নীলার্ণব চক্রবর্তী: এ রাজ্যের ভোটে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিজেপি। কিন্তু পরাজয় পেয়ে তাদের গজরাতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে প্রচারের ঘূর্ণঝড় তুলেছিলেন। তাঁকে বিজেপির শীর্ষ নেতারা এও বলে ছিলেন, বঙ্গ-বিজয় সময়ের অপেক্ষা, দেখতে থাকুন না কী হয়! কিন্তু নদীর স্রোতের মতো সময় এগিয়ে যেতে যেতে মমতার নৌকোটাই আশীর্বাদধন্য। আশীর্বাদটা একটু খুঁতো অবশ্য-- সব কিছুর মধ্যে তৃণমূলের বুকে একটা ঘটনাই তিরের মতো বিঁধে-- হ্যাঁ, বহু চর্চিত বটেই, নন্দীগ্রামের ব্যাটেল গ্রাউন্ডে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে মমতার পরাজয়।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী, ছ'মাসের মধ্যে তো তাঁকে জিতে আসতে হবে। সময়-- সবচেয়ে বড় শত্রু, হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে ষষ্ঠ মাসের দিকে, কিন্তু নির্বাচন কমিশন করোনার কারণে ভোটাভুটির সুইচে পজ টিপে রেখেছে। এখন এমন কোনও আইন নেই, কমিশন ভোট না করালে, যে আইনের ক্ষমতায় পদে থেকে যেতে পারবেন মমতা। নন্দীগ্রামের এই ফলের বিরুদ্ধে মমতা আদালতে গিয়েছেন, কিন্তু তার ফলাফল পেতে কত মাস পেরবে, কেউ জানে না! দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার সাক্ষাৎ, তার গুরুত্ব, এ সব প্রেক্ষিতেই অপরিসীম।
দিল্লিতে সাক্ষাৎপর্বটি যখন চলছে, তখন অনেকে ফিরে যাচ্ছেন কলাইকুণ্ডায় প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক মুখ্যমন্ত্রীর এড়িয়ে যাওয়ার বিতর্ক-পর্বেও। এবং তৎকালীন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, সে দিন মমতার সঙ্গে ছিলেন, বৈঠকে তিনিও হাজির হননি। এর জন্য শো-কজপত্র পেয়েছিলেন আলাপন, তিনি খারাপ সময়ের শীর্ষে উঠলেন তখন, সদ্য ভাতৃহারা, বর্ধিত সময়ের জন্য মুখ্যসচিবও তাঁর থাকা হল না। কেন্দ্রের ওই চিঠিতে তাঁর জীবনের গতিপথ ঘুরে গেল অন্য দিকে। নির্বাচনের আঁচ না মেলানোর আগে মুখ্যসচিবকে নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের এই বেনজির সংঘাত দেখলেন রাজ্যের লোকজন।
আরও পড়ুন মোদী বিরোধী জোটের নেতৃত্বে অন্য কেউ, আপত্তি নেই মমতার
কিসসা কুরসি কা
সময় বিরাট বড় দর্শক, যেন সব সময় হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটে, মজাটা দেখতে থাকে সে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়াকু, বাংলায় তিনি অগ্নিকন্যার তকমা পেয়েছেন সেই কবে। এই ভোটে দেখিয়ে দিয়েছেন, (বিজেপির অসীম শক্তির সঙ্গে লড়ে) এ ভাবেও জিতে যাওয়া যায়। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর, ছাতা মাথায় দিয়ে সেই তাঁকেই নির্বাচনের দাবির কথা বলতে হচ্ছে। সেই কমিশনের কাছে দাবি, যাকে তিনি বিজেপির মাউথপিস বলে থাকেন, বলতে হচ্ছে (না বলে উপায় কী), কোভিড পরিস্থিতি এখন শুধরে গিয়েছে অনেক, তলানিতে করোনা। নির্বাচন করানো যায় এখন। যায় না বলুন?… রাজনীতির খেলা বটে! এ রাজ্যের নির্বাচনে দফা-হ্রাসের দাবি তুলেছিলেন মমতারা, মমতাকে সমর্থন করেছিলেন এমনকি রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে থাকা বহু জন। করোনা ছড়ানোর জন্য নির্বাচনই তো কাঠগড়ায়। হয়তো তাঁরা ঠিকই বলেছিলেন।
এখন আবার নির্বাচন না হলে কিন্তু চলবে না, উপনির্বাচন করানোই উচিত, এই তো আদর্শ সময়! এ ভাবে ভোট না করিয়ে কাউকে কুরসি থেকে ফেলে দেওয়াটায় ছটাকও যুক্তি নেই, তাঁরা সওয়াল করছেন। কিন্তু মোদী-শাহের মনে কী আছে কেউ জানে না! এই নয় যে মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি থেকে একবার সরে গেলে ফিরতে পারবেন না মমতা। ফিরবেন হয়তো দ্রুতই। কিন্তু তাঁকে একবার কুরসি-ছাড়া করার মজাটা তো কম নয়? এর মধ্যে করোনার ঢেউ যদি একেবারে থেমে যায়, তা হলে অবশ্য ভোট না করানোর পিছনে কোনও যুক্তি দিতে পারবে না কেন্দ্র। কিন্তু ছোট করে হলেও তৃতীয় তরঙ্গ এসে যদি হাজির হয়, তা হলে হয়ে গেল!
