মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙ্গে পড়াটা অনেক দিক থেকে আলাদা। এতদিন যে-সমস্ত ফ্লাইওভার শহরটার ভেতরে নতুন সংযোগ পথ খুলে দিচ্ছিল সেগুলো পুরনো ভাষায় ওভারব্রিজের মত দেখতে হলেও, উন্নয়নের ভাষায় তাদের বলা হয় ফ্লাইওভার।
ওভারব্রিজ বা ফ্লাইওভার বলতে বোঝায় শহরের পুরনো সংযোগ পথ দিয়ে আর কাজ চলছে না, তাই একটা বিকল্প পথ খোলা হল, প্রথমত ও প্রধানত গাড়ির জন্য। তাতে পথের যানসংকট কিছু কমবে। কিন্তু পুরনো পথগুলো তো থাকবেই।
মাঝেরহাট ব্রিজ কিন্তু এমন বাড়তি কিছু নয়। মাঝেরহাট ব্রিজ কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমের সঙ্গে সংযোগের একমাত্র পথ। রেললাইনকে একটা বিকল্প সংযোগ ধরে নেয়ায় এখানে ফ্লাইওভারের কথা ওঠে নি। ফ্লাইওভারের হলে যে সেটাও ভাঙত না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১১)
ব্রিজটা ভেঙে পড়ার পর তো কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, দমকল, বিপর্যয় ইউনিট, পুলিশ, বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর দুটি অংশ তাদের নিজের-নিজের কাজে লেগে পড়েছেন যথা-সময়। দার্জিলিঙে আটকা পড়ে সেখান থেকেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনকে যথাযথ নির্দেশ দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ দু-বার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। রাজ্যপাল সবচেয়ে আগে গিয়েছেন। আমার অন্তত দেখে ও খবর পড়ে ও টিভি চ্যানেলের অন্তর্তদন্ত দেখে-পড়ে মনে হয় নি; কোথাও কারো দোষ হয়েছে।
কিন্তু দুর্ঘটনার প্রথম থেকেই নানা রকম পদাধিকারীরা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক, অপ্রস্তুত এই প্রসঙ্গটা সামনে নিয়ে এলেন – দায়িত্ব কি রেলের না রাজ্য পূর্ত বিভাগের। এই প্রশ্ন একবার উঠলে স্বাভাবিক গতিতেই রেল বলবে দায়িত্ব তার নয়, রাজ্যের পূর্ত বিভাগের। আর পূর্ত বিভাগ বলবে, দায়িত্ব রেলের, পূর্ত বিভাগের নয়।
আমাদের টিভি সাংবাদিকতা যেমন অনেক খবর দেয় ও অনেক সত্য সবাইকে জানায়, তেমনি একটা প্রবণতা বেশ ক্ষতিকারক। যে-সংবাদই হোক, তা নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি করে তোলা।
মাঝেরহাট ব্রিজের ভেঙে-পড়া নিয়েও তাই হল।
কেন্দ্র বনাম রাজ্য সম্পর্ককে এর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হল। রাজ্যের পক্ষ থেকে বলা হল – মেট্রোরেলের পাইলিঙের দীর্ঘস্থায়ী চাপে ব্রিজের স্তম্ভে ফাটল দেখা দিয়েছে। এর পাল্টা মেট্রো রেল কতৃপক্ষের পক্ষে কেউ বিশেষক পরিহাসে বললেন বেশ নিশ্চিত জ্ঞানে যে পাইলিং কবে হয়ে গেছে আর পাইলিঙের জন্য ব্রিজে ফাটল হয় – এমন কথা বিস্ময়কর।
১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কটি অর্ধচন্দ্রাকারে ব্রিজের পাশ দিয়ে গেছে বলেই, রেল বনাম রাজ্য পূর্ত বিভাগ, তথা কেন্দ্র বনাম রাজ্য ও প্রাদেশিক স্তরেও সরকার পক্ষ বনাম বিরোধী পক্ষ তরজা একটা ভিৎ পেয়েছে।
এমন বিতর্ক আমাদের রাজনীতিকে একেবারে গ্রাম্য স্তরে নামিয়ে এনেছে। ব্রিজ ভাঙবে কেন? ব্রিজের ঠিকমত দেখাশোনা না হলেই ভাঙবে। সাংবাদিকরা তো এই খবর বের করেছেন- কলকাতার ও আশেপাশের কোনো ব্রিজেরই কোনো দেখাশোনা হয় না ও ২০ টি ব্রিজ এমন অবস্থায় আছে – যে সেই ব্রিজগুলি ব্যবহার্য নয়।
কাকে বলে ব্রিজের দেখাশোনা?
