মননশীলতা প্রাণিকুলে মানুষের বিশেষ পরিচয়। বুদ্ধি নিয়ে মানুষের অহংকার প্রচুর। মানুষ জানে যে মস্তিষ্কের ক্ষমতার জোরেই শারীরিকভাবে বেশি শক্তিশালী প্রাণীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছি আমরা। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতি সামলাতেও অভিযোজনের বদলে মগজাস্ত্রের ওপরেই বেশি ভরসা করেছে ক্রমশ আধুনিক হতে থাকা মানুষ। ধীরেধীরে মানুষ সৃষ্টি করেছে এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে বৌদ্ধিক ক্ষমতার কূট প্রয়োগ কিছু মানুষকে অন্য মানুষদের থেকে ভালো থাকার সুযোগ করে দেয়। এই ব্যবস্থাকে পোক্ত করার উদ্দেশ্যে নিয়ত বুদ্ধিবৃত্তিকতা বা মেরিটোক্র্যাসির জয়গান গাওয়া হয়। মেধার জয়গান গাওয়ার এই স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা ভাবতে থাকি, মেধা ও মনন যেন অজর অমর। দেহ বৃদ্ধ, রুগ্ন, অসুস্থ হলেও মস্তিষ্ক যেন ধরে রাখবে চিরযৌবন। মানুষ ক্রমশ বার্ধক্য ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে বটে, কিন্তু নিজের বোধ ও বুদ্ধি অক্ষুণ্ন রেখে, অর্থাৎ মানুষ হবার অহংকারটিকে সঙ্গে নিয়েই সে যাবে চিরবিশ্রামে। এই ফ্যাণ্টাসির মধ্যেই মানুষ নিজের প্রজাতি পরিচয়ের গরিমাকে সুরক্ষিত রাখে।
বাস্তব হল, মস্তিষ্ক চিরযুবা নয়, তার ক্ষমতা অক্ষয় নয়। আমরা যখন জন্মাই, তখন মস্তিষ্কে যতগুলো স্নায়ুকোষ নিয়ে জন্মাই, তার চেয়ে স্নায়ুকোষের সংখ্যা আর বাড়ে না, বরং কমতে থাকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। এর কারণ স্নায়ুর কোষ বিভাজন হয় না, মানুষের জন্মের পর আর জন্ম হয় না নতুন স্নায়ু কোষের। অন্যরকম হবার উপায় ছিল না আসলে। স্নায়ু ও স্নায়ুসন্ধির নির্দিষ্টতার উপরেই নির্ভর করে স্মৃতি ও অন্যান্য বিশিষ্ট স্নায়বিক কার্যকলাপ। কোষ বিভাজন হয়ে এসব ব্যবস্থাপনা দ্রুত বদলে যেতে থাকলে ওলটপালট হয়ে যেত সবকিছু। স্নায়ুজালের এই অসামান্য বিশিষ্টতার মূল্য চোকাতে হয় আমাদের। বয়সজনিত বা অন্য রোগজনিত কারণে যেসব স্নায়ুকোষের মৃত্যু হয়, তাদের ঘাটতি আর পূরণ হয় না। একটা বয়সের পর থেকে ধীরেধীরে কমতে থাকে মগজের শক্তি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের ক্ষমতা কিছুটা কমতে থাকে ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে বার্ধক্য এলেই বুদ্ধিভ্রংশ অবশ্যম্ভাবী। অল্পস্বল্প ভুলে যাওয়া আর স্মৃতিভ্রংশের কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম ঠিকমতো করতে না পারার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। অঙ্ক কষার গতি খানিক কমে যাওয়া আর হিসেব করে দোকান থেকে জিনিস কিনে টাকা ফেরত নেবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া এক কথা নয়। প্রথমটা বয়সজনিত ক্ষয় হলেও দ্বিতীয়টা স্পষ্টতই অসুখ। এই জাতীয় অসুখগুলিকে এক কথায় বলা হয় 'ডিমেনশিয়া'।
আরও পড়ুন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ও শিক্ষকরা
এই সত্যটুকু বুঝতে এবং মানতে আমাদের সময় লেগেছে। বৃদ্ধদের নাম খরচের খাতায় লিখে দিতে আগ্রহী যৌবনমদমত্ত সমাজ বহুদিন পর্যন্ত বুঝতে চায়নি যে বার্ধক্য আর গুরুতর বুদ্ধিনাশ সমার্থক নয়। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই সত্যটিকে চিহ্নিত করার পরেও এর সমাধান খোঁজার বা বৃদ্ধদের স্মৃতিলোপের চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে সমাজের বা বিভিন্ন দেশের প্রশাসনের আগ্রহ স্তিমিত থেকেছে বহুদিন। হয়ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের অবদান কম বলে, তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নিতে গিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, এমনকি পরিবারও তাঁদের বোঝা মনে করে বলে।
সৌভাগ্যের কথা, এই মনোভাবে কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। ডিমেনশিয়া গোত্রের অসুখের চিকিৎসা ও গবেষণার ব্যাপারে সরকারি বেসরকারি স্তরে আগ্রহ বেড়েছে। একুশে সেপ্টেম্বর দিনটি চিহ্নিত হয়েছে "ওয়ার্ল্ড অ্যালঝেইমারস ডে" হিসেবে। সেই দিনটি পালিত হচ্ছে দেশে দেশে উৎসাহের সঙ্গে। সেই উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে চলছে সচেতনতা প্রসারের প্রচেষ্টা। আজ এত সহজে ব্যাখ্যা না করেই "ওয়ার্ল্ড অ্যালঝেইমারস ডে" লিখতে পারছি, কারণ এতদিনে "অ্যালঝেইমারস ডিজিজ" নামক রোগটির কথা সবাই জেনে গেছেন। এই সচেতনতায় পৌঁছতে পেরোতে হয়েছে দীর্ঘ পথ।
ডিমেনশিয়া গোত্রের রোগগুলির মধ্যে প্রধান এই অ্যালঝেইমারস ডিজিজ। সাধারণত ভুলে যাওয়া এই রোগের প্রথম লক্ষণ। শুরুর দিকে নতুন ঘটনাগুলোর স্মৃতি ঠিকমতো গঠিত হয় না, কিন্তু বহু পুরনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনে থাকে। সকালে কী খেয়েছেন তা বিকেলবেলা ভুলে যান কিন্তু পঁচিশ বছর বয়সে রানিদির বিয়েতে খাওয়া ছাব্বিশটা রাজভোগের গল্প ঠিক বলে দিতে পারেন। ক্রমশ এই স্মৃতিভ্রংশ বাড়তে বাড়তে একসময় খাবার খাওয়ার পাঁচ মিনিট পরেই ভুলে যান আদৌ খেয়েছেন কিনা। রোগের শেষ পর্যায়ে ভুলে যান কীভাবে খেতে হয়, কেমন করে চিবোয় মানুষ, কেমন করে গিলতে হয়? ক্রমশ ভুলে যান যোগ-বিয়োগ, ছবি আঁকা, নিজের বাড়ির পথ, বাড়ির ঘরগুলো, পরিচিত মানুষের মুখ। মানসিক ক্ষমতা বা 'মেণ্টেশন' বলতে যা কিছু বোঝা বা ভাবা সম্ভব, তার সবকিছুই নষ্ট হয়ে যায় ধীরেধীরে।
আরও পড়ুন, একটি জলীয় ঘোষণাপত্র
অ্যালঝেইমারস ডিজিজ ছাড়াও আছে আরো বিভিন্ন রকম চিত্তভ্রংশী ব্যাধি বা ডিমেনশিয়া। ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া, ফ্রণ্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া, ডিফিউজ লিউই বডি ডিজিজ… ইত্যাদি বিবিধ নাম তাদের। এসব রোগ হবার কারণ এবং মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবার পদ্ধতি আলাদা। রোগ-লক্ষণও ভিন্নতর। এদের চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা। অ্যালঝেইমারস ডিজিজ সহ এসব রোগের প্রতিটিরই চিকিৎসা আছে এবং নেই। অর্থাৎ রোগগুলিকে সারিয়ে ফেলার কোনো উপায় আমাদের এখনও জানা নেই, কিন্তু