Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ৯)

কোনো এক প্রধানমন্ত্রী আসামের কোনো এক রাজনৈতিক দল বা সরকারের সঙ্গে কোনো ‘চুক্তি’ সম্পাদন করলে ও সুপ্রিম কোর্ট সেই চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে নাগরিকপঞ্জি তৈরির নির্দেশ দিলে ও তত্ত্বাবধান করলেও সেই পুরো পদ্ধতিই অসাংবিধানিক হতে পারে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

(আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যাঁরা তাড়িত, এবং পদ্ধতিগত, সংস্কৃতিগত, ঐতিহ্যগত, রাজনীতিগতভাবে যাঁরা এর বিরোধিতা করে আসছেন, তাঁদের অন্যতম দেবেশ রায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় তাঁর ধারাবাহিক কলামে, এবারও এন আর সি নিয়েই লিখলেন তিনি।)

Advertisment

আসামের নাগরিকপঞ্জি তৈরির শিষ্টতা, ঔচিত্য, ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কিছুটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা নিয়েও। এমন প্রতিপাদনে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে চিনদেশের কোন এক আক্রমণকারী প্রথম না কি আসাম দখল করেন। কোনো-কোনো চিন্তাশীল লেখক আসাম ও বাংলার সহযোগিতার সম্পর্কের ইতিহাসও মনে করিয়ে দিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে, দিনে-দিনে আরো মনে হচ্ছে- এই যুক্তিগুলি একেবারেই কাজে আসবে না। জাতীয় রাজনৈতিক দল যে-কটি আছে - তাদের একটিও অদ্ব্যর্থক ভাষায় জাতি-পরিচ্ছন্নতার এই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার নিন্দে করেননি। একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ভাষায় একে ‘গৃহযুদ্ধ’-এর পরিস্থিতি বলেছেন। আর সেটাই সত্য, একমাত্র সত্য। সেই সত্য থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে অনেক রাজনৈতিক পার্টিই মমতার নিন্দে করেছেন এই বলে যে এমন কথার ফলে- আসামে উত্তেজনা বাড়বে।

অর্থাৎ উত্তেজনা তৈরি করা ও বাড়ানো যেন একমাত্র আসামের সরকার ও রাজনৈতিক দলের অধিকার। আসামের সব রাজনৈতিক দলের একদা মুখ্যমন্ত্রীরা দাবি করেছেন যে তিনিই প্রথম নাগরিকপঞ্জির কথা তোলেন ও সেটাকে কার্যকর করেন। আমিই প্রথম করেছি, এমন আত্মগৌরবগাথার কলরোলে নাগরিকপঞ্জি থেকে আসামের এক মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী তৈমুর-এর নামই বাদ পড়ে গেছে।

এতে দুটি কথা বোঝা যায়। ১. নাগরিকপঞ্জি তৈরি হয়েছে যথাযোগ্য সাবধানতা, সতর্কতা ও শুদ্ধতাপরীক্ষা ছাড়াই। ২. আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নাগরিক সমাজ এই পঞ্জি চান ও এই পঞ্জি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আন্দোলনে সমবেত হবেন। তাঁদের একটা সহজ , সরল ও আপাতমান্য যুক্তি আছে - ভারতের সব রাজ্য যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে সেখানকার প্রধান ভাষায় পরিচালিত হতে পারে, আসামেও তা হবে না কেন?

আমরা দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।

ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও কিন্তু এমন সরকার অনেকবার হয়েছে ও এখনো আছে যে সরকার প্রধানতম কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত নয়। পাঞ্জাবে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ, হরিয়ানায় জাঠ ও ক্ষত্রি, উত্তরপ্রদেশে ব্রাহ্মণ ও দলিত, মধ্য়প্রদেশে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ, তামিলনাড়তে ব্রাহ্মণ ও দলিত জনগোষ্ঠী থেকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন হয়েছে অনেকবার। এর বিরুদ্ধে কেউ যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলতে পারেন যে এঁরা তো হিন্দুজনজাতিরই এক-একটি অংশ। সে-যুক্তি যুক্তি মনে হতে পারে বিজেপির কাছে। কিন্তু সে-যুক্তি আমাদের সংবিধানসম্মত নয়। ‘সংবিধান’-এর প্রথম বাক্যেই বলা হয়েছে, ‘আমরা ভারতীয়রা...।’