আরও পড়ুন ‘লিডার নই-আমি ক্যাডার’, সোনিয়াকে বার্তা মমতার
দিল্লি সফরের পিছনে কী
মমতার মধ্যে এত বিদ্রোহ যে, কোনও ভাবে তাকে চেপে রাখা যায় না। অনেকের মত, ল্যান্ডস্লাইড ভিক্ট্রির পরেও নিজের কুরসি-রক্ষা সাময়িক ভাবে যখন কমিশন থুড়ি বিজেপির হাতে চলে গিয়েছে, তখনও তিনি পেগাসাস নিয়ে সরবতম। এ দিন জানালেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে পেগাসাস নিয়ে তদন্ত হোক। জনসমক্ষে বিস্তারিত বলতে চাননি অবশ্য। আসলে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ২৪-এর ভোটে কেন্দ্রে বিজেপির বিরুদ্ধে একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে এই ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার।
অনেকেই বলছেন, যদি স্তিমিত করোনা-কালে ভোট না করে মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি থেকে মমতাকে সরিয়ে দেয় বিজেপি, তাদের পক্ষে সেটা লোকসভা ভোটে হিতে বিপরীত হতে পারে। ভরপুর সিমপ্যাথি পেয়ে যাবেন মমতা। পা ভাঙায় যা তিনি পেয়েছিলেন এই ভোটে । (ফলে লোকসভায় বিজেপি সেটি তাঁকে ফ্রি-তে দিতে চাইবে না, তাই ছ'মাসের মধ্যে ভোট হবে, সওয়াল করছেন অনেকেই। কারওর আবার কটাক্ষ, বিনাশকালে বুদ্ধিনাশের মতো কিছু হলে, বিজেপির পক্ষে উল্টোটাও হয়তো অসম্ভব হবে না !) এবং সেই সঙ্গে দিল্লি সফরে আর যে কাজটি মমতা করছেন, তা হল-- বিরোধী জোট তৈরির তামাম চেষ্টা। মমতার দূত যশবন্ত সিনহা যার ভিত ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন। শরদ পাওয়ারের মতো পাওয়ারফুল পোড়খাওয়া নেতা জোট-ব্যাপারে সক্রিয়। প্রশান্ত কিশোরও নেমে পড়েছেন জাদুদণ্ড হাতে করে। বিশ্লেষকদের একাংশের মত, বিরোধী জোটের অবশ্যম্ভাবী নেত্রী তো মমতাই। তাঁর পিছনে যদি শরদ পাওয়ার এবং প্রশান্ত কিশোরের যুগ্ম কৌশল কাজ করে তা হলে তাঁকে আটকানো কঠিন হবে।
#AbKiBaarDidiSarkar- মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি সফর-কালে এমন ট্রেন্ডও হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ধীরে ধীরে মমতার আবহাওয়াটা ফের প্রধানমন্ত্রীর কুরসির দিকে ঘুরছে, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটাকে তো আউট অফ ফোকাসে যেতেই হবে এখন, তাই না? ১৯-এর ভোটে মমতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা রেখেছিলেন, সেই আশা ভাসেনি। এর পর বঙ্গে ক্ষমতা ধরে রেখে যে অসাধ্যসাধন, এতে বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রিত্বের আশার নিম্নচাপ জলীয় বাষ্পের খনি নিয়ে ফিরে এসেছে। রাজনীতিতে আজ যে ফকির, কাল সে-ই রাজা। আজ যে চাওয়ালা, কাল সে-ই প্রধান সেবক, আজ যাঁকে চুলের মুঠি ধরে ক্ষমতার দরজা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে কাল তাঁকেই বারংবার স্যালুট। এর ফলে, ২৪-এ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের স্বপ্ন সাকার করার অধিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে একশো বার।