অন্য সব জায়গার মতই বলিউডেও স্থিতাবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছেন মহিলারাই। অভিনেতা, যাঁদের আবেদন বেশি, যাঁরা প্রচুর দূর পর্যন্ত পৌঁছতেও পারেন, তাঁরা ফিল্ম শুরুর আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা মনে করেন বটে, কিন্তু শেষ অবধি সময় এলে ঠিক পালিয়েও যান।
জেএনইউতে দীপিকা পাড়ুকোনের ছবি হাজার হাজার টুইট হয়েছে। অনেকেই তাঁকে সমর্থন করেছেন, আবার অনেকেই টুকড়ে টুকড়ে গ্যাংয়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁর বিরোধিতাও করেছেন। কেউ কেউ আবার বলেছেন, এ শুধুই দীপিকার ছবির প্রচার কৌশল, অনেকে একই নিঃশ্বাসে ছবি বয়কটের ডাকও দিয়ে ফেলেছেন।
ছপক মুক্তির বেশি বাকি নেই। এ ছবির প্রযোজকও দীপিকা স্বয়ং। এ সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন, একটি বিবৃতিও তিনি জারি করেছেন, তাঁর এই উপস্থিতির মাধ্যমে, কিন্তু তার চেয়েও বড়, তিনি একটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন- বলিউডের পুরুষরা কোথায় গেল!
সেইসব নায়কেরা যাঁরা দশকের পর দশক ধরে সাম্রাজ্য ও লক্ষ লক্ষ হৃদয় জয় করে এসেছেন, যাঁদের হেয়ারস্টাইল, সংলাপ, ধরনধারণ, পোশাকের নকল করার ব্যাপারে সারা দেশ একজোট। কিন্তু এ দেশকে যখন মেরুকরণ করা হচ্ছে, তখন তাঁরা কী ভাবছেন, সে কথা আমরা জানতে পারছি না কেন!
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিদ্রোহ, প্রস্তাবিত এনআরসি এবং ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলার প্রতিবাদে বলিউড যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা অভূতপূর্ব। অভিনেতা-পরিচালক স্বরা ভাস্কর, মহম্মদ জিশান আইয়ুব, রিচা চাড্ডা, অনুরাগ কাশ্যপ, অনুভব সিনহা, দিয়া মির্জা এবং আরও অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় কেবল মুখ খোলেননি, হাজির হয়েছেন মিছিলে, বিক্ষোভে।
কিন্তু এ তালিকায় অভিনেতারা নেই। রূপকথার ব্যবসায়ী, যাঁরা নিজেদের কেরিয়ার ও কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন ফিল গুড সিনেমা বানিয়ে, তাঁরা এসব রাজনীতির চক্কর থেকে দূরে থেকেছেন।
গত কয়েকদিন ধরে একের পর এক অভিনেত্রীরা সে আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। সোনম কাপুর, আলিয়া ভাট সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর তুমুল নিন্দা করেছেন। আর এবার দীপিকা পাড়ুকোন তো হাজিরই হয়ে গেলেন বিক্ষোভ চত্বরে।
দীপিকা জেএনইউতে তারকা হিসেবে যাননি। তিনি মঞ্চের মধ্যবর্তী হননি, কোনও ভাষণ দেননি। তাঁর টিমের একজনের কথায়, ক্যাম্পাসে যে সন্ত্রাস হয়েছে, সে নিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন বলে ওখানে গিয়েছিলেন দীপিকা। যেমনভাবে একটার পর একটা শহরে উদ্বিগ্ন সচেতন নাগরিকরা একটার পর একটা বিক্ষোভে যোগ দিয়ে চলেছেন, তেমনভাবেই।
এর ফল কী হতে পারে, দীপিকা অন্যদের থেকে বেশি জানেন। এই ২০১৭ সালেই এক বিজেপি নেতা পদ্মাবৎ ছবিতে অভিনয় করার জন্য তাঁর মাথার দিয়েছিলেন ১০ কোটি টাকা। কর্নি সেনা তাঁর নাক কেটে নিতে চেয়েছিল।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না থাকলেও বলিউডের হিরোইনরা জানেন ট্রোল ব্রিগেডকে খেপিয়ে দিলে কী হতে পারে। এক ঘন্টা যদি স্বরা ভাস্করের টাইমলাইন পড়েন, তাহলেই আপনার বমি পাবে, আর কোনওদিন সোশাল মিডিয়ায় আসতে চাইবেন না।
তা সত্ত্বেও সোনম কাপুর, আলিয়া ভাট আর দীপিকা পাড়ুকোনরা ঝুঁকি নিয়েছেন। পুরুষদের কোথায় আটকাচ্ছে! কাপুর, খান, বচ্চন, যাঁরা আরও ক্ষমতা চান, আর ঝুঁকি নিতে চান তার ব্যস্তানুপাতিক!
