এই লেখার শুরুতে কলকাতা নয়, মার্কিন মুলুকের মায়ামি নিয়ে কথা বলা যাক। ফ্লোরিডা রাজ্যের মায়ামি অঞ্চলে মশাবাহিত রোগ সংক্রান্ত সতর্কবার্তা বা অ্যালার্ট জারি হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি দফতরে রীতিমত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয়েছে ডেঙ্গি মোকাবিলা অভিযান। চলতি বছরে মায়ামি-ডেইড কাউন্টি এলাকায় কতজন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন জানেন? এগারো জন। তাতেই এক প্রকার মহামারি অ্যালার্ট জারি হয়ে গেছে।
বা ধরুন সিঙ্গাপুরের কথা। মোটামুটি একনায়কতন্ত্র চলে সেদেশে (অলিখিত নয়, ঘোষিত), প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা বা নিন্দা করা নিষেধ। অথচ এবছর ডেঙ্গিতে সেখানে ২০ জন মারা যাওয়াতে আলোড়ন পড়ে গেছে সারা দেশে। সিঙ্গাপুর শহর ছেয়ে গেছে ডেঙ্গি সংক্রান্ত সরকারি ব্যানারে-পোস্টারে, জারি হয়েছে লাল সতর্কতা। গণ সচেতনতা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টার চিহ্ন চারদিকে।
কলকাতায় কী হচ্ছে? এখনও 'অজানা জ্বরে' মারা যাচ্ছেন মানুষ। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের 'গোপন সূত্রের' খবর হয়তো কেউ কেউ পেতে পারেন, কিন্তু ডেঙ্গি নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা নেই। স্বাস্থ্য দফতরের 'নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক' এক আধিকারিক বলেছেন, এবছরের অগাস্ট মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা ছুঁয়েছিল ২৩। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে। এও বলছে যