Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ২০)

নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ত’ বলতে না পারা ও ভারতের একটি রাজ্যের শাসক পার্টি (তৃণমূল কংগ্রেস) ‘ফ্যাসিবাদী কায়দায়’ প্রশাসন চালাচ্ছে বলার মধ্যে ইতিহাসবোধ তো দূরের কথা, কোনো কাণ্ডজ্ঞানই নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

ব্যবহারে-ব্যবহারে শব্দের একটা মানে তৈরি হয়ে যায়। এগুলোকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। রূঢ় মানে বিশেষ অর্থ। সেটাই প্রধান অর্থ হয়ে ওঠে। এগুলোকে যৌগিক শব্দের ভিন্ন অর্থ বলা যায়। যেমন, ‘পঙ্কজ’ শব্দটির অর্থ পাঁক থেকে যা জন্মেছে। কিন্তু এর বিশেষ অর্থ হল পদ্মফুল।

Advertisment

ছাত্রপাঠ্য এই সব কথা তুলতে হল, আমাদের রাজনীতির কথা বোঝার জন্য। বহুদিন হল আমাদের বামপন্থী রাজনীতির ভাষা এমন যোগরূঢ় হয়ে উঠেছে ও হয়ে থাকছে। যা বলা হচ্ছে না, তা দিয়ে আমাদের বুঝতে হবে কী বলা হচ্ছে। এটা নিশ্চিতই এক ধরনের সুবিধাবাদ। যা-বললে আমার সুবিধে সে-ভাবেই বলব।

সি-পি-আই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি ও পোলিট বুরোর বৈঠক হয়ে গেছে সদ্য, দিল্লিতে। তাই রাজ্যগুলির কাছে সেই বৈঠকের বিবরণ দিতে হবে। এটা ডেমোক্রেটিক সেন্ট্রালিজমের অংশ। কেন্দ্র তার সিদ্ধান্ত রাজ্যগুলির সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে। রাজ্য কমিটিও কেন্দ্রীয় কমিটিতে যা ঘটেছে তা জেলাগুলিতে রিপোর্ট করবে।

সেই রিপোর্টই করতে এসেছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কলকাতায়, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে। ‘গণশক্তি’র ১৪ অক্টোবর রবিবার, সেটাই প্রধান রিপোর্ট ও সংবাদ। আমরা ‘গণশক্তি’র রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই লিখছি।

শনিবার, ১৩ তারিখের সাংবাদিক সম্মিলনে সীতারাম বলেছেন : ১. ‘বাংলায় তৃণমূল বিরোধী ও বিজেপি বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ পরিমাণে একত্রিত করে তাদের পরাস্ত করাই এ-রাজ্যে সি-পি-আই(এম)-এর লক্ষ’। অর্থাৎ এই ভোটটা তা হলে বামপন্থীদের ও কংগ্রেসকে পেতে হয়। সেটা আদৌ সম্ভব? পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার কোনো সংকেত পাওয়া গেছে? তৃণমূল পঞ্চায়েত ভোটে যত অসদুপায়ীই হোক না কেন—তাদের পক্ষে জনসমর্থন না থাকলে তারা তা করতে পারত?

নিশ্চয়ই পারত না। সীতারাম যোগরূঢ় পদ্ধতিতে যা বলতে চান তা হল, তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে বা না-বেঁধে বিজেপি বিরোধিতা করবেন না।

তাতে যদি তৃণমূল-বিরোধী ভোটের একটা বড় অংশ অগত্যা বিজেপিকেই ভোট দিয়ে বসেন? আবারও সীতারামের যোগরূঢ় উত্তর; নীরবতা।

২. সীতারাম বলেছেন, ‘বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নির্বাচনী কৌশল গ্রহণ...করা হবে যাতে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চ পরিমাণে একত্রিত করা যায়’। তার মানে তৃণমূলকে তাঁরা বিজেপি বিরোধী মনে করেন না। কারণ, ভোটাররা যদি সত্যি-সত্যি বিজেপি বিরোধী হন তা হলে তো তাঁরা বামফ্রন্টকেই ভোট দেবেন।