এই হিরোরা রাজনৈতিক পক্ষ অবলম্বন করে হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারেন না। মাত্র কয়েক বছর আগে শাগরুখ খান ও আমির খানকে বিজেপি নেতা সহ অন্যরা পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তারণ তাঁরা দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশকে অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল মুক্তির সময়ে ব্যক্তিগত বাবে করণ জোহর ও এমএনএস গুন্ডাদের মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল।
কেউ কেউ একথা বলতেই পারেন, গণতন্ত্রে কোনও পাবলিক ফিগারের সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক থাকার অধিকার রয়েছে, তা সে অবস্থান নিয়ে যতই প্রশ্ন তোলা যাক না কেন।
বলিউডে মেয়েদের রোজগার কম, তাঁদের কাজের মেয়াদও স্বল্পকালীন। বছরের পর বছর ধরে আমরা শুনে আসছি খুব কম নায়িকাই নিজের কাঁধে ছবি টেনে নিয়ে চলতে পারে। কথাটা সত্যি কারণ তাঁদের জন্য কোনও পার্ট লেখা হয় না, মেইনস্ট্রিম সিনেমায় সুন্দর মুখ আর চমৎকার পর্দাউপস্থিতিই ফিমেল লিডের জন্য যথেষ্ট বলেই ধরে নেওয়া হয়।
একটা ঝুঁকি না-নেওয়ার-জন্য কুখ্যাত ইন্ডাস্ট্রি, যেটা ইন্ডাস্ট্রি চালায় ঝুঁকি নিতে না চাওয়া পুরুষেরা, সেখানে রাজনৈতিক অ্যাডভেঞ্চারিজম দেখানোর জন্য যে কোনও প্রজেক্ট থেকে মহিলাদের যখন তখন বাদ দিয়ে দেওয়া যায়। রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য কাজ হারানোর কথা বলেওছেন স্বরা ভাস্কর।
দর্শকদের কাছেও রাজনৈতিক মত সম্পন্ন একজন মহিলাকে মেনে নেওয়া কষ্টকর। পুরুষমানুষ সিরিয়াস ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে, কিন্তু সুন্দর গানের সঙ্গে একজন সুন্দরী মহিলার নাচ কি আর ভাল লাগে, যদি জানা হয়ে যায় এ মহিলা টুকড়ে টুকড়ে গ্যাংয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল!
পুরুষদের বিরুদ্ধে আক্রমণের চেয়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অনেক বেশি তীব্র, অনেক বেশি নোংরা। মতামত সম্পন্ন মহিলার মনের কথা তাদের যত ক্ষিপ্ত করে, তারা তত আক্রমণ করতে চায় তাঁর শরীরকে। মহিলাদের বিরুদ্ধে সাধারণ অস্ত্রই হয়ে ওঠে যৌন হুমকি আর যৌন খেউড়।
অনুরাগ কাশ্যপ ও জাভেদ আখতারকে দীর্ঘদিন যাবৎ অবিশ্রান্ত ট্রোলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের নিজের পেশার লোকেরা কেউ তাঁদের সস্তা বলে আখ্যা দেয়নি, যেমনটা ঘটেছে স্বরা ভাস্কর ও রাজ শাণ্ডিল্যার ক্ষেত্রে।
বলিউডের সব পুরুষরা অবশ্য রাজনীতি সবসময়ে এড়াতে চান না। অক্ষয় কুমারের সাম্প্রতিক ছবিগুলি হয়ত কাকতালীয় ভাবেই সরকার যেসব প্রকল্প প্রমোট করতে চায় সে সব নিয়েই- শৌচাগার নির্মাণ কিংবা বিদেশি মুসলিম বিতাড়ন। অক্ষয় কুমার অবশ্য লাইনে একলাটি নন, তবে একমাত্র, যিনি প্রধানমন্ত্রীর আম পসন্দ নিয়ে সাক্ষাৎকারের সুযোগ পেয়েছেন।
অনেক অভিনেতাদেরই দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাস্যমুখে সেলফি তুলতে, এমন একটা সময়ে, যখন তার তাৎপর্য না-জানাটাই অসম্ভব।
অমিতাভ বচ্চন, যিনি বলিউডের সম্ভবত সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী সফল ব্যক্তিত্ব, তিনি সরকারি বিজ্ঞাপনে কাজ করেন, কিন্তু সরকার যখন নিজের লোকের বিরুদ্ধে যায়, তখন মুখ বন্ধ রাখেন।
এই তারকাদের আবেদন তুলনাহীন। সলমনভাই যদি একবার তাঁর নীল ব্রেসলেটওলা হাতটা তোলেন, বচ্চন যদি তাঁর ব্যারিটোনে বলেন, কিংবা শাহরুখ যদি তাঁর গালের টোল দুটিকে ধার দেন, তার যা প্রভাব হবে, তা একশ সম্পাদকীয় বা জেএনইউ প্রাক্তনীদের ভাষণের চেয়ে বেশি।
সে ক্ষমতার কথা এই তারকারা জানেন। সে ক্ষমতার সঙ্গে যে দায়িত্ব জুড়ে থাকে, সেদিকে ওঁরা তাকাতে চাননা।
বলিউডের বাইরেও, সিএএ-এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভের মহিলাদেরই প্রাধান্য- শাহিনবাগের সাহসিনীরা ঝকমক করছেন। তাঁরা উদাহরণ। এবার বোধহয় সময় এসেছে, যখন হিরো-র সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে, যাঁর কাছ থেকে প্রেরণা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় একাত্মতার বোধ, নতুন সংজ্ঞায় হিরো হবেন তিনিই। আজ, এই সময়ে, বলিউডের মেয়েরা নিজেদের হিরো প্রমাণ করেছেন। বলিউডের শাসক তারকাদের চেয়ে তাঁরা বেশি নায়কোচিত।