Advertisment

জেএনইউ-তে দীপিকা পাড়ুকোন, তাতে হ'লটা কী?

তাঁর মাথার পিছনে আলোকজ্যোতি, ন্যাজের উপরে ডানা। তাঁর তাম্রবর্ণ ত্বকের আলোয় উথালপাথাল আসমুদ্র হিমাচল। তিনি হেসে উঠলেই সূর্য লজ্জা পায়, স্বর্ণকমলখানা তাঁকেই পরাতে চায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
JNU Deepika Padukone

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

দীপিকা পাড়ুকোন এলেন জে-এন-ইউতে। বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের সামনে এলেন, নমস্কার করলেন, চলে গেলেন। বিখ্যাত লোক, সে নিয়ে কাগজে দু-কলম বেরিয়ে চুকে গেলেই হত। না বেরোলেও কোনো ক্ষতি ছিলনা, এন-আর-সি নিয়ে বক্তব্য রাখা বিশালবপু ব্যক্তিত্বের সংখ্যা তো কম পড়েনি। কিন্তু তা হবার নয়, কারণ একে বলিউড, তায় জে-এন-ইউ।

Advertisment

ব্যস, পুরো লাগ-ভেল্কি পরিস্থিতি।

দীপিকাকে নিয়ে একদল জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, তো আরেকদল সিনেমা বয়কটের ডাক দিচ্ছেন। একদল বলছেন সিনেমার প্রচারের জন্য হিসেব কষা মার্কেটিং গিমিক, আরেকদল সেই সদ্য-মুক্তি-পাওয়া সিনেমা দেখেই বলছেন, কী অভিনয়টাই না করল। জন্মজন্মান্তরেও ভুলিবনা।

এই হুল্লোড় কেন?

এইজন্য একেবারেই নয়, যে দীপিকা একজন উচ্চমানের শিল্পী, নিজের জগতের সেরা। তিনি গুণনিধি হতেই পারেন, এমনকি উচ্চমানের বলিউডি সিনেমায় উচ্চমার্গের অভিনয় করে নিয়মিত কান (কানই হোক বা Cannes) কাঁপিয়েও থাকতে পারেন, সে নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই।

কথা হল, পেশাগত কাজের উচ্চমানের সঙ্গে এই প্রতিক্রিয়ার হুজুগের কোনো সম্পর্ক নেই। সারা ভারতে নানা এনআরসি-বিরোধী জমায়েত হয়েই চলেছে, তাতে কোন নিজ বিষয়ের তালেবর কবে ঢুঁ মেরে গেলেন, সে হিসেবই কেউ রাখেনা। রাখলেও কিছু এসে যেত না।

ধরা যাক, দুর্ধর্ষ সার্জারি-জানা ডাক্তার, নতুন কোনো ইলেকট্রনিক চিপ আবিষ্কার করা কোনো প্রযুক্তিবিদ, কিংবা নিজের জগতের শীর্ষে ওঠা কোনো মেথর ( এটা মোটেই ইয়ার্কি করে বলা হলনা, কিছুদিন আগেই ভ্রাম্যমান টয়লেট পরিষ্কার করার অবিশ্বাস্য দক্ষতা দেখিয়ে আমেরিকার একজন শৌচাগার পরিষ্কারক শিরোনামে এসেছিলেন) জে-এন-ইউ ঘুরে গেলে এই মাপের হট্টগোল হত কি? হাত না গুণেও বলা যায় হত না।

এমনকি দীপিকার আপন বাবা শ্রী প্রকাশ পাড়ুকোন, যিনি ব্যাডমিন্টনের জগতের একদা বিশ্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন, তিনি এলেও এর ধারেকাছে কিছু হতনা। বড়জোর খবরের কাগজে অনেক কিছুর সঙ্গে বড়জোর লেখা হত 'এছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করতে এসেছিলেন, প্রাক্তন ব্যাডমিন্টন তারকা ...'।

তাতে ভুল কিছু ছিলনা। ব্যাডমিন্টন তারকাই হোন বা বিশ্বশ্রেষ্ঠ মেথর, তিনি নিজের জগতের সেরা হতেই পারেন, কিন্তু রাজনীতির জগতে আমজনতা ছাড়া আর কিচ্ছু নন। তাঁর আসা বা যাওয়ায় আর চাট্টি সাধারণ মানুষের আসা বা যাওয়ার চেয়ে বিশেষ কিছু বেশি এসে যায়না।

তাহলে দীপিকার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন?