সংবিধানের এই আত্মপরিচয় যে আমাদের নাগরিকপঞ্জির প্রবর্তয়িতা (সুপ্রিম কোর্ট) বা পরিচালক (সুপ্রিম কোর্ট) খেয়াল করেনি, তা নয়। তাই নাম দিয়েছে নাগরিকপঞ্জি। অর্থাৎ সংবিধানে আমাদের যে আত্মপরিচয় স্পষ্ট ও অদ্ব্যর্থকভাবে দেওয়া হয়েছে, তাকে পাশ কাটিয়ে, একটি রাজ্যের, একটি প্রধান জনগোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী ও তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য অনহোম জনগোষ্ঠীগুলিকে ভারতের নাগরিক নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানকে লঙ্ঘনের কোনো কৌশল বা পদ্ধতিও সংবিধান লঙ্ঘনের মতই স্পষ্ট অপরাধ। আসামের নাগরিকপঞ্জি তেমনই একটি অপরাধ। কোনো এক প্রধানমন্ত্রী আসামের কোনো এক রাজনৈতিক দল বা সরকারের সঙ্গে কোনো ‘চুক্তি’ সম্পাদন করলে ও সুপ্রিম কোর্ট সেই চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে নাগরিকপঞ্জি তৈরির নির্দেশ দিলে ও তত্ত্বাবধান করলেও সেই পুরো পদ্ধতিই অসাংবিধানিক হতে পারে। ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে আমরা একটি বাংলা দৈনিকে লিখেছিলাম - ‘কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার তার কোনো অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে না।’ সেই ১৯৮৫-তেই লিখেছিলাম। তখন ও এখনো আমাদের যুক্তি রাজ্য বা প্রদেশ এক অস্থায়ী প্রশাসনিক ভূখণ্ড, যা কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি আইনে গঠিত হয়। সেই প্রশাসনিক ভূখণ্ড আবার একই পদ্ধতিতে বদলে যেতে পারে।

পুরনো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, এখনকার উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, আসামের সীমা কতবার বদলেছে। কত নতুন প্রদেশ তৈরি হয়েছে- অন্ধ্রপ্রেদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা, ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, মেঘালয়, অরুণাচল।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ৮)

আসামের গোয়ালপাড়া জিলা ছিল বাংলার অংশ। সেই গোয়ালপাড়া জিলার অন্তর্গত ছিল ডুয়ার্স অঞ্চল। রাজবংশী ভাষাকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চিহ্নিত করেছিলেন পশ্চিম গোয়ালপাড়া উপভাষা হিশেবে। কেন পশ্চিম? কারণ, পূর্ব গোয়ালপাড়াতে অহোম ভাষা প্রভাবিত উপভাষার ভিন্নতা তিনি লক্ষ করেছিলেন। গোয়ালপাড়া জিলা বাংলার অন্তর্গত, সুতরাং ডুয়ার্সও সামগ্রিকভাবে বাংলার। এখনো জলপাইগুড়ির অনেক চা বাগান সেই অতীত পরিচয়েই চলছে- বেঙ্গলডুয়ার্স টি  কোম্পানি, ইস্টার্ন ডুয়ার্স টি কোম্পানি, মোগলকাটা টি কোম্পানি, খাগড়াগুড়ি টি কোম্পানি।

পরে, গোয়ালপাড়া জিলা পুরোটাই আসামের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ডুয়ার্সও কার্যত দুভাগ হয়ে গেল - ইস্টার্ন ডুয়ার্স মানে আসাম আর ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স মানে জলপাইগুড়ি।

চা-শিল্প তৈরি হয়েছিল আসামে। পরে, কালক্রমে দার্জিলিঙে, তরাইয়ে ও ডুয়ার্সে। এই শিল্পবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি উপজাতি নারীপুরুষ, ছোটনাগপুর থেকে আসা সাঁওতাল, ওঁরাওঁ, কোল, মুণ্ডা জলপাইগুড়ি-আসামের জনবিন্যাস গুণগতভাবে বদলে দিল। সেই শ্রমিক-আমদানির ইতিহাস, পৃথিবীর অন্য়ত্র শ্রমিক-আমদানির ইতিহাসের মতই বীভৎস। আবার, শিল্পবিপ্লবের ইতিহাসের অভ্যন্তর থেকে দেখলে, নতুন ঐতিহাসিক নিরিখে দেখলে আসাম-জলপাইগুড়ি মেলানো এই ভূখণ্ডে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়।

আমাদের যে প্রায় এক লাখ মানুষকে অনাগরিক ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের অন্তত ৭৫ ভাগই এই জনজাতির মানুষ।

Assam nrc Nirajniti Debes Ray
Advertisment