখানে কোনও সেলফোন নেটওয়ার্ক ছিল না। আজও নেই। থাকা শুরু করার আগের আমি প্রবলভাবে স্মার্টফোনে অভ্যস্ত। ভাবতেই পারি না খুব বেশিদিন নেটদুনিয়ার বাইরে থাকব। আশা, খুব শিগগিরই চুইখিমের পরিস্থিতি বদলাবে এবং মোবাইল টাওয়ার বসবে।

আরও পড়ুন: গরুর কুঁজে সোনা, কুকুর খাও, কেন বলেন দিলীপ ঘোষ?

আমার আশা ব্যর্থ হলো। টাওয়ার বসল না। প্রথম প্রথম পাগল পাগল অবস্থা। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেল। যোগাযোগবিহীন অবস্থায় বেঁচে থাকাটা দিব্যি শিখে গেলাম। প্রায় ৮/৯ মাস এভাবেই কেটে যাওয়ার পর কার্যকারণে শিলিগুড়িতে বসবাস শুরু। কী খারাপ ব্যাপার! যে আমি দিব্যি স্মার্টফোনের (ইন্টারনেট ব্যবস্থা) ব্যবহার দূর, বার্তা বিনিময়টুকুও করতে পারছিলাম না, সেই আমিই আবার সেলফোন-দাসে পরিণত হলাম। একটাই ভালো, প্রায় প্রতিমাসেই চুইখিম যেতে হয় এবং ফোন-জালের বাইরে থাকাটাও ঘটে। এর ফলে কিছুটা হলেও দাসত্ব থেকে মুক্তি। অর্থাৎ মুক্ত হওয়া সম্ভব।

কোনটা কাজের আর কোনটা নিছক বিনোদনের বা কৰ্মহীন সময় কাটানো, সেটা নিজেকেই ঠিক করতে হবে। যতক্ষণ ফোনযন্ত্রটি আপনার নিয়ন্ত্রণে, ততক্ষণ ঠিক আছে। উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা তো নিজের সামগ্রিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্যই। বিনোদনও থাকুক তার জায়গায়। কিন্তু মানুষ যদি এক যন্ত্রের কারণে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ভুল অভ্যাসের দাস হয়ে যান, সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তাহলে তো সমাজটাই আর থাকবে না। পাড়া-প্রতিবেশী দূর, ঘরের মানুষও একে অপরের কাছে অপরিচিত হয়ে পড়বেন। অতএব এই নেশার হাত থেকে মুক্তি পেতেই হবে! জীবনের শান্তি, সুস্থিতি, সুস্থতা বজায় রাখতে, সর্বোপরি জীবন রক্ষায়, এই নেশা ছাড়তেই হবে আজ না হোক কাল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

Advertisment