বেশ সুস্থভাবেই শুরু হয়েছিল দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার। দেশের বেশিরভাগ মুখ্যমন্ত্রীর তুলনায় পড়াশোনায় ভালো অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সম্ভবত এইসময় সবচেয়ে মেধাবী মুখ্যমন্ত্রী। আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় পাশ করা ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা বুঝতে ভুয়ো শংসাপত্র খুঁজতে হয় না। কিন্তু তার মানেই যে তিনি রাজ্যশাসনে পুরোপুরি সফল হবেন এমনটা নয়। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ীর তত্ত্বও অনেক সময় ভুল প্রমাণিত হয়। ফলে অরবিন্দবাবু যা করেছেন সবটাই ঠিক, এমন কথা সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় অযৌক্তিক।
আবার অন্যদিকে একথাও বলতে হবে যে ব্যক্তিগত কারণে তাঁর দুর্নীতি করার সম্ভাবনা একেবারেই কম। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সকলেই উচ্চশিক্ষিত এবং সচ্ছল। কয়লা পাচার, রঙ ব্যবসা, মিথ্যে কোম্পানি খুলে দেওয়ার দালালি, চিটফান্ড, এইসমস্ত রাস্তায় পয়সা রোজগারের দায় কেজরিওয়ালের নেই। তাঁর দলও সম্ভবত সততার সূচকে বেশ ওপরের দিকেই থাকবে। অনেকটা এদেশের বামপন্থী দলগুলির মতো, যারা ভোটের রাজনীতিতে আজ প্রায় অপ্রাসঙ্গিক।
এ প্রসঙ্গে বিজেপির কথাও বলতে হয়। পুরোপুরি ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করলেও, ব্যক্তিগত সততা এবং চরিত্রের দিক থেকে তাদের বেশিরভাগ নেতাই নিষ্কলুষ। দু-একজন বড় নেতার ছেলেমেয়ে কিংবা আত্মীয়স্বজন হয়ত ব্যবসা বাণিজ্যে অধিক সুবিধে নেন, তবে সেই সংখ্যা কম। বরং তাদের উৎসাহ বন্ধুত্বপূর্ণ ধনতন্ত্রে (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম), যেখানে নীতির প্রশ্ন আদানি, আম্বানিদের নিয়ে। শাহীনবাগে গুলি-টুলি চালানোর কথা তাঁরা যখন তখন বলে থাকেন। সে তো দক্ষিণপন্থার দায়। কিন্তু সকাল থেকে বিকেল দুর্নীতির পাঁকে যাদের রাজনীতি সাঁতার কাটে, আপ কিংবা বিজেপি সাধারণভাবে সেই দলে পড়ে না। তুলনায় কংগ্রেসের নামে অভিযোগ অনেক বেশি। অবশ্য এবারের দিল্লি নির্বাচনে তাদের সফল হওয়ার বিশেষ আশা নেই। একমাত্র দেখার বিষয় তারা কতটা ভোট পায় এবং তার ফলে আপের অসুবিধে আর বিজেপির সুবিধে হয় কিনা।
তবে সমাজবিজ্ঞানে দুর্নীতিই একমাত্র বিপদ নয়। সেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদ যেমন বিপদ, তেমনই বিপদ হিন্দুত্বের ভিত্তিতে বিভাজনে। মুসলিম মানেই যে সব ভালো এমনটা নয়। সেখানেও মৌলবাদের প্রভাব ব্যাপক। এই প্রেক্ষিতেই উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং বিজেপির সমর্থক হলে দেশপ্রেমী, হিন্দু হয়েও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে দেশদ্রোহী, সংখ্যালঘু হলে পাকিস্তানি আর সংখ্যালঘুদের সমর্থনে মিছিলে হাঁটলে সন্ত্রাসবাদী, এই শ্রেণীবিন্যাস ভারতের রাজনীতিতে এক অন্য ধারার আমদানি করেছে।
এর মধ্যে নাটক চলছে প্রচুর। বন্দুক হাতে খোলা রাস্তায় গুলি চালাচ্ছেন কয়েকজন মানুষ। পুলিশ যে শুধু দর্শক হয়ে নাটক দেখছে এমনটা নয়, একেবারে মুঠোফোনের ক্যামেরা চালু করে বোঝাচ্ছে 'একেই বলে শুটিং'। ছবি তোলা আর গুলি চালানো ইংরেজি শব্দবন্ধে একাকার। এদিক ওদিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে গুলির খোল। তার সংখ্যা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক। এত লোকজনের মধ্যে গুলি চলার অনেক পরেও যে কী করে সবসময় কার্তুজের খোল খুঁজে পাওয়া যায় এ নিয়ে প্রশ্ন থাকে অনেকেরই মনে। অপরাধীর পাত্তা তো পাওয়াই যায় না (সে যতই সরাসরি সম্প্রচার হোক না কেন), মাঝে মাঝে আস্ত লাশও গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু ইঞ্চিখানেক লম্বা খোল অক্ষত। অর্থাৎ পাখির চোখ ফাটা কার্তুজের দিকে।