সীতারাম যোগরূঢ় পদ্ধতিতে যা বলতে চান তা হল—বিজেপি আর তৃণমূল এ-রাজ্যে বিরোধী শক্তি নয়, সহযোগী শক্তি। আমরা রাতদিন বিজেপির তৃণমূল-বিরোধী যে-সব অন্তর্ঘাতী কাজ দেখছি, যাতে আমাদের মনে হচ্ছে বিজেপি সারা রাজ্যে একটা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করে তুলতে চাইছে—সেগুলো আসলে বিজেপি করছে না? বা, তৃণমূল করে বিজেপির নামে চালাচ্ছে? বা, বিজেপি রাজ্যে বেশি করে এম-পি পেলে তৃণমূলের কোনো ক্ষতি নেই? বলা বাহুল্য, এই সব অযোগরূঢ় স্পষ্ট প্রশ্নের উত্তরে সীতারামের যোগরূঢ় জবাব: নীরবতা।

৩. পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য সীতারাম তামিলনাদুর উদাহরণ দিয়েছেন। সেখানে বিজেপি ও সেখানকার শাসকদল এ-আই-ডি-এম-কের উদাহরণ দিয়েছেন। সেখানেও তো দুই পার্টির বিরুদ্ধে পার্টি লড়বে।

সীতারাম যোগরূঢ় পদ্ধতিতে যা অস্বীকার করতে চান তা হল, তামিলনাদুর রাজ্য সরকার বিজেপি বিরোধী নন ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার বিজেপি-বিরোধী।

তা হলে, দুই রাজ্যের কৌশল সমার্থক হল কী করে? উত্তরে সীতারামের যোগরূঢ় নীরবতা।

৪. ‘যে প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হতে চলেছে’, অর্থাৎ মোদী সরকারের সাড়ে চার বছরের কাজের গুণগত পরিচয় দিতে গিয়ে সীতারামের যে কথা গুলি ‘গণশক্তি’তে ছাপা হয়েছে সেগুলি হল—‘দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক’, ‘কৃষি উৎপাদন কমছে,’ ‘কৃষি উৎপাদনের মূল্য না পাওয়ায় ‘বেকারি বাড়ছে’, ‘১৮ মাস হয়ে গেল বেকারদের সংখ্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেল না,’ ‘সমাজকে অমানবিকতায় পূর্ণ করতে আক্রমণ,’ ‘শিশু কন্যাকে ধর্ষণ করে খুন করার পরও জাতি-ধর্ম-বিচার করে অপরাধীদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে না,’ ‘শাসক দলের প্রাইভেট আর্মি দলিতদের আর সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে’, ‘রাফালে যুদ্ধ বিমান কেনা’, ইত্যাদি, যেগুলো সীতারাম না বললেও মানুষজনের জানা।

কমিউনিস্ট নেতার কাছ থেকে কি আমরা ঘটনার ধারাবিবরণ শুনতে চাই? নাকি সেই সব ঘটনা মিলে কী অর্থ তৈরি করছে সেটা জানতে চাই?

‘গণশক্তি’র রিপোর্ট অনুযায়ী সীতারাম আগে বলেছেন, ‘তৃণমূল যে-রকম ফ্যাসিবাদী’ কায়দায় শাসন প্রক্রিয়া চালাচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই।