রোগের গতি স্লথ করা এবং রোগীর রোগলক্ষণের তীব্রতা অন্তত কিছুদিনের জন্য প্রশমিত করে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অসুবিধে কমানোর পদ্ধতি কিছু জানা গেছে এতদিনে। তার জন্য প্রয়োজন ওষুধের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুশ্রূষা। রোগীর প্রতি আচরণ থেকে শুরু করে গৃহসজ্জা অবধি অনেক বিষয়ে খুঁটিনাটি খেয়াল রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
অ্যালঝেইমারস ডিজিজের মতো রোগ আমাদের কিছু জরুরি শিক্ষা দেয়। মস্তিষ্কের ক্ষয় কতখানি প্রবল হতে পারে, তা বোঝার পাশাপাশি আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে শুধু জ্ঞান-বুদ্ধি, অঙ্ক করা, কথা বলা, ছবি আঁকা নয়, খাবার খাওয়া, জল খাওয়া অব্দি কতকিছুই মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে। আসলে হাঁটা, ভাত চিবোনো এবং চিবিয়ে ফেলা গ্রাসটিকে গেলা ইত্যাদি সবকিছুই তো আমরা একসময় শিখেছি। আমরা হয়ত সহজে শিখেছি, কিন্তু বিবর্তনের পথে পূর্বজ কোনো প্রাণী বহু প্রজন্ম ধরে এসব শিখে শিখে আমাদের পথ সহজ করে রেখেছে। যা-কিছু শিখেছি, সবই ভুলে যেতে পারি। যা নতুন শিখেছি, তা ভুলি সবচেয়ে তাড়াতাড়ি। যা বহুদিন ধরে শিখেছি, তা ভুলতে সময় লাগে। যা বহু লক্ষ বা বহু কোটি বছর ধরে শিখেছে পূর্বজ প্রাণীকুল, তা টিকে থাকে ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে বহুদিন। মেনে নেওয়া যাক, মানুষ হিসেবে আমরা যা পারি, তার সবটাই আমরা নিজের (এমনকি নিজেদের) চেষ্টায় শিখিনি। শিক্ষার যে স্নায়বিক উত্তরাধিকার আমরা পেয়েছি, তা এমনই বিপুল যে নিশ্বাস নেওয়া, খাওয়া বা হাঁটার মতো বেশিরভাগ দৈনন্দিন কাজ আমাদের সচেতনভাবে করতে হয় না। এসব বিষয়ে আমরা সচেতন হই তখনই, যখন কাজগুলো কঠিন হয়ে পরে স্নায়ুর ঘরে ডাকাতি হবার ফলে।
মস্তিষ্কের ক্ষমতা হারালে মানুষ কতখানি অসহায়, তাও প্রত্যক্ষ করি আমরা। এতদিন যিনি ছিলেন প্রখর বিদ্বান বা প্রবল প্রতাপান্বিত, তিনিও হয়ে যেতে পারেন দারুণভাবে পরনির্ভরশীল। পূর্বতন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন অ্যালঝেইমারস রোগে আক্রান্ত হয়ে নিতান্ত সাধারণ স্কুলে না পড়া গ্রামবাসীর চেয়েও সাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। অর্থ বা যশ যে চিরস্থায়ী নয়, তা আমাদের নীতিশিক্ষার অন্তর্গত। বিদ্যা ও ব্যক্তিত্বও মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে পারে এবং যায়, তা শেখায় ডিমেনশিয়া। মানুষই যে মানুষের শেষ আশ্রয়, অপর মানুষের ওপর শিশুর মতো নির্ভরশীল হবার প্রয়োজন হতে পারে যে কারো, সেই সত্য একবিংশ শতকের প্রবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীর কানেকানে বলে এই ব্যাধি।
আরও পড়ুন, শুধু ভাষা নয়, আত্মপরিচয় হারানো
