রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক শামিম আহমেদ ২ সেপ্টেম্বর রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তিনি রাষ্ট্র তিনিই মহাভারত’ শীর্ষক একটি এক পাতার লেখা লিখেছেন। লেখাটি খুব সহজ ও সরল। তিনি পুরো মহাভারতের বিচিত্র ও বিবিধ কাহিনী থেকে এই আখ্যান তৈরি করেছেন যে কৃষ্ণই কী ভাবে সাম্রাজ্যের প্রকৃত অধীশ্বর হয়ে ওঠেন।
কথাটা একেবারেই নতুন নয়। ‘মহাভারত’ চর্চার আদিযুগ মানে ৫/৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বহু পন্ডিত ও ব্রাহ্মণ টীকাকার ও ভাষ্যকার এই কথা বলে আসছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী সেই সব যুক্তিই অধ্যাপক শমিম আহমেদ ব্যবহার করেছেন। একটিও নতুন যুক্তি দেন নি। একটি কথা ভুল লিখেছিলেন। জরাসন্ধ কংসের জামাই। ৪ তারিখেই তিনি একটা চিঠি লিখে ভুল স্বীকার করে নেন। তবে ভুলটা অনবধানবশত ঘটে নি। তিনি জরাসন্ধের মেয়েদের তাঁর স্ত্রী বলেছেন। ভুল, ভুলই। সেটাকে ভুল হিসেবে স্বীকার করাই শ্রেয়।
কিন্তু সংস্কৃত পুরাণের গল্প বলায় এ ভুল মহাভুল নয়। মনসাকে দেখে কামোন্মত্ত শিব ধাওয়া করলে মনসা আর্তনাদ করে ওঠেন ‘বাবা, বাবা, আমি তোমার মেয়ে’। বাপই নিজের মেয়েকে চিনতে পারে না, ২০১৮ তে শ্বশুর-জামাই গুলিয়ে যেতেই পারে।
সংস্কৃত পুরাণের কোনো প্রামাণিক পাঠ হয় না। শ্রীকৃষ্ণের জীবন নিয়ে রচিত ‘হরিবংশ’কে যতই প্রাচীন প্রমাণের চেষ্টা হোক, ও মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে মহাভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হোক, ‘হরিবংশ,’ কৃষ্ণপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, অর্বাচীন কাহিনী। প্রধানত কৃপ্রাধান্যকে পৌরাণিক ভিত্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে। কারো কারো মতে জয়দেব-এর ‘গীতগোবিন্দ’-এরও পর।(১২ শ শতক)। ‘হরিবংশ’কে ‘মহাভারত’-এর পরিশিষ্ট করার উদ্দেশ্য তো অদ্বিতীয় একটাই যে কৃষ্ণকেই মহাভারতের প্রধানতম নায়ক প্রমাণ করা। অধ্যাপক শামিম আহমেদও তাই করেছেন। একটাই তফাৎ। ‘হরিবংশ’ রচিত হয়েছে যুক্তিহীন ভক্তি থেকে আর শামিম আহমেদ লিখেছেন ভক্তিহীন যুক্তি থেকে।
শুনছি, কিছু-কিছু দেখছিও, তাঁর এই লেখার জন্য অধ্যাপক শামিম আহমেদ হিন্দুবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। এই ভীতু হিন্দুত্ববাদীরা স্বভাবত মূর্খ – তাই তাঁরা মনে করেন আক্রমণই শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ও প্রথমেই আক্রমণ করলে জয় নিকটতর হয়। জনসঙ্ঘ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘেও শ্রদ্ধেয় ও মান্য কিছু শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা শাস্ত্রের যুক্তিকে ইতিহাসে প্রয়োগ করতে পারতেন সম্মানীয় পান্ডিত্যের সঙ্গে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত সাহের রাষ্ট্রক্ষমতা পুষ্ট বিজেপির কেউ সম্ভবত তাঁদের নামও জানেন না, তাঁদের রচনার কথাও জানেন না। তত্ত্বকে বাহুবলে পরিণত করাই ফ্যাসিবাদের প্রধানতম লক্ষণ। অধ্যাপক শামিম আহমেদকে তারাই আক্রমণ করছে।
