দিল্লি ভারতের মতো এক বিপুলা দেশের এক ক্ষুদ্র, সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন, অঙ্গরাজ্য। এই রাজ্যের ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হবে মঙ্গলবার। ভোট হলো শনিবার। এই ভোটের পর যেসব সমীক্ষা হয়েছে, তার প্রতিটি রিপোর্ট বলছে, কেজরিওয়ালের ঝুলিতেই দিল্লির দু'কোটি মানুষের ভোট। এখানে শীলা দীক্ষিত কংগ্রেসের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৮ থেকে একটানা ১৫ বছর সেই পদে ছিলেন তিনি। এবং তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী যিনি লুটইয়েনস দিল্লির কাছেই তাঁর দীর্ঘ শাসন কায়েম রেখেছিলেন।
এখন ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তারপর ছ' বছর তিনিই ক্ষমতাসীন। তবু কেজরিওয়ালকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না মোদী। কেজরিওয়াল ২০১৪ সালে বেনারসে মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন। তখন সর্বভারতীয় রাজনীতির নক্শা রচনা করছিলেন তিনি। আম আদমি পার্টির (আপ) রাজনীতির সম্প্রসারণ চেয়েছিলেন হরিয়ানা, পাঞ্জাব, এমনকি গোয়াতে পর্যন্ত। কিন্তু এবার ২০২০ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তিনি তাঁর কেন্দ্র-বিরোধী সংঘাত মূলক রাজনীতির কৌশল বদলে ফেলেন। বিজেপির হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ রাজনীতির ফাঁদে কিছুতেই পা দিতে চান নি কেজরিওয়াল। তিনি এই নির্বাচনকে উন্নয়নের কর্মসূচি-কেন্দ্রিক করতে চান। সস্তায় বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহ করা থেকে রাস্তার সংস্কার। চিকিৎসা এবং শিক্ষা পরিষেবাকেও অগ্রাধিকার দেন কেজরিওয়াল।
আরও পড়ুন: বাজেটের কল্যাণে ফিরে আসবে কি মধ্যবিত্তের ‘অ্যাসপিরেশন’?
দেশের মানুষ এই ভোটের দিকে তাকিয়ে। সেটা অবশ্য শুধু অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জন্য নয়। এই নির্বাচনটি জাতীয়, এমনকী, আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছেও শাহিনবাগের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এমনিতেই দিল্লি মানেই রাজধানী। মোদী সরকারের নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকের পাদপ্রদীপের নিচে কেজরিওয়ালের দিল্লি। প্রদীপের নিচে অন্ধকারে থাকার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু খড়গপুরের আইআইটি স্নাতক কেজরিওয়াল তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে এবার যেভাবে নির্বাচনী যুদ্ধ লড়েছেন, তা দেখে আমি মুগ্ধ!
দিল্লি-যুদ্ধে প্রথমার্ধে কেজরিওয়াল এগিয়েছিলেন দারুণভাবে। ভোট সমীক্ষা বলছিল, মোট ৭০টি আসনের প্রায় প্রত্যেকটিতেই তিনি এগিয়ে। মনে হচ্ছিল সুইপ করবেন। কিন্তু জেএনইউ, তারপর জামিয়া মিলিয়া, তারপর আবার জেএনইউ, তারপর শাহিনবাগ কাণ্ড - একের পর এক ঘটনা কেজরিওয়ালকে বেশ চাপের মুখে ফেলেছে। এই ঘটনাবলি আবার জনসমাজে এক ধরনের রাজনৈতিক-ধর্মীয় মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে: হিন্দু এবং মুসলমান। দিল্লিতে মুসলিম জনসমাজ কলকাতার মতো বিপুল সংখ্যক নয়। পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ৩০ ভাগ, দিল্লিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ। কিন্তু এ ঘটনায় বিজেপিরই লাভ, মনে করেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। এমনকী, স্বয়ং কেজরিওয়ালও।
সোজাসাপটা বলি আপনাদের। দু’মাস আগের এক রবিবারে আমি কেজরিওয়ালের বাড়িতে গিয়ে দীর্ঘ আড্ডা মেরেছিলাম। কেজরিওয়ালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের অনেকটা কৃতিত্বই আমি দিই আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। একটি জনপ্রিয় দৈনিকে তখন চাকরি করতাম। কিন্তু কেজরিওয়ালের সচিবরা আমাকে বলতেন দিদির 'রেসিডেন্ট কমিশনার'। কেজরিওয়াল আজও মমতাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। দু’জনের মধ্যে আজও সুমধুর সম্পর্ক। দিদির কাছ থেকে কেজরিওয়াল রাজনৈতিক পরামর্শ গ্রহণ করেন। এমনকী, দু’জনেই প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শও গ্রহণ করেন। দু’জনের রাজনীতির মধ্যে সাযুজ্য আছে। অভিজাত রাজনীতি নয়, দু’জনেই নিম্নবর্গের রাজনীতির ব্র্যান্ডে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ, হাওয়াই চটি থেকে মাফলার।
আরও পড়ুন: ভারতীয় গণতন্ত্রের সেকাল, একাল, পরকাল?