সংবেদনশীলতার বিরাট পরীক্ষাও নেয় ডিমেনশিয়া। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমশ কাজ করার ক্ষমতা হারাতে থাকেন। বদলে তাঁদের জন্য অন্য সুস্থ কার্যক্ষম মানুষের শ্রম, সময়, অর্থ ব্যয় হয়। উন্নয়নমুখী রাষ্ট্রের চোখে তাঁরা অনুৎপাদক সম্পদ। আসলে তাঁদের আর মানবসম্পদ মনেই করে না সমাজ ও রাষ্ট্রের বেশিরভাগ অংশ। নিরন্তর 'অ্যাসেট' আর 'লায়াবিলিটি'-র হিসেব কষতে থাকা সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে বস্তুত এঁরা অকারণ ভার মাত্র। অলাভজনক কারখানার শ্রমিক দের মতো এঁদেরও ছাঁটাই করে দিতে পারলেই হয়। সৌভাগ্যের কথা, গণতন্ত্রের সেই জায়গাটুকুতে আমরা পৌঁছতে পেরেছি, যেখানে অন্তত প্রকাশ্যে এঁদের বেঁচে থাকার অধিকার অস্বীকার করা যায় না। ঘুরিয়ে বরাদ্দ সংকোচন করা যায় শুধু। পরিবারের মধ্যেও এই মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। আমরা যারা এই রোগীদের চিকিৎসা করি, তারা চোখের সামনে দেখি ভালবাসার শুকিয়ে যাওয়া আর মরে যাওয়া। ডিমেনশিয়া সত্যিই সুস্থ অপরদের জন্য মনুষ্যত্বের কঠিন ইমতেহান। প্রাপ্তির আশা ফুরিয়ে যাবার পর কতদিন কতটা ভালবাসা নিয়ে প্রিয়জনের সেবা করে যেতে পারি আমরা? অবশ্যই পরিবারের যে মানুষ অন্তরঙ্গভাবে ডিমেনশিয়া রোগীর সেবায় ব্যাপৃত, তাঁর চাপ বড় কম নয়। তাঁর প্রতি আত্মীয়-বন্ধু, সমাজ, চাকুরিদাতা, সহকর্মী সকলে কেমন ব্যবহার করবেন, তার ওপর বেশ খানিকটা নির্ভর করবে রোগী কেমন শুশ্রূষা ও ব্যবহার পাবেন বাড়িতে। মনুষ্যত্বের পরীক্ষাটি তাই আমাদের অনেকের জন্য।
ডিমেনশিয়া একথাও শেখায় যে সহমর্মিতা মানে অনুকম্পা নয়, বরং স্নেহ আর শ্রদ্ধার মিশেল। শ্রদ্ধা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগী অনেক সময়ই নিজের মর্যাদা বজায় রাখতে অক্ষম হয়ে পড়েন। শুধু শারীরিক দুর্বলতা তো নয়, বৌদ্ধিক ও আচরণগতভাবেও তাঁরা সামাজিক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হতে থাকেন। এই অবস্থায় রোগজনিত অবক্ষয়কে দেখেও না দেখে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এটাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা আমাদের। এই শিক্ষা কি আমরা অর্জন করছি? ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি দিয়ে যাচ্ছি মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা আর শ্রদ্ধার শিক্ষা? এই শিক্ষাটুকু যদি আমরা রেখে যেতে পারি উত্তরসূরীর জন্য উত্তরাধিকারে, তাহলে আমাদের নিজেদের এক গভীর আতঙ্ক ঘুচে যাবে। ভেবে দেখুন, আমরা অনেকেই ভবিষ্যতে অ্যালঝেইমার বা অন্যতর ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হতে পারি। সেই সম্ভাবনার কথা ভাবলে মৃত্যুর আগেই নিজেকে হারিয়ে ফেলার, পরিচিত সকলের সামনে সযত্নে নির্মিত ভাবমূর্তি খসে পড়ার, সম্মান হারানোর ভয়ে আমরা ত্রস্ত হই। যদি জানতে পারি যে মানুষের মন আরেক ধাপ উন্নত হয়েছে, তার ভালবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ অত ঠুনকো নয়, তাহলে অনেক শান্তিতে বৃদ্ধ হতে পারব সকলে। তাই নয় কি? শেখা কথা ভুলিয়ে দেওয়া ব্যাধির কাছেও অনেককিছু শেখার আছে আমাদের।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক। মতামত ব্যক্তিগত।)