ঠিক তেমনই বিজেপির নির্বাচনী কৌশলে প্রতি মুহূর্তে বিশ্লেষিত হয় ধর্মভিত্তিক জনবিন্যাসের পরিসংখ্যান। এই বিভাজনকে অক্ষত রাখাটাই তাদের রাজনৈতিক লাইন। আপাতত দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাদের প্রচারের সুরে এই কথা বারবার উঠে আসছে। অল্প কিছু সংখ্যালঘু মিলে যদি শাহীন বাগে এতো বড় বিক্ষোভ কর্মসূচি চালাতে পারে, তাহলে তা নাকি গোটা দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। হিন্দুপ্রধান দল নির্বাচনে না জিতলে এই দেশে হিন্দুরাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাবে। অবশ্যই বিজেপির পক্ষে কাজে দিচ্ছে এই প্রচার। হিন্দুদের একটা বড় অংশ এই মত মেনে নিয়েই বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন। তবে হিন্দুদের মধ্যে এই মতের বিরোধী মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। স্বাভাবিকভাবেই সেই বিভাজনের বিন্যাসই এবারে দিল্লিতে ভোটফল নির্ধারণ করবে। জিতুক কিংবা হারুক, বিজেপি এই বিভাজনে সফল।
সংবাদমাধ্যমে বারবার নীতিকথার গল্প ছাপা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারে নাকি সবচেয়ে বেশি করে উঠে আসা উচিৎ উন্নয়নের তর্ক। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সেই হিসেবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল অবশ্যই অনেকটা এগিয়ে আছেন। কিন্তু নিজেদের বাড়ির ছেলেমেয়ের পড়াশোনার চেয়ে আমরা অধিক উৎসাহী পাশের বাড়ির সাংসারিক অশান্তিতে সামিল হতে। সেই প্রেক্ষিতে উন্নয়নের তুলনায় হিন্দু মুসলমান বিভাজন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি টকঝাল। তাই নির্বাচনের আগের দু সপ্তাহ জুড়ে উন্নয়ন শিকেয়, পুরোটাই সাম্প্রদায়িক।
গত ২০১১ জনগণনার ভিত্তিতে দিল্লিতে আশি শতাংশের বেশি হিন্দু আর তেরো শতাংশের কাছাকাছি মুসলিম। ফলে এই নিয়ে কোন সন্দেহই নেই যে হিন্দুদের মধ্যে প্রভাব বাড়াতে পারলে বিজেপির সুবিধে। আর মুসলিম ভোটের ভাগে বিজেপির খুব বেশি আশা নেই, সেটা পুরোটাই যাবে আপ কিংবা কংগ্রেসের ঝুলিতে। এখানে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন প্রায় সাড়ে চার শতাংশ, এবং এর মধ্যেই শাহীন বাগের অবস্থানে শিখ কৃষকদের অংশগ্রহণে বিজেপি বিরোধিতার সুর স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে যেমন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একসময় বামফ্রন্টের দিকে ছিল, আজকের দিনে তৃণমূলের সমর্থনে, তেমনি দিল্লিতে এবার তাদের কংগ্রেসের বদলে আপের ওপর বিশ্বাস রাখার সম্ভাবনাই বেশি। বিভিন্ন সমীক্ষাও মোটের ওপর সেই কথাই বলছে। সেই কারণেই ভোট-পূর্ববর্তী নানা বিশ্লেষণে পরিষ্কার যে আপ কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে। আর আজ সন্ধেতেই পাওয়া যাবে বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফল।
মনে রাখতে হবে যে সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লির ভোটারদের কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিই দীর্ঘ আনুগত্য নেই। জনমতের হাতবদল এখানে বিপুল। গত কয়েকটি নির্বাচনের পরিসংখ্যান দেখলেই তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বুঝতে অসুবিধে হয় না, লোকসভায় বিজেপির দখল প্রশ্নাতীত, কিন্তু বিধানসভায় নয়। গত ২০১৯ লোকসভার তুলনায় বিজেপি এবং কংগ্রেসের ভোট শতাংশ যে এই বিধানসভা নির্বাচনে কমবে তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই, আর সেই ভোট প্রায় পুরোটাই যাবে আপের ঝুলিতে। সমীক্ষাগুলোও সেই হিসেব কষেই বলছে যে 'পেহলে আপ'। জাতীয় স্তরের বিষয় সামান্য কিছুটা প্রভাব ফেললেও তা কাটাকাটি হয়ে যাবে। যেমন মোদীসাহেবের রামমন্দির ট্রাস্ট নিয়ে ঘোষণা যেমন বিজেপির হিন্দু ভোটে অক্সিজেন জোগাবে, তেমনই তাদের ঝিমোনো অর্থনীতি আর ঝাপসা বাজেট সুবিধে করে দেবে বিরোধীদের। সেই হিসেবে দিল্লির মানুষের একদিন প্রতিদিন নিয়ে যদি ভোট হয় তাহলে আপেরই জেতার কথা। তবে বিজেপি ভালো লড়াই দেবে এবার। অন্তত শেষ দুসপ্তাহে হিন্দুত্বের প্রচারে তারা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আপাতত অপেক্ষা সামনের মঙ্গলবারের। জনগণ খুঁজে নেবেন দেশভক্তকে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)