(সাহিত্যিক হিসেবে দেবেশ রায়ের খ্যাতি ও তার পরিধি বাংলা ভাষার পৃথিবী জুড়ে। পুরস্কার বা সম্মান দিয়ে তিনি বিচার্য নন। আখ্যান ও অনাখ্য়ান নির্বিশেষে তাঁর রচিত সাহিত্য রাজনীতি ও সমাজবীক্ষার উপর নির্ভর করে থেকেছে এবং রাজনীতি ও সমাজবীক্ষার দিগন্তও উন্মোচিত করেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য নিয়মিত কলম ধরছেন তিনি, আক্ষরিক অর্থেও।)
পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিনসফর ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছেন। আমরা যেখান থেকে এ-সব খবর পাই কাগজ ও টিভি, তাতে, বাংলায়, খবরটাকে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বলা হয়েছে। সর্বভারতীয় কাগজে খবরটিকে খুব কিছু মূল্য দেয়া হয়নি। এখন অবিশ্যি কোনো কাগজই সর্বভারতীয় নয়। সব কাগজই স্থানীয় সংস্করণ। এটা টেকনোলজির সুবিধে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দিন ধরেই আছে। ইয়োরোপে- ইংল্যান্ডসহ- সাধারণত একটা প্রামাণিক সংস্করণ থাকে। ইয়োরোপের দেশগুলি তো ছোট-ছোট। আমেরিকা ও ভারত বড় দেশ তাই এখানে স্থানীয় মানে প্রাদেশিক সংস্কার ব্যবসায়িক ও ব্যবহারিক দিক থেকে দরকার। তা ছাড়া বিভাজনযোগ্য কোনো উৎপাদনই আর স্থানীয় বাজারে আটকে থাকতে চায় না। দিল্লির উপান্তে তৈরি প্যাকেট সর্বভারতীয় তো বটেই আন্তর্জাতিক বাজার চায়। জানি না জি-এস-টির ফলে এখন বহুরাজ্যিক মাল-সরবরাহের খরচা বেড়ে গেছে কী না। অনুমানের ওপর নির্ভর করে বলা যায় - বাড়ে নি। নরেন্দ্র মোদী-র সরকার এই উৎপাদক ব্যবসায়ী শ্রেণীর উপকারের জন্যই রাজ্য ট্যাক্স বাতিল করে জি-এস-টি চালু করেছেন। বামফ্রন্টের অনেক দিনের অর্থমন্ত্রী অসীমবাবু তাঁর কর্মকালে এর সমর্থক ছিলেন। মনমোহন সিং-এর আমলে এ নিয়ে কমিটি তৈরি হলে তিনি তার চেয়ারম্যান ছিলেন। অসীমবাবু সেই বিরল ব্যক্তি যাঁর নিজের বিষয়ের ওপর আধিপত্য অস্বীকার করা যায় না। যুক্তিটাও সহজবোধ্য। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তো আন্তর্রাজ্য বিক্রয় কর একই হওয়া উচিত। আমার মত অর্থনীতিপঙ্গু ব্যক্তির পক্ষেও এটা সহজবোধ্য।
কিন্তু আমার মত রাজনীতি-আগ্রহী ব্যক্তি তো এমন প্রশ্নও করতে পারে- এই অর্থনীতির যুক্তি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হলেও রাজ্যগুলির ট্যাক্স বসানোর জয়গা কি এতে খুব বেশি কুঁচকে দেয়া হচ্ছে না? কিছু কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের মধ্যস্বত্ব, কর্পোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটির বাড়িঘর দোকানপাতির ট্যাক্স, পঞ্চায়েতি কিছু ট্যাক্স ছাড়া তো কোনো রাজ্য সরকারের কোনো ট্যাক্স বসানোর ক্ষমতাই নেই। অগত্যা বিভিন্ন রকম বিনিয়োগ করে টাকা তোলার জন্য বিভিন্ন রকম কর্পোরেশন তৈরি করা হয়। সেই কর্পোরেশনগুলি খুব তাড়াতাড়ি দুর্নীতির ভাগাড় হয়ে ওঠে। এটা মোটেই পশ্চিম বাংলার ঘটনা নয়। অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিম বাংলায় চিরকালই এই ধরনের দুর্নীতি তুলনায় কম। কংগ্রেসের প্রথম বিশ বছর, বামফ্রন্টের টানা চৌত্রিশ বছর ও তৃণমূলের চলতি বছর সাত। কংগ্রেসকে চোর বলার বামপন্থী রাজনীতি বা বামফ্রন্টকে হাওলাৎদার বলার তৃণমূলের রাজনীতি, আবার সারদা-নারদ ধরে তৃণমূলকে চোর বলার বামফ্রন্টের রাজনীতির, কোনো রাজনৈতিক মূল্য নেই অন্য অনেকানেক রাজ্যের তুলনায়। অথচ, এই অপবাদ আমাদের রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠেছে। ফলে রাজনীতির ভাষা তার বিশেষ অর্থ হারিয়ে ফেলেছে।
এইবার আমার জিজ্ঞাসাটাতে পৌঁছচ্ছি।
অর্থনীতির যুক্তি কি রাজনীতির যুক্তিকে পুরোপুরি চাপা দিতে পারে? চাপা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করাও হতে পারে? রাজনীতি রাষ্ট্রপরিচালনার পদ্ধতি। পার্লামেন্ট তার একমাত্র আধার। অথচ নোটবাতিলের মত অর্থনৈতিক ঘটনার পর পার্লামেন্ট আজও জানতে পারল না - সিদ্ধান্তটা কার? নীরব মোদী যে পরিমাণ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে লুট করে নিয়ে বিদেশে গিয়ে বাতিল পাসপোর্টের জোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটাকে অর্থনৈতিক অপরাধ বলে প্রধানমন্ত্রী ঠোঁট খুললেন না। এমন উদাহরণ ক্রমবর্ধমান।
আরও পড়ুন, দল ডাকলে তখন দেখা যাবে, বললেন অকপট সোমনাথ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সরকারের অনুমতিতে চিন ও আমেরিকা সফরে যাচ্ছিলেন। কোনো মন্ত্রীর বিদেশসফরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি বাধ্যতামূলক। সেই দেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তাঁদের কর্মসূচি স্থির করেন - সেই আহ্বায়ক দেশের বিদেশমন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলে। চিনের কোনো সংগঠন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করতেই পারেন, আমেরিকার সংগঠনও। কিন্তু চিন বা আমেরিকার শাসকদল তাঁর সঙ্গে, কোনো রাজনৈতিক পদাধিকারীর সঙ্গে মতবিনিময় চাইতেই পারে না ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতি বা অনুরোধ ছাড়া। অসম্ভব।
রাজনীতির পরিধি যেমন অর্থনীতি খাচ্ছে, মমতার ব্যাপারটাও তেমনএ এক পরিধি-বিপর্যয়। আমরা নিরাজনীতি চাই। তার মানে, রাজনীতি রাজনীতিই করুক।