কেজরিওয়াল সেদিন বলেছিলেন, আমার ভোটের অ্যাজেন্ডা সস্তায় পানীয় জল, সস্তায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। রাস্তাঘাট সংস্কার। স্কুল ও স্বাস্থ্য পরিষেবা। অর্থাৎ, উন্নয়নমূলক কর্মসূচি। বিজেপি তাই সে পথে না গিয়ে শাহিনবাগকে প্রচারের হাতিয়ার করছে। কিন্তু কেজরিওয়াল এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাইছিলেন না। এমনকী, যখন নাগরিকত্ব বিল পাশ হলো, তখন মমতা প্রথম থেকেই রিঅ্যাক্ট করলেও কেজরিওয়াল করেননি। তিনি শত প্ররোচনাতেও বিজেপির ফাঁদে পা দিতে চাইছিলেন না। জেএনইউ অথবা জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনেও শামিল হননি তিনি। বিজেপি অবশ্য কৌশলগতভাবে শাহিনবাগকেই সবচেয়ে বড় প্রচারের বিষয় করেছে।
এসবের মধ্যে কেজরিওয়ালের প্রশাসনে নাম্বার টু, অর্থমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়া বলে বসলেন যে, "উই আর উইথ শাহিনবাগ।" ব্যস! আগুনে ঘি। বিজেপি প্রচার করল: শাহিনবাগ সন্ত্রাসবাদের গোচারণ ভূমি। এখানে জঙ্গিরা বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছে। এর নেপথ্যে পাকিস্তান-আইএসআই আছে। কাশ্মীরে ব্যর্থ হয়ে এখন পাক সন্ত্রাসবাদী শক্তি এখানেই সক্রিয়। কেজরিওয়াল এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন। তিনি অমিত শাহর স্ট্র্যাটেজিটা বুঝতে পেরে যান, কিন্তু ধর্ম উন্মাদনা এমন একটা বিষয়, যা যুক্তি দিয়ে ঠেকানো কঠিন। উন্নয়নের তাসটা কেজরিওয়াল ব্যবহার করছিলেন। দিল্লির উন্নয়ন কতটা সত্যি সত্যি হয়েছে - তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারত। কংগ্রেস এবং বিজেপি বলছে, কেজরিওয়াল উন্নয়ন নিয়ে অসত্য বলছেন। কিন্তু দিল্লির সংখ্যাগরিষ্ঠ আমজনতা মনে করেন যে, কেজরিওয়াল উন্নয়ন করেছেন।
এটা হলো ‘পারসেপশন’। যেমন নীতীশ কুমারকে 'উন্নয়নবাবু' মনে করে বিহারের মানুষ একটা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। কেজরিওয়াল দিল্লির উন্নয়ন করেছেন, কী করেননি - এ প্রশ্নের যদি সরাসরি জবাব চান, তাহলে বলব, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার তুলনায় তিনি অনেকটাই বেশি করেছেন। আমি নিজে দিল্লিবাসী। শিকড় হাওড়ার শিবপুরে। কিন্তু দিল্লিতে অভিবাসন তিন দশকেরও বেশি, একটানা। চিত্তরঞ্জন পার্কে থাকি। এখানে কেজরিওয়াল সত্যি সত্যি বিদ্যুতের দাম ভয়ংকর কমিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে সম্ভব হলো তা? জবাবে কেজরিওয়ালের উপদেষ্টারা বলেছেন, প্রাইভেট সংস্থার যে বিলিং, তা কেজরিওয়াল সরকার পুরো চুকিয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: দিল্লি নির্বাচন: ফাটা কার্তুজ ও ধর্মীয় বিভাজনের পরিসংখ্যান
কিন্তু সরকার তো আমজনতাকে ভর্তুকি দিয়ে বিল কমিয়ে দিয়েছে। তাহলে ভোটের পর যদি কেজরিওয়াল জেতেন, তবে কি এই ভরতুকি দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে? উত্তর পেলাম, না, তার প্রয়োজন হবে না। কারণ দিল্লি সরকারের বাজেট উদ্বৃত্ত। এ রাজ্যের বাজেট বরাদ্দ দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রর পরেই। এ রাজ্যে স্রেফ আবগারি শুল্ক থেকে রাজস্ব অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব, রাজ্য সরকার কম লাভ করে মানুষকে ‘রাহত’ দিচ্ছে। মানুষের টাকা মানুষকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই একই সূত্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেজরিওয়াল কার্যকর করছেন।