সারা ভারত জুড়ে রেলের নানা আকারের অন্তত লাখ খানেক বা তার বেশি নানা শ্রেণীর ব্রিজ আছে – কালভার্ট, রেলিং দেয়া কালভার্ট, ত্রিভূজের মত করে দু-দিকে ওপরে ওঠা ছোট ব্রিজ, মাঝারি ব্রিজ ও বড় ব্রিজ। রেলের সংজ্ঞা অনুযায়ী যেখানে রেললাইন মাটি ছেড়ে শূন্যতায় আছে, সেটাই ব্রিজ।
রেলের একটা বিভাগই আছে, ডিভিশন বা তারও নিচু স্তর পর্যন্ত। তাদের কাজ হল – এমন ছোট থেকে বড় সব ব্রিজের রুটিন চেকিং। ট্রলিতে করে। ব্রিজের প্রতিটি স্ক্রু দেখা ও দরকারে বদলে দেয়া। তেমন কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগের সময় সেই এলাকার রেল ব্রিজগুলিতে এই ব্রিজ-বিভাগকে ক্যাম্প করে ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টা ডিউটি দিতে হয়। হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিভাগের মত।
আমাদের পূর্ত বিভাগের তেমন কোনো বিভাগ আছে বলে আমি জানি না। কোনো রকম মেরামতি বা পরীক্ষা করা হয় বলে কল্পনাও করতে পারি না। প্রায় সমতুল্য একটি দুর্ঘটনার সময় আমি কাগজে স্বনামে লিখেছিলাম – কলকাতার প্রতিটি জেটি ও প্রতিটি ব্রিজকে পরীক্ষা করা হোক ও তারপর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হোক।
রাজ্য সরকার বিশ চাকা ওয়ালা ট্রাকের ওপর যে নিষেধ জারি করেছেন তা যথোচিত ও পুলিশকে দায়িত্ব নিয়ে তা পালন করতেই হবে। এমন প্রত্যেক ব্রিজের দুই মাথায় অবিলম্বে ভারী লোহার বিম লাগানো দরকার যাতে ঐ ভারী ট্রাক ঢুকতেই না পারে। নতুন রাস্তা বের করার সিদ্ধান্তও যথোচিত।
আমার ভয় – উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়ে। উচ্চ পর্যায় মানে তো পদাধিকারীর উচ্চতা। সেটাই সন্দেহের। তাঁরা তো নিজেদের পদের নিরাপত্তা দেখবেন, ব্রিজের নিরাপত্তা দেখবেন কেন? রাজ্য সরকার কি ইয়োরোপ বা চিন থেকে বা ইন্দোনেশিয়া থেকে পেশাদার পরামর্শদাতা এনে তাঁদের মত নিতে পারেন না? এই তিনটি জায়গাতেই তেমন পেশাদার বিশেষজ্ঞরা এমন নানা ধরনের ব্রিজ তৈরি করেছেন ও তার রক্ষণাবেক্ষণও করেছেন।
সব ব্রিজই ভাঙছে মাঝখানে।
তার একটা সহজ কারণ মাথায় আসে। ব্রিজের দুই দিকেই মাটির তলদেশ যদ্দূর পর্যন্ত ওজন বয়েছে তদ্দূর পর্যন্ত ব্রিজগুলো টিঁকে থাকছে। মধ্য অঞ্চলের নির্ভরতা নেই।