দুটি উদাহরণ দিচ্ছি। অধ্যাপক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বিরল বাঙালি গবেষক। তিনি মহাভারত ও পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী নিয়ে খবরের কাগজেও লিখে থাকেন, আবার সেগুলো বইও হয়। শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ অবিশেষজ্ঞ পাঠকের জন্যই লেখেন। কিন্তু তাঁর স্বভাবগত পাণ্ডিত্যকে সব সময় লুকোতে পারেন না। তখন বিশেষজ্ঞ পাঠক বিপন্ন বোধ করেন – তিনি কোথাও তাঁর প্রমাণসূত্র উৎসসূত্র উল্লেখ করেন না। তাই তাঁর বক্তব্য যাচাইয়ের কোনো উপায় থাকে না। অধ্যাপক শামিম আহমেদও সেই রকম করেছেন। তাঁর এই ছোট নিবন্ধটিতে আমরা জানতে পারি না – তিনি কোন বা কোন-কোন ‘মহাভারত’ থেকে ঘটনাগুলি পড়েছেন। কারণ ‘মহাভারত’ কমপক্ষে সহস্রাধিক।
শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ২০০৯-এ প্রকাশিত তাঁর প্রণিধানীয় গ্রন্থ ‘মহাভারতের প্রতিনায়ক’-এর ১৮ থেকে ২২ পাতায় একলব্য সম্পর্কে যা-যা লিখেছেন ও কৃষ্ণ সম্পর্কে এই গ্রন্থেরই অন্তত ১৪টি জায়গায় যা লিখেছেন (এক জায়গায় আনলে একটা ছোট বইই হয়ে যায়) অধ্যাপক শামিম অহমেদ তার চাইতে বেশি একটি কথাও লেখেন নি। শ্রী নৃসিংহপ্রসাদকে তো হিন্দুত্ববাদীরা আক্রমণ করেন নি। অধ্যাপক শামিমকে আক্রমণ করা হবে কেন? তিনি ইসলাম-ধর্মীয় বলে?
এরও আগে ১৯৮৫-তে ‘দি জার্নাল অব সাউথ এশিয়ান লিটারেচার’ বিংশ ভলিউমের, প্রথম খন্ড, ১ থেকে ১৬৮ অধ্যায়ে ‘মহাভারত’ নিয়ে অনেকগুলি গবেষণা-নিবন্ধ বেরিয়েছিল। অ্যালফ হিলটেবেটেল(Alf Hiltebeitel) কৃষ্ণ-বিষয়ক একজন বিখ্যাত গবেষক। তাঁর একটি বইও আছে – ‘দি রিচুয়াল অব ব্যাটেল: কৃষ্ণ ইন দি মহাভারত’ ইথাকা: কর্নেল ইউনিভার্সিটি ১৯৭৬।
যে প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করেছি তার শিরোনাম – ‘দুই কৃষ্ণ, তিন কৃষ্ণ চার কৃষ্ণ, আরো কৃষ্ণ : মহাভারতে দুরভিসন্ধি’। তাঁর এই প্রবন্ধে তিনি এই ‘দুরভিসন্ধি’ গুলিকে ব্যাখ্যা করেছেন, সে তুলনায় অধ্যাপক শামিম এর তালিকাকে নেহাৎই নিরীহ বলা যায়। সেই গবেষণার তো কোনো প্রতিবাদ হয় নি। কেন? শাহেব বলে? আর অধ্যাপক শামিম মুসলিম বলে তাঁকে আক্রমণ করা যায়? আমরা তো তাঁকে স্বাগত জানাতে চাই যে ভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যের লালন থেকে তিনি অন্য-এক ধর্মের এপিক ও শাস্ত্রীয় আখ্যানকে কী ভাবে দেখেছেন।
তাঁর ‘প্যাটার্নস অব কম্প্যারেটিভ রিলিজিয়ন’ (নিউ ইয়র্ক, নিউ আমেরিকান লাইব্রেরি, ১৯৫৮) বইটিতে মিরসিয়া এলিয়াড (Mircia Eliade) মোক্ষম বলেছিলেন, ‘… বহু অতীত থেকে যে-প্যাটার্ন চলে আসে তা কখনই নিঃশেষে মুছে যায় না, সেগুলো পুনর্জীবনের সম্ভাবনা সবার মন থেকে একেবারে লুপ্ত হয় না’। হিন্দুত্ববাদীরা তেমন এক পুনর্জীবনের যুদ্ধে নেমেছেন।
যুদ্ধ কেন? আর্য ধর্মের সম্প্রসারণের সঙ্গে উত্তর ভারতে যুদ্ধের একটা সম্পর্ক থেকেই গেছে। সেই বৈদিক ‘সোম’ থেকে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির বানানোর কর্মসূচি পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদ যুদ্ধকে শাস্ত্রীয় করে তুলেছে। এখনকার কেন্দ্রীয় সরকার ও আর-এস-এস সেই ধারাতেই চলছে। তাদের দলবল তাই অধ্যাপক শামিমকে আক্রমণ করছে। এটা রাজনৈতিক আক্রমণ। এ আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৩)
তিন মাসের বেশি সময় ধরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য লিখে চলেছেন দেবেশ রায়। আজ তাঁর বিষয় শামিম আহমেদের উপর আক্রমণ।
New Update
Advertisment