এখন বিজেপির ফাঁদে মনীশ সিসোদিয়া পা দেওয়ার পর কেজরিওয়ালকেও শাহিনবাগ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। ভোটের একদিন আগে মহেশ শর্মা, দিল্লির নেতা, গৌতম বুদ্ধ নগরের সাংসদ, তাঁর নতুন বাসভবন ১৩ তালকাটোরা রোডে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মধ্যাহ্নভোজনে। সেখানে মহেশ শর্মা বলছিলেন, "প্রথমে হতাশ লাগছিল, এখন তো মনে হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে আমরা সরকারও গঠন করতে পারি।" 'রেডিও এফএম'-এ কেজরিওয়ালের বিজ্ঞাপনী ভাষণ গত কয়েক দিন ধরে শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন, "আপনি ‘আপ’-এর সমর্থক নাও হতে পারেন। অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারেন। এ ব্যাপারে আমার সমস্যা নেই। বিরূপতা নেই। শুধু একথা আমি বলতে চাই যে, এবারের ভোটটা আমাকে দিন দিল্লির উন্নয়নের জন্য। যে-উন্নয়নের কাজ আমি শুরু করেছিলাম, তা অসমাপ্ত। সেটি সমাপ্ত করতে চাই। তাই আপনি যে দলেরই সমর্থক হোন, ভোটটা দিন।"
কী সাংঘাতিক প্রচার! এমন প্রচার আমি পশ্চিমবঙ্গে কখনও দেখিনি। লাগাতার এ প্রচারে কংগ্রেস ও বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক চলে যাচ্ছিল 'আপ'-এর বাক্সে। এখন শাহিনবাগ দিয়ে মেরুকরণের অস্ত্রে বিজেপি তাদের দলের ভাঙন ঠেকাতে চাইছে। আর কংগ্রেস? সে এক গভীর সংকটে! একে তো রাহুল গান্ধী দলের নেতা আছেন কী নেই, তা কেউ জানে না। সোনিয়া গান্ধীর সুস্থ, নীরোগ, দীর্ঘ জীবন কামনা করি। তিনি গঙ্গারাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সদ্য ছাড়া পেয়েছেন। প্রিয়াঙ্কা আছেন, কিন্তু দলের পক্ষ থেকেই পূর্ণ স্বরাজ নেই। সুভাষ চোপড়া দলের সভাপতি, কিন্তু তিনি বৃদ্ধতন্ত্রের সদস্য হয়ে গিয়েছেন। এখন তো ওঁর মার্গদর্শক মণ্ডলীর সদস্য হওয়ার কথা। অথচ শীলা দীক্ষিতের মৃত্যুর পর তিনিই এখন দিল্লির নেতা। বিজেপি থেকে আসা কীর্তি আজাদ আজ কংগ্রেসের প্রচার সমিতির প্রধান, মূলত পূর্বাঞ্চলের বিজেপি নেতা মনোজ তিওয়ারির মোকাবিলায়।
কংগ্রেস নেতারাই বলছেন, বিজেপিকে হারানোর পক্ষে কেজরিওয়ালই ভালো। ওঁকে দুর্বল করা মানে বিজেপির লাভ। তাই এ হলো প্রতীকী লড়াই। সত্যি, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতারা যদি আজ এটা বুঝতেন! যা হোক, মোদ্দা কথাটি হলো, দিল্লির ভোট কেজরিওয়াল বনাম মোদীর। তাই বাজেটকে ভুলিয়ে, আর্থিক দৈন্য সরিয়ে, বিজেপি অযোধ্যার ট্রাস্ট গঠনে ব্যস্ত। সংসদে প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্টিদের কমিটি ঘোষণা করলেন। হিন্দুত্বের সমস্ত অস্ত্র এই রাজ্যের ভোটে ব্যবহৃত। পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় মেরুকরণ, দেশদ্রোহিতা থেকে যোগী আদিত্যনাথের প্রচার। বিজেপি ভালো ছাত্রের মতো সিলেবাসের প্রতিটি অধ্যায় পড়েছে। ১১ তারিখ জানা যাবে, দিল্লির মানুষ শেষবেলায় ভোটবাক্সে কী করেছেন। যা বেশিরভাগ মানুষ মনে করছেন সেটাই, না অন্য কোনও আকস্মিক অলৌকিক কাণ্ডকারখানা? মূল প্রশ্ন, বিজেপি আগের চেয়ে বাড়বে, কিন্তু ঠিক কতটা বাড়বে?