আমরা এই কথাটি তুলেছি ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু ভারত নিজেই। সঙ্গে সঙ্গে ঐ কথাটিও বলেছিলাম - ভারতের এই বিপুল, বাস্তব ও ব্যবহারিক বৈচিত্র্যকে কোনো স্বপ্নিল ও সালঙ্কার ঐক্যবোধের নির্বস্তুক ধারণা দিয়ে নিজেদের সুবিধেমত ঢাকা দেয়া যাবে না। এই বৈচিত্র্য ও এই ঐক্যবোধের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিকতা আছে, সেই দ্বান্দ্বিকতাক নিজেদের প্রাত্যহিকতার একেবারে অন্তঃসার করে না নিলে, রোজকার সরকারি ও সামাজিক কাজকর্মে উদ্ভট সব ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তখন এই ধরনের অদ্ভুত বিস্মরণ প্রাধান্য পাবে যে ভারতের জনসাধারণের বিপুল সংখ্যক মানুষ যেমন শাকাহারী. তেমনি ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষ আমিশাষী। এই বাস্তবতার কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই। অর্থাৎ হিন্দু বিধবাদের পক্ষে আমিষখাদ্য ও কিছু নিরামিষখাদ্য আহার যেমন শাস্ত্রীয় বর্বরতা - তেমন কিছু নয়, নেহাৎই খাদ্যাভ্যাস। সে-অভ্যাস তৈরি হয় বহু বহু বছর ধরে একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের খাদ্যলভ্যতার ওপর। বিজেপি সারা ভারতকে নিরামিষাশী করার কখনো সরকারি ও কখনো বেসরকারি যে অভিযান চালিয়েই যাচ্ছে, তাদের শাসিত উত্তরপূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন রাজ্য তা মানতে অস্বীকার করেছে, প্রকাশ্যে। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলতে পারেনি। বলা যায় না।
এই ভারতীয় বৈচিত্র্যের সত্য যদি অনুভবের সচেতনতায় জাগরূক ও সক্রিয় না রাখা যায়, তা হলে, কত অপরাধ যে আমরা ঘটিয়ে ফেলি অসাড়ে! জলপাইগুড়িতে আমি যে-কলেজে পড়তাম ও পড়াতাম সেই কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হল। ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞান পড়তে চায় অথচ শিক্ষক নেই। আমরা যখন পড়তাম তখন ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স অবধি ছিল। আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষকেরা- ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিকস-এর এবং বায়োলজিরও - প্রত্যেকেই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১০)
আমি যখন সেই কলেজে চাকরিতে ঢুকলাম, তখন গণিতের অধ্যাপক অন্যত্র চলে গেছেন ও বায়োলজির অধ্যাপক অবসর নিয়েছেন।
বিজ্ঞানবিভাগের এই দারুণ অভাবের মধ্যে হঠাৎ একটা আবেদন এল ফিজিক্সের শিক্ষকপদের জন্য। অধ্যক্ষ আবেদনটি শিক্ষক সমিতির মিটিঙে ফেলে মতামত চাইলেন। একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম - ‘এ বিষয়ে তো শিক্ষক সমিতির মত দেয়ার কোনো এক্তিয়ারই নেই। এটা তো গভর্নিং বডির ব্যাপার।’ অধ্যক্ষ বললেন, ‘গভর্নিং বড়ি বলেছে শিক্ষক সমিতির মতামত নিতে।’
তারপর কথায় কথায় আসল কথা বেরোল। আবেদনকারী মুসলমান। তিনি থাকবেন কোথায়? আমি বললাম, ‘আমাদের যখন চাকরি দিয়েছেন তখন তো এ কথা ওঠেনি যে আমরা থাকব কোথায়? তিনি তাঁর ব্যবস্থা করে নেবেন।’
তারও পরে কথায় কথায় সত্যি কথাটা বেরোল। আমাদের কলেজে তো কোনো মুসলমান শিক্ষক নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের কোনো অসুবিধে হবে কী না।
শেষ পর্যন্ত সেই আবেদনকারীকে চাকরিটা দেয়া হল না। ও বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব মেটাতে অনার্সহীন অভিজ্ঞতাহিন সাধারণ এম.এস.সি কিন্তু হিন্দু শিক্ষকদের নিয়োগ করা হল।
এমন অভিজ্ঞতা আমার আরো আছে।
এই ধরনের অমানুষিকতায় আসামের নাগরিকপঞ্জি রচনাতেও ঘটেছে বেশ আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, যেমন গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হিটলারের জার্মানিতে ইহুদি বাছাই হত। আসামের নাগরিক তালিকা থেকে যাঁদের বাদ পড়েছেন, ৪০ লক্ষ, তাঁরা ভারতের নাগরিক কী না তা পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছেন যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়র (sop)-এ এখন বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্ট ব্যবহার করা হবে। যাঁরা বাদ পড়েছেন বলে দাবি করছেন ও যাঁদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো হয়েছে তাঁদের বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের পর নতুন পরিচয়পত্র ও আধার কার্ড দেয়া হবে। যাঁদের আধার কার্ড আছে অথচ বাদ পড়েছেন তাঁদের পুরনো নম্বরই থাকবে।
অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে তাঁদের জবানিতে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে কোনো সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিককে পাকা নাগরিক তালিকা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়া হচ্ছে না। এমন কি বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
আসামের পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চের স্পেশাল ডিরেক্টর জেনারেল পল্লব ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে তাঁরা বলেছেন ‘ইউনিক আয়ডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’ (UIDAI)-এর কাছ থেকে যন্ত্র কিনে বা এনে এই বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের কাজ করা হবে।
আসাম পুলিশের এই পরামর্শই কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছেন, নাকি কেন্দ্রীয় সরকারই এই পরামর্শ দিতে আসাম পুলিশকে বলেছেন - তা বোঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে কী করে জানা যাবে - যাঁকে এই পদ্ধতিতে মাপা হচ্ছে তিনি ভারতীয় কি না। বায়োমেট্রিক পদ্ধতি কাকে বলা হয়? The application of statistical analysis to biological data (Medical encyclopedia) ও (Pharmacopoeia)। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির কোনো অসুখের চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁর শারীরতাত্ত্বিক তথ্যের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।
ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য ব্যবহারযোগ্য এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিও কোনো নিশ্চিত বিজ্ঞান নয়। যে-ব্যক্তির চিকিৎসা হচ্ছে, সাধারণত ধরে নেয়া গয় যে তাঁর তিন পুরুষের জেনেটিক তথ্য থেকে কিছু একটা আন্দাজ পাওয়া যেতেও পারে। কিন্তু জিনের রহস্য বা জেনেটিক্স এখনও শৈশবে। কোন সূত্র থেকে জিনের কী আকার আসবে তা এখনো জানা যায় না।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর একটি বিখ্যাত গোয়েন্দাগল্প ’শজারুর কাঁটা’। একটা লোক শজারুর কাঁটা নির্ভুল বিঁধিয়ে মানুষ খুন করত। গোয়েন্দা ব্যোমকেশ একজনকে খুঁজে বার করল যার হৃদপিণ্ড বাঁ দিকে নয়, ডানদিকে। সেই খুনিকে প্ররোচিত করা হল ঐ লোকটিকে খুন করতে। খুনি ধরা পড়ে গেল।
এ-সব গোয়েন্দাগল্পে চল।
বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্ট করে স্থির করা যাবে - একটা লোক ভারতীয় কী না? মনে রাখা দরকার যে প্রতিষ্ঠান এই যন্ত্র বানায় তার নাম ইউনিক আয়ডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া। অব ইন্ডিয়ানস নয়।
আজ থেকে অন্তত শ খানেক বছর আগে মহেঞ্জোদড়োর মানুষদের জাতি পরিচয় বিচারে তখনকার যে-বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলে স্বীকৃত হয়েছিল, সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস'-এর আদিপর্বে প্রমাণ করেছিলেন - বাঙালি মুসলমান, নমশূদ্র ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে শরীরতত্ত্বের কোনো পার্থক্য নেই। যে আপাত পার্থক্য কখনো-সখনো গায়ের রঙ, খুলির গড়নে, কাঁধের গঠনে দেখা যায়, তা সেই ব্যক্তির পারিবারিক ধারা।
ডারউইনবাদের আধুনিক গবেষকরা সারা পৃথিবীতে হাসাহাসি করবে যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা হবে, তাও আবার ভারতে, যার জনসংখ্যা ১২৫ কোটি।
এমন হাসাহাসি হিটলারকে নিয়েও হয়েছিল। সেই হাসাহাসির মূল্য দিল কয়েক কোটি ইহুদি।