দেবেশ রায়
(বৃত্তান্তকার হিসেবে অধিক খ্যাতি অর্জন করলেও, তাঁর প্রতিপত্তি যে রাজনৈতিকতাতেই, তাঁর পাঠকবর্গ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র জন্য কলম ধরেছেন দেবেশ রায়। আজ চতুর্থ পর্ব।)
কেউ কি শাদা কথায় এই সিধে কথাটা বুঝিয়ে দিতে পারে যে ডিসেম্বর মাসে তৃণমূল কংগ্রেস যদি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে একটি জনসভা ডাকেন তাতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) দলের কী আপত্তি থাকতে পারে, বা কেন আপত্তি থাকতে পারে! সে আপত্তি কেনই-বা এত তৎপর হতে হবে যে এমন একটি ঘোষণা হতে-না-হতেই সি-পি-আই (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সে-আপত্তি জানিয়ে দেন? অন্তত টিভিতে তো তাই দেখলাম।
ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের মালিক, যত দূর জানি, সি-পি-আই (এম) নন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ড। তাঁদের অনুমতি ছাড়া সম্ভবত সেখানে গরু-ভেড়াও চড়ানো যায় না। যে-গরুভেড়াগুলি সেখানে চড়ানো হয় ও তার ফলে মহানগরে একটি বিশ্ববিখ্যাত নদীর পারে এক চিরকালীন রাখালিয়া পরিবেশ তৈরি হয় - সেগুলির মালিকদের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। সেনাবাহিনী নিজেদের স্বার্থে সে অনুমতি দিয়ে থাকেন। গরু-ভেড়াগুলি ঘাস খেয়ে অত বড় মাঠটিকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখে। যতদূর জানি, রেসকোর্সের মাঠে যাতে ঘাস থাকে অথচ ঘাস জঙ্গল না হয়ে ওঠে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা আছে।
যেটা জানি না ও জানতে ইচ্ছে করছে, তা হল, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড নিয়ে সি-পি-আই (এম)-এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদরের এমন কোনো রক্ষণাবেক্ষণগত সম্পর্কে আছে কী না! বা, সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী হিসেবে কারো তেমন হক জন্মায় কি না।
অথবা, এজমালি সম্পত্তির ব্যবহারকারী হিসেবে এমন আপত্তি জানানোর কোন হক জন্মায় কি না। শুনেছি, দেখেও এসেছি রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক, তখনকার ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের পুব-উত্তর কোণের একটি বড় বাড়ি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিঃশর্ত দান করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুব খেয়াল করেনি। সে-বাড়ির পুরনো দারোয়ানই সে-বাড়িতে থাকতন ও দেখাশোনা করতেন। খুব সম্ভবত, বিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরে ঘটনাটি পড়ে ও তারা দারোয়ানকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বললে দারোয়ান অস্বীকার করেন - ব্যবহারকারী হিসেবে তার নাকি ওই সম্পত্তির ওপর হক আছে। মামলা মোকদ্দমা চলছে কী না জানি না। বাড়িটি এখনো সেই দারোয়ানের দখলেই আছে।
এমন কোনো হকদারির বোধ থেকেই কি সি-পি-আই (এম), তৃণমূল কংগ্রেসের ব্রিগেডে মিটিং ডাকায় আপত্তি করেছেন? সি-পি-আই (এম) কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঐ সময়েই পশ্চিমবঙ্গ সফরের কর্মসূচিতে ও নির্বাচন-সভা আহ্বানে আপত্তি করেছেন? সি-পি-আই (এম) কি রাজ্যে বিজেপির রথযাত্রা থেকে পরের রামনবমী পর্যন্ত প্রচার অভিযানে আপত্তি করেছেন? চোখে পড়েনি।
তাঁরা বলতে পারেন - কোন পার্টি কি কর্মসূচি নেবে তাতে আমাদের কী বলার আছে।
আরও পড়ুন, Opinion: দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (তৃতীয় পর্ব)
বিজেপির এই কর্মসূচিতে হিন্দুদের পালিত উৎসবগুলির সার্বজনীনতা ধ্বংস করে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে - সি-পি-আই (এম) এমন কোনো ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন না? উত্তরপ্রদেশের কায়দায় পশ্চিম বাংলাতেও ভোটারদের হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগি করা হচ্ছে - সি-পি-আই (এম) এমন কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দেখতে পাচ্ছেন না?
সি-পি-আই (এম)-এর উত্তরটা আমাদের জানা আছে। ‘তৃণমূল কংগ্রেসও তো তাই করছে।’
এই উত্তরটা আমরা শুনতে চাই না। পাল্টা প্রশ্ন করে এই উত্তরটাকে বাতিল করতে চাই।
সেই পাল্টা প্রশ্নটা হল: পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিজেপির সমস্ত রাজনৈতিক লক্ষ, উপলক্ষ ও অনুল্লেখ্য কর্মসূচিকে কি আপনারা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সমতুল্যতা দিয়ে বিচার করতে চান? দাঁড়িপাল্লার তো দুটো মাত্রই পাল্লা থাকে। সেই দুই পাল্লাই যদি আপনারা ভরে রাখেন, তা হলে আপনাদের রাজনীতি ওজন করা হবে কোন তৃতীয় পাল্লায়?
আপনাদের একান্ত ও অনুগত কোনো সমর্থক, বামফ্রন্টের সুবাদে, আপনাদের তো জিগগেস করতে পারে - বিজেপি-তৃণমূল সমতুল্য, এই সমীকরণের বাইরে কি আপনাদের কোনো রাজনীতি আছে? পশ্চিমবঙ্গে তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের জন্য যে-জঙ্গি কর্মসূচি নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আপনারা বা/ও বামফ্রন্ট কী কর্মসূচি নিয়েছেন - এটা স্পষ্ট করুন।
নরেন্দ্র মোদীর ডিসেম্বরের ঘোষিত জনসভার পর ব্রিগেডে মমতার জনসভাকে জমায়েতের মাপে গঙ্গাপাড় থেকে জওহরলাল নেহরু রোড পর্যন্ত জমাট করে দেয়াটাকে তো এই মুহূর্তের সবচেয়ে করণীয় রাজনৈতিক কর্তব্য মনে হচ্ছে। সেই জমায়েতে হাজির থাকার একটাই অর্থ: মোদী-বিরোধিতা, বিজেপি-বিরোধিতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা।
সে - জমায়েতে উপস্থিতির অর্থ আপনাদের কাছে বোধহয়, মমতার ফেডারেল ফ্রন্ট তৈরির প্রস্তাব সমর্থন।
কোনটা ঠিক? একটু স্বাধীন ভাবে বলুন। কোনো শর্তাধীন উত্তর চাই না।