এই একই রিপোর্ট অনুযায়ী—নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাজ কর্ম সম্পর্কে সীতারাম সবচেয়ে কঠিন শব্দ ব্যবহার করছেন তা হল ‘অমানবিক’। এটা একটা বিশেষণ। তিনি একবারের জন্যও, একবারের জন্যও নরেন্দ্র মোদী সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী কায়দা’ কৌশলের জন্য অভিযুক্ত করেন নি। ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা দখল করে অত্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সংবিধান মেনে। নরেন্দ্র মোদী ৩১ শতাংশ ভোটে জিতে এসে ও রাজ্যসভায় সংখ্যালঘু থেকে তাদের ব্যবহারে প্রমাণ করছে তারা যেন পার্লামেন্টে, মানে দুই কক্ষে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরিকল্পনা কমিশন ভেঙে দেয়া থেকে প্রত্যেকটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের ওপর পার্টিকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। পার্লামেন্ট এখনো জানে না পুরনো-নোট বাতিল করল কে। পার্লামেন্ট এখনো জানেনা, সপরিবার নীরব মোদী কার সাহায্যে এতগুলো ব্যাঙ্কের টাকা লুট করে বিদেশে চলে যায়, প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে দাভোসে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিশেবে যোগ দেন ও বিজয় মাল্য লন্ডন কোর্টে সাক্ষ্য দেন যে তিনি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেইটলিকে জানিয়েই বিদেশে এসেছেন।

একে বলে ফ্যাসিবাদ। প্রকাশ্য ও অনুমোদিত শাসনব্যবস্থার ওপরে একটা দলগত শাসন চালু করা। যে-শাসন নিজের খুশিমত মধ্যপ্রদেশ-উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-হরিয়ানাকে নিরামিষাশী করে ফেলতে পারে, সে-শাসক শুধু সন্দেহের বশে একজন গোব্যবসায়ীকে খুন করতে পারে।

নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ত’ বলতে না পারা ও ভারতের একটি রাজ্যের শাসক পার্টি (তৃণমূল কংগ্রেস) ‘ফ্যাসিবাদী কায়দায়’ প্রশাসন চালাচ্ছে বলার মধ্যে ইতিহাসবোধ তো দূরের কথা, কোনো কাণ্ডজ্ঞানই নেই।

তৃণমূল কংগ্রেস অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি চানও, তা হলেও তাঁর পক্ষে ‘ফ্যাসিবাদী’ হওয়া সম্ভব? তাঁর নিরস্ত্র-সশস্ত্র বাহিনী বলতে তো আর্মড পুলিশ আর সিভিক ভলান্টিয়ার। তাঁর হাতে কোনো সৈন্যবাহিনী আছে? তাঁর হাতে নানা নামের সশস্ত্র বাহিনী আছে? তাঁর হাতে সারা ভারত কেন্দ্রীয় যোগযোগের বায়ুপথ ও রেলপথ আছে? তাঁর হাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আছে? তাঁর হাতে এমন পার্লামেন্ট আছে যার স্পিকার তাঁর হুকুম মত একটা আইন পাশ করে দেবে? তাঁর পক্ষে পার্লামেন্টের একটা সমক্ষমতাসম্পন্ন অর্ধকে এড়ানোর জন্য যে-কোনো বিলকে মানিবিল বলে পাশ করিয়ে নেয়ার উপায় আছে?

একটা সচিত্র বিজ্ঞাপন দেখে আমি এক কপি আনতে দিয়েছি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা জার্মানির নাৎসিবাদ উত্থানের একটি বই নাকি সি-পি-আই(এম) রাজ্য কমিটি প্রকাশ করেছে ও ১০,০০০ কপি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর আরো ২০/৩০ হাজার কপি ছাপা হচ্ছে।

শুনে ভাল লাগল যে ফ্যাসিবাদের ইতিহাস চর্চা সি-পি-আই(এম)-এর ভিতরে এত বেড়েছে।

সেই ইতিহাসের যাঁরা আমাদের দেশে প্রয়োগকর্তা সেই নেতারা যদি ভারতীয় পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদের সম্ভাব্য চেহারা ব্যাখ্যা করেন, তা হলে, আমরা উপকৃত হতাম।

CPIM Nirajniti Debes Ray
Advertisment