Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১০)

আর্যদের সমাজপতি ব্রাহ্মণ সর্বত্রই সমাজের বিধায়ক বলে স্বীকৃত হলেও, নিরামিশাষী ব্রাহ্মণরা বা ব্রাহ্মণেতররাও আমিষভোজী ব্রাহ্মণদের স্বীকৃতি দেয় না - এক পংক্তিতে বা টেবিলে খায় না পর্যন্ত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

(দেবেশ রায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য কলম ধরতে রাজি হয়েছেম, এ খবর আর নতুন নেই। প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে তাঁর লেখার প্রকাশে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন পাঠকরা। মনে করানোর, এটি তাঁর নাম দেওয়া কলাম ‘নিরাজনীতি’-র দশম কিস্তি)

Advertisment

ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভারত হওয়া। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদও ভারত নিয়ে হাঁফিয়ে থাকত সবসময়ে। আয়তনে এত বড় দেশ। প্রাকৃতিক সীমান্তে চিহ্নিত এত রকম রাজ্য। যে সব পর্বতশ্রেণি ও নদী ও হ্রদ ও উপসাগর এই রাজ্যগুলিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখত ও এই রাজ্যগুলি স্বাধীন রাখত - সেই সব পর্বত দুর্লঙ্ঘ্য, সেই সব নদী ও উপসাগর অনুত্তরণীয়।

সেই প্রত্যেকটি রাজ্যে অসংখ্য ও বিচিত্র মানুষ। শুধু যে তাদের গায়ের চামড়ার রং আলাদা তাই নয়, তাদের ভাষা আলাদা, ধর্ম আলাদা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক আলাদা, সামাজিক আচরণ আলাদা, তাদের দেবদেবী আলাদা, সেই দেবদেবীদের পূজাপদ্ধতি আলাদা, একএক রাজ্যের জনগোষ্ঠীগুলির ভিতরকার সম্পর্ক আলাদা, সঙ্গীত আলাদা, সাহিত্য আলাদা।

ব্রিটিশরা কেন, যে-সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার পেয়েছিল ইংরেজরা, সেই বিশাল মোগল সাম্রাজ্যও তো ক্শ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তারের ভারে ভেঙে পড়ল। দিল্লি-আগ্রার কাছাকাছি যদি-বা আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর তো কেন্দ্রীয় শাসনের চিরদূরত্বে। আসামের রাজা ভগদত্ত পাণ্ডবদের পক্ষ নিয়ে হস্তীবাহিনী পাঠিয়েছিলেন কিন্তু বাংলা-আসামে আজও মোগলকাটা, মোগলমারি, মোগলখাঁড়ি নামের ছড়াছড়ি।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ৯)

আর্যরাও চেষ্টা করেছিল। তারা ব্রাহ্মণ নামে এক শ্রেণী তৈরি করে তাদের হাতে সমাজশাসনের ভার দিয়েছিল। অনেক শ বছর ধরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই বর্ণগুলি ও তাদের সামাজিক অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল। সারা ভারতের জন্য মনুসংহিতা তৈরি হয়েছিল - ইউনিভার্সাল সিভিল কোড। কিন্তু পালন করতে গিয়ে দেখা গেল - অসম্ভব। সংহিতার বিধান, সামাজিক ঐতিহ্যের সহ্গে মিলছে না। কর্নাটকে মামাতো ভাইই হচ্ছে পাত্রীর নির্বাচিত ও ধর্মোচিত স্বাভাবিক স্বামী। উত্তরভারতে এই সম্পর্ক অজাচার বা ইনসেস্ট। যাজ্ঞবল্ক্য সমাধান করলেন, শাস্ত্রের চাইতেও বড় দেশাচার, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’।

আর্যদের সমাজপতি ব্রাহ্মণ সর্বত্রই সমাজের বিধায়ক বলে স্বীকৃত হলেও, নিরামিশাষী ব্রাহ্মণরা বা ব্রাহ্মণেতররাও আমিষভোজী ব্রাহ্মণদের স্বীকৃতি দেয় না - এক পংক্তিতে বা টেবিলে খায় না পর্যন্ত।

সারা ভারতকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন দু-জন। এক বুদ্ধদেব। দুই অশোক।

এই ব্রত পালনের জন্য তাঁদের রাজ্য ও রাজত্ব ত্যাগ করতে হয়েছিল। বেদের বিরোধিতা করতে হয়েছিল, পূর্বজন্ম-পরজন্ম অস্বীকার করতে হয়েছিল, চতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টম- এই বিধানকে অস্বীকার করতে হয়েছিল। তাঁদের এই অভিযান নাস্তিক্য না আস্তিক্য এই বিতর্ক আজও মেটে নি।

সম্ভবত আধুনিক কালের আর-একজন রাজনীতিবিদ, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভারতীয়তার এই সাংস্কৃতিক ঐক্যসূত্রটি ধরতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর কাছে ভারত সবসময়েই ছিল এক নিয়ত সন্ধান- ডিসকাভারি।

তারও চাইতে বিস্ময়কর তাঁর এই ভারতসন্ধানের তাৎপর্য ও মৌলিকতার কথা বলেছিলেন, তাঁর রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ এক রাজনৈতিক নেতা - অটলবিহারী বাজপেয়ী।

নেহরুর মৃত্যুর পর পার্লামেন্টে ১৯৬৪-তে অটলবিহারী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি দ্বিধাহীন স্বরে বলেছিলেন, কিছু কথা। সেই কথাগুলি আজ বিশেষ করে জানা দরকার যে ‘জনসঙ্ঘ’-এর রাজনীতির নেতা হয়েও বাজপেয়ীজি ভারতের ধারাবাহিকতা ও গণতান্ত্রিকতা সম্পর্কে যা ভাবতেন, তা, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-আদবাণী থেকে কতই আলাদা।

বাজপেয়ীজি বলেছিলেন, ‘তাঁর (নেহরুর) মধ্যে আমি অনেক সময় বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি - রামচন্দ্রের চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য। কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও তাঁর নজর এড়াত না - যদি সেই বিষয়টি দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়। আবার কঠিন কর্তব্যের দায় পালনের জন্য তিনি কঠোরতম ব্যবস্থা নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না - যদি তা দেশের জন্য দরকার হত। তাঁর কাছে দেশ ও ভারতের চাইতে প্রাণাধিক ছিল না আর-কিছুই।’

সেটা ছিল ১৯৬৪। আদবাণীর রামরথ তখন বাবি মসজিদের ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়নি। নরেন্দ্র মোদী কখনো গোরক্ষকদের রক্ষাকর্তা হননি।

বাজপেয়ীজির মৃত্যুতে নেহরু প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন। বাজপেয়ীজিই প্রাসঙ্গিক করে দিলেন।

India Atal Bihari Vajpayee Nirajniti Debes Ray
Advertisment