/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/11/debesh-ray.jpg)
অলংকরণ- অরিত্র দে
কয়েকটি অত্যন্ত বড় ঘটনা ভারতের রাজনীতির অভিমুখ নিশ্চিত পাল্টে দেয়ার সংকেত দিচ্ছে। ১. মহারাষ্ট্রে কৃষকদের জাঠা যা প্রধানত বামপন্থীদের সংগঠিত। ২. দিল্লিতে কৃষকদের জাঠা যাও প্রধানত বামপন্থীদের সংগঠিত। ৩. ১০ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসের ডাকা ভারতবন্ধ ও সেই ভারতবন্ধে ডাকের সমর্থনে ২১টি রাজনৈতিক দলের ঐক্য। বন্ধ্ কে সমর্থন না করলেও পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের দাবিগুলিকে সমর্থন করে কলকাতায় ও সর্বত্র মিছিল। ৪. বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে তৃণমূলকে প্রকাশ্যে আহ্বান একসঙ্গে মিছিল করার জন্য।
এই ঘটনাগুলি একসঙ্গে বড় একটা অর্থ তৈরি করছে বলেই এগুলো বড় ঘটনা। আর বড় বড় ঘটনা তো সেটাই, যার অর্থটা স্বচ্ছ। এই ঘটনাগুলির মিলিত স্বচ্ছ অর্থ হচ্ছে এই – মোদী সরকারকে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে হারানো সারা ভারতের মানুষের ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছা। এই ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল ভারতের কোনো ছোট অঞ্চলের টুকরোতেও নিজেদের জায়গা রক্ষা করতে পারবে না। ভারতের, সারা ভারতের রাজনৈতিক ইচ্ছার এতটা সমবেত স্বচ্ছ ঐক্য স্বধীনতার পর একটিমাত্র উপলক্ষে দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন, সাহায্য ও বিশ্বনেতৃত্ব। চিনের ভারত আক্রমণের ফলে তেমন ভারত-ঐক্য গড়ে ওঠে নি কিন্তু। এটা আমাদের বামপন্থীদের দুর্বলতা। মোদী-শাহি বিজেপি-সঙ্ঘ সরকারের বিরূদ্ধে যে ভারত-ঐক্য তৈরি হয়ে উঠেছে, তার স্বচ্ছতা ও বাধ্যতা দুইই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত-ঐক্যের সমতুল্য। এটাও মুক্তিযুদ্ধ – নিজেদের ফাঁস থেকে নিজেদের মুক্তি। ফ্যাসিবাদী সব সরকারের হাত থেকে মুক্তি। সেই মুক্তি এতই অনিবার্য ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যে অন্য সব সমস্যার কথা ভুলে গিয়ে আমরা আগে প্রাণে বাঁচতে চাই।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৩)
একটা ঘটনা রাজনীতিতে তাৎপর্যে যত স্বচ্ছ হয় - সেই রাজনীতির বিপরীত পক্ষ তার কৌশলদক্ষতার স্বচ্ছতা তত হারিয়ে ফেলে। গান্ধীজি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বারবার এই স্বচ্ছতা দিয়েই হারিয়ে দিয়েছেন।
আবার নিজেও হেরেছেন। সাম্রাজ্যবাদ তাঁকে শেষ পর্যন্ত এমন প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়িয়ে দিয়ে নিজে সরে পড়ল, যাঁর কৌশল – দক্ষতাটাই (ম্যানিপুলেশন বা ম্যানুভারিং) রাজনীতি। মহম্মদ আলি জিন্না। তিনি যা বিশ্বাস করতেন না, যা কিছু তাঁর চরিত্র ও মনন বিরোধী, সেই ‘রাজনীতি’কে তিনি ম্যানিপুলেশনে বা কৌশলদক্ষতায় জিতিয়ে নিলেন।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহি বিজেপি আগের লোকসভার ভোটে দুটি শাদাসিধে কথায় মানুষজনকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন : ‘অচ্ছে দিন’, আর নরেন্দ্র মোদীই নেতা। ‘আচ্ছে দিন’টাই আসল কথা আর নরেন্দ্র মোদীর সনচেয়ে বড় জোর ছিল এইখানে যে তিনি ভারতের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অচেনা। অন্যদিকে মনমোহন সিং তাঁর প্রথম দফায় আমেরিকার আর্থিক সংস্কারের প্যাঁচে পড়ে তার প্রাথমিক কিছু সুবিধেকে, স্থায়ী সুবিধে বলে ভুল করলেন ও চুক্তি পর্যন্ত করে ফেললেন, বাম সমর্থনের তোয়াক্কা না করে, রাজনৈতিক মঞ্চটাকে ভেঙে দিয়ে, এত মৌনী হয়ে গেলেন যার ফলে মানুষজন তাঁকে প্রক্সি প্রধানমন্ত্রী ভাবতে শুরু করল আর তিনি আরো অচেনা হয়ে গেলেন। ব্যবহারে, স্বভাবে, বিদ্যাচর্চায়, ব্যক্তিগত সততায়, বিনয়ে, পারিবারিকতায় মনমোহন সিং একেবারে নরেন্দ্র মোদীর বিপরীত। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী তখনও তাঁর স্ত্রী সাইকেল চড়ে বাজার করছেন - এ ছবি দেখেছি। কিন্তু বড় বেশী অনুপস্থিত। লোকে ভাবল – তা হলে নরেন্দ্র মোদীই ভাল।
তাই বিজেপির জাতীয় কর্মপরিষদের সভায় আর ‘অচ্ছে দিন’ উচ্চারিতই হল না। ‘অজেয় বিজেপি ঔর অমর অটল’। দুটোই অর্থহীন। অটল বিহারীর মৃত্যুতে দলমত নির্বিশেষে সবার শোককে বিজেপি রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তাঁর চিতা ভস্ম নিয়ে যে কর্মসূচি নিয়েছিল, ও, সব জায়গায় সর্বদলীয় লোক-সভার যে আয়োজন করেছিল – দুটোই ব্যর্থ হল।
বরং তাতে মানুষজনের মনে পড়ে গেল যে বাবরি মসজিদ ভাঙা, রামমন্দির বানানো আর গুজরাট দাঙ্গায় অটলবিহারী নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন ও দলের কাছে নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ সুপারিশ করেছিলেন।
দিল্লিতে কৃষক জাঠা, কংগ্রেসের ডাকা বন্ধের সমর্থনে ২১টি দলের ঐক্য আর বিজেপির জাতীয় কর্মপরিষদের পুরনো স্লোগান ব্যবহার করতে না-পারা ও নতুন স্লোগান তৈরি করতে না-পারা, আর তার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর কৈলাশ ও মানস-সরোবর যাত্রা রাজনীতির হাওয়া ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদী তো আর কৈলাশ-মানস সরোবর যেতে পারবেন না!