হিন্দুত্ব ভারতবর্ষে এত প্রাচীন, বিস্তৃত, বহুমুখী, সভ্যতাগত বিষয় যে তার হকদারি বা দায় দায়িত্ব বিজেপি বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং যেসব সঙ্ঘ বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা হিন্দু মহাসভা বা রামমন্দির কমিটি বা বজরঙ্গ দল এমন সব রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না।
ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে পরম নাস্তিক কোনো গবেষককেও হিন্দুত্বতের ধারণা, ঠিক হিন্দুত্বেরই নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদের ও বর্ণভেদী সমাজের, বিকাশ সম্পর্কে গবেষণা করতে হলে তাকে এই ধর্মীয় ধারণা, সেই ধারণার সংগতিপূর্ণ শাস্ত্র বা পুরাণ সম্পর্কে আলোচনা করতেই হবে।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৪)
এমন তিনজন গবেষকের নাম মনে পড়ছে দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী, রামবিলাস শর্মা, দেবীপ্রসাদ চট্যোপাধ্যায়। অরবিন্দকেও আমি এঁদের মধ্যে ধরতে চাই কিন্তু তাঁকে এমন সাম্প্রদায়িক ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলা হয়েছে যে তাঁর মননজাত গবেষনা স্বতন্ত্র প্রাধান্য পায় না। আরো একজন আদি ভারতত্ত্ববিদের নামও এই প্রসঙ্গে করে রাখতে চাই– হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিকাগোয় স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক ভাষণের ১২৫ বৎসর পূর্তির অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ প্রত্যাহার সম্পর্কে ১১ সেপ্টেম্বর তিনি নামোল্লেখ না করে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন – এর পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস স্পষ্ট করেই বলেছে – বিজেপি- আর এস-এসই তাঁর যে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ ছিল, সেই অনুষ্ঠানই বাতিলের ব্যবস্থা করে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে- ইঙ্গিত দিয়েছেন ও তৃণমূল কংগ্রেস যে বিবৃতি দিয়েছে তা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে সত্য মনে হয়।
এখন সাজালে ঘটনাটা এ-রকম দাঁড়ায়। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় – ২৬ আগাস্ট স্বামীজির শিকাগো ভাষণের ১২৫ বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান হবে – মুখ্যমন্ত্রী এলে ওঁরা খুশি হবেন। মুখ্যমন্ত্রী সন্মত হন। তারপরে কোনো এক সময়ে তাঁকে জানানো হয় –অনুষ্ঠানটি বাতিল হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী শিকাগো যাবেন – এমন খবরে কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেল তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দেন ও এমন কথাও বলেন যে মুখ্যমন্ত্রী যে উপলক্ষে শিকাগো যাচ্ছেন তার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বাণিজ্যিক কথাবার্তাও হতে পারে।
স্বামীজির শিকাগো- ভাষণের ১২৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অনাবাসী ভারতীয়দের একটি সংগঠন – যাঁরা বিজেপি-সঙ্ঘের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাঁরা মাঠে নেমে পড়েন। তাঁরা পরিষ্কার চাইছিলেন – বিজেপি-সঙ্ঘ যে হিন্দুত্ব প্রচার করে রাজনীতি করছে ভারতে, বিবেকানন্দকে সেই হিন্দুত্বের সঙ্ঘে যুক্ত করে হিন্দুত্বকে কাজে লাগাতে। রামকৃষ্ণ মিশন ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে তা করা সম্ভব হবে না। সেই কারণে অনুষ্ঠানটিই বাতিল করা হল।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশ মন্ত্রক উপযাচক হয়ে একটি বিবৃতি দিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমেরিকা-সফর সম্পর্কে কোনো আবেদন তাঁরা পানই নি, সুতরাং বিদেশ মন্ত্রক তাঁকে অনুমতি দেয় নি, এই অভিযোগ অসত্য।
কেউ তো বলেনই নি- বিদেশ মন্ত্রক অনুমতি দেন নি। মুখ্যমন্ত্রী ১১ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতায় কারো নাম বলেন নি। শুধু বলেছেন, আমন্ত্রণ করে আমন্ত্রণ প্রত্যাহারের ঘটনা অস্বাভাবিক। তাঁর সন্দেহ কোনো ষড়যন্ত্র আছে এর পেছনে।
এই কথার প্রতিক্রিয়ায় বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতি তো ‘ঠাকুর ঘরে কে/আমি তো কলা খাই নি’ প্রবাদ মনে করিয়ে দেয়।
তৃণমুল কংগ্রেস ১৩ সেপ্টেম্বরের বিবৃতি তাই প্রাসঙ্গিক।
বিজেপি-সঙ্ঘ তাঁদের যে- রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে ভারতের রাজনীতির প্রধান শক্তি করে তুলতে চাইছেন, তার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো সমন্ধ থাকা উচিত নয়। শিকাগো-ভাষণের ১২৫ বর্ষ উপলক্ষে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত কোনো একটি সভার ছবিতে কিছু গেরুয়া-পরা সন্যাসীকে দেখা গেল। তাঁদের দেখে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্যাসীদের মতই দেখায়। এমন হতেই পারে- রামকৃষ্ণ মিশনের আমেরিকার শাখা সেই সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ও সৌজন্যবশত হয়তো তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের একটি ট্রাস্ট ডিড আছে। তার প্রথম ধারাতেই উল্লিখিত আছে, মিশন কোনো রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর দশ দিন যেতে না যেতেই নিবেদিতাকে মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলা হয়। নিবেদিতা মিশনকে অস্বস্তি থেকে বাঁচাতে নিজেই বিবৃতি দিলেন যে এর পর থেকে তাঁর কাজকর্মের সঙ্গে মিশনের কাজকর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
বিবেকানন্দের সঙ্গেও নিবেদিতার মতপার্থক্য ঘটেছিল। বিবেকানন্দ মনে করতেন ‘জাতিগঠন’ না করে স্বাধীনতা আন্দোলন সম্ভব নয়। নিবেদিতা মনে করতেন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া জাতিগঠন সম্ভব নয়। একবার তো বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে তাঁর দেশে ফিরে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও অধিকার সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। বহু ব্যাপ্ত তাঁদের শাখাগুলি কতটা স্বাধীন ও কতটাই-বা তাঁদের ভ্যাটিক্যান বেলুড়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাও জানি না। একবার যেন সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের আবেদন মঞ্জুর হয়েছিল যে তাঁরা ‘সংখ্যালঘু সংগঠন’ ও সেই কারণে ‘সংখ্যালঘু’দের প্রাপ্য সুবিধে তাঁরা ভোগ করতে পারবেন। লাডলী মোহন রায় চৌধুরীর একটি মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থে বিবরণ আছে যে অনেক বিপ্লবী রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী হয়ে বিপ্লবের কাজ করছেন।
আমাদের এখন খুবই দুঃসময়। ভারতের ‘হিন্দুত্ব’কে একটামাত্র আচরণকেন্দ্রিক বাধ্যতায় পরিণত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বিজেপিসংঘ।
‘হিন্দুত্ব’ ভারতের পক্ষে এমন ঐতিহাসিক সংখ্যাগুরুত্ব সত্ত্বেও এত বিবিধ যে রামকৃষ্ণ মিশনের অবশ্য কর্তব্য তাঁরা ‘হিন্দুত্ব’ বলতে কী বিশ্বাস করেন, তা প্রকাশ্যে জানানো।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে বিজেপি-সংঘের কাছ থেকে হিন্দুত্ব শিখবেন না এবং বিজেপি সংঘকেও হিন্দুত্বের আচরণবিধি নির্দেশের অধিকার দেবেন না।