কারণ সাক্ষাৎ তিনি বলিউড। তাঁর মাথার পিছনে আলোকজ্যোতি, ন্যাজের উপরে ডানা। তাঁর তাম্রবর্ণ ত্বকের আলোয় উথালপাথাল আসমুদ্র হিমাচল। তিনি হেসে উঠলেই সূর্য লজ্জা পায়, স্বর্ণকমলখানা তাঁকেই পরাতে চায়।

ভারতবর্ষে একমাত্র বলিউডি সিনেমা করে এবং বিসিসিআইএর টিমে ক্রিকেট খেলেই এই জাতীয় দিব্যজ্যোতি অর্জন করা সম্ভব। এখানে স্রেফ দারুন ক্রিকেট খেলেই শচিন তেন্ডুলকারের মতো 'ভারতীয় রাষ্ট্রদূত' হয়ে যাওয়া যায়, যুদ্ধবিদ্যার বিন্দুবিসর্গ না জেনেও ধোনির মতো কাশ্মীরে গিয়ে সেনাদের উদ্বুদ্ধ করা যায়, এমনকি গাড়ি-চাপা দিয়ে গুচ্ছের লোক মেরেও খালি গায়ে আমজনতার নয়নের মনি হওয়া যায়।

এইগুলি গোদা ব্যাপার, দীপিকা হলেন এসবের বৌদ্ধিক সংস্করণ। কিন্তু দাগ মোটা হোক বা সূক্ষ্ণ, সিনেমা আর ক্রিকেট তারকা দেখলেই পাবলিকের ল্যালা করে নাকের-জলে-চোখের-জলে হয়ে যাওয়াটা হুবহু এক।

এই অবধি পড়েই যিনি ভুরু কুঁচকে বলছেন, কিন্তু পাবলিক ল্যাল্যা করছে তো দীপিকার বা শচিনের কী দোষ? তিনি এক্কেবারে ঠিকই বলছেন।

ওঁদের দোষগুণ থাকতেই পারে, দায়ও থাকতেই পারে, কিন্তু এই লেখার সেটা বিষয়বস্তুই নয়। এই লেখায় গাল দেওয়া হচ্ছে সূক্ষ্ম ও গোদা, আঁতেল ও চণ্ডাল নির্বিশেষে কেবল ও কেবলমাত্র পাবলিককে, যারা স্রেফ বিজ্ঞাপিত চাকচিক্যের জন্য অন্তর্বস্তুর প্রতি অন্ধ হয়ে থাকে।

তারা বিচিত্রানুষ্ঠানের ম্যারাপে ডেকে আনে সুরহীন তারকাদের, রাজনৈতিক ম্যারাপে তারকা পদস্পর্শে উদ্বাহু কিংবা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত তারকাদের জন্য নয়, স্রেফ পাবলিকের বোধের চোদ্দটা বাজায় বলেই তারকাপ্রথা একটি কুৎসিৎ বিষয়। ওর মধ্যে সারবস্তুও বিশেষ কিছু নেই, অন্তত সম্ভাবনা কম, কারণ বস্তুটি বহু অর্থ ব্যয়ে কর্পোরেট পুঁজির উদ্যোগে খড়ের উপর রঙচঙে মেক-আপের কারুকার্য ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।

একজন ক্রিকেটার ভালো ক্রিকেট খেলতেই পারেন, একজন অভিনেতা ভালো অভিনয় করতেই পারেন, কিন্তু তাঁর দক্ষতা, বস্তুত, একজন ভালো ট্রাক ড্রাইভারের ট্রাক চালানোর দক্ষতার চেয়ে এক ইঞ্চিও বেশি বা কম কিচ্ছু না। শিল্পের জগৎ, বা চিন্তার জগৎ, যেমন, ধরে নেওয়া হয় ট্রাক ড্রাইভারের অনধিগম্য, একই ভাবে চার চাকার জগৎও রূপোলি তারকার ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কর্পোরেটাধীন শিল্পকীর্তির সঙ্গে ট্রাক ড্রাইভারির বিশেষ তফাতও নেই, উভয়কেই মালিকের নির্দেশে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। এই গন্তব্যে পৌঁছতে গেলে ড্রাইভারকে বসতে হয় স্টিয়ারিং এর পিছনে, আর অভিনেতাকে মাখতে হয় রঙচং। এই প্রাথমিক জ্ঞানগম্যিটুকুর অভাবের তারকাপ্রথার জয়জয়কার, কারণেই দীপিকাকে নিয়ে এত হইচই।

হতেই পারে, দীপিকা এ যুগের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন ( যদিও ভদ্রমহিলার এক আধখানি অভিনয় দেখে এই অর্বাচীন লেখকের তেমন কিছু লাগেনি), কিন্তু ট্রাকের জগতেও প্রবাদপ্রতিম ট্রাক-ড্রাইভারও নিশ্চয়ই শতাব্দীতে একটি বা দুটিই হন, হুজুগে ইতিহাস তাঁদের মনে রাখেনা।

দীপিকাদের রাখে, কারণ, কর্পোরেটের জয় সর্বত্র।

(সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুচণ্ডালি ওয়েবজিনের সম্পাদক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সবকটি লেখা একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Guruninda JNU deepika padukone
Advertisment