Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব-৫)

নাগরিকতা যাচাইয়ের জন্য রেশন কার্ডই যথেষ্ট ছিল। তার পরে শেষণ যখন নির্বাচন কমিশনার তখন সচিত্র ভোটার কার্ড যথেষ্টর চাইতেও বেশি ছিল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

(রাজনীতি ও সমসাময়িকতা বিষয়ে কলাম লিখছেন দেবেশ রায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য, আজ পঞ্চম পর্ব)

Advertisment

যখন ভারতের নাগরিক সমস্যা সত্যিই বিপর্যস্ত - দেশভাগের মুখোমুখি ও দেশভাগের পরপর তখন আমাদের কোনো নাগরিক পরিচয়ের পরিচয়ের দরকার হয়নি। যে নিজেকে ভারতীয় মনে করে, সে-ই ভারতীয় বলে স্বীকৃত। দিল্লিতে পাঞ্জাবি উদ্বাস্তু ও সিন্ধি উদ্বাস্তুদের জন্য ত্রাণশিবির তৈরি করা হয়েছিল। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। তাকে ঠিক ত্রাণশিবিরও বলা যায় না। কোনো রকমে বেঁচে থাকার একটা ব্যবস্থা। যুদ্ধধ্বস্ত ইয়োরোপের সঙ্গে তার তুলনা করলে কোনো অতিশয়োক্তি হয় না। অথচ আমাদের দেশের ওপর কোনো বোমা পড়েনি। একটা গৃহযুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল- হিন্দু মুসলমান লড়াই। আমরা সে-লড়াইটা লড়তে রাজি হয়ে গেলাম। আমরা যে একজন মানুষ হিশেবে রাজি হলাম, তা নয়। আমরা হঠাৎই দেখলাম, আমাদের একটা লড়াইয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে ও হয় আমার কোনো প্রতিপক্ষকে খুন করে অথবা নিজে খুন হয়ে আমাকে পরিত্রাণ পেতে হবে।

ঐ বিপর্যয় নিয়ে কোনো ইতিহাস তেমন করে লেখাই হয়নি। আবার আবার নিজের একটি দরকারে দেশবিদেশ ঘুরে ও কিছু স্মৃতিকথা থেকে তথ্য ঘেঁটে আমি নিশ্চিত হয়েছি - ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে দেয়ার আগেই ন্যূনতম প্রশাসন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। সাম্রাজ্যপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশরা যত যুদ্ধলড়েছিল আসাম থেকে বালুচিস্তানে ও কাশ্মীর থেকে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত ও ভারতের বিভিন্ন বিভিন্ন রাজ্যে - সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ও তার চাইতে অনেক বেশি যুদ্ধের ভিতর তারা ভারতকে ফেলে যায়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিক্যাল রিসার্চ কয়েক খণ্ডে ‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’ নামে নথিপত্র প্রকাশ করেছে। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের পক্ষে কয়েক খণ্ডে ‘ট্র্যানসফার অব পাওয়ার’ নামে তাঁদের নথিপত্র প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই বিপুল নথিপত্রের মধ্যে আমাদের জাতি হিশেবে বিপর্যয়ের মানবিক কাহিনী পড়া যায় না। সেই মানবিক কাহিনী লেখার জন্য ‘দি রেলিনকুসিং অব পাওয়ার’ ও ‘দি বিল্ডিং অব পাওয়ার’ এমন দুটি খণ্ড প্রকাশ করা দরকার যাতে দাঙ্গাগুলির কার্যকারণ ও ইতিহাস, আর ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ সংকলিত থাকবে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ৪)

লেখার ঝোঁকে কথাটা গুলিয়ে ফেলেছি।

বলতে চাইছিলাম - যখন আমাদের নাগরিক-পরিচয়, আমি যে ভারতেরই নাগরিক তার একটা কিছু প্রমাণপত্র সত্যি দরকার ছিল তখন এই কথাটা একেবারেই প্রাধান্য পায়নি। কোনো সীমান্তচৌকির একটা শ্লিপ, কোনো ত্রাণশিবিরের একটা কার্ড - এই সবই যথেষ্ট প্রমাণ ছিল। সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল - একজন মানুষের এই প্রকাশ্য অবস্থান যে সে ভারতকে তার দেশ মনে করে।

সেই চরম দুর্বিপাকে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সেই স্বীকৃতি সত্ত্বেও বাংলার, বিহারের, উত্তরপ্রদেশের, হায়দরাবাদের মুসলিম সমাজের বিপুল অংশ ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে যায়নি। পরিবারগুলি দু-টুকরো তিন-টুকরো হয়ে গেলেও, তাদের কোনো একটি টুকরো ভারতের গণতান্ত্রিকতায় অনেক বেশি বিশ্বাস করেছিল। এই বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য নিশ্চয়ই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উচ্চতম নেতৃত্বের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি, মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত উপস্থিতি ও প্রাণদান, ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও তখন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা জওহরলাল নেহরুর সাহস, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব একসঙ্গে কাজ করেছে। তারই ফলে আজ ভারতের  মুসলিম নাগরিকের সংখ্যা, পাকিস্তানের চাইতে বেশি।

নাগরিকতা যাচাইয়ের জন্য রেশন কার্ডই যথেষ্ট ছিল। তার পরে শেষণ যখন নির্বাচন কমিশনার তখন সচিত্র ভোটার কার্ড যথেষ্টর চাইতেও বেশি ছিল।

সেই সব সময়েই ‘অনুপ্রবেশ’ শব্দটি রাজনীতিতে এল, বাংলা-আসাম-ত্রিপুরার রাজনীতিতে, ১৯৭১-এর কিছু পরে, বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর। বাংলাদেশ ও এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে আসা-যাওয়া অনেক সহজ হয়ে আসার পর।

একটা কথা বিশেষ করে মনে রাখা দরকার যে যুক্তফ্রন্টের দুই সরকার, তারপর কংগ্রেসের পাঁচ বছরের সরকার, তারপর বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের সরকার, তারও পর তৃণমূল কংগ্রেসের সাড়ে সাত বছরের সরকারে বাংলায় ’অনুপ্রবেশ’ নিয়ে প্রায় কখনোই কোনো কথা তোলেনি। ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার উপজাতীয় উগ্রপন্থা ও অনুপ্রবেশের সমস্যার অতুলনীয় সমাধান করেছেন। তার জন্য প্রদান কৃতিত্ব ত্রিপুরার প্রথম কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর। তাঁকে সেই স্বীকৃতি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসও দেয়নি, তাঁদের পার্টিও দেয়নি।

আসামে যে এই নাগরিকতার সমস্যা প্রধান হয়ে উঠল ও বারবারই সংকট তৈরি করছে তার মূল কারণ নিহিত আছে আসাম প্রদেশ গঠনের মধ্যেই। সমগ্র উত্তরপূর্ব ভূখণ্ডকে ‘আসাম’ বলে এক প্রদেশের মধ্যে আঁটিয়ে দেয়ার শর্ট কাটের মধ্যে। নাম ‘আসাম’ অথচ অহোমরা কোনো কালেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।

সে-কাহিনী জানা যায় অধ্যাপক ডক্টর রেবতীমোহন লাহিড়ী-র গবেষণাগ্রন্থ ‘দি অ্যানেকসেসন অব আসাম’-এ। বইটি এখন খুব দরকার। পাওয়া যায় কি?

Assam nrc Nirajniti Debes Ray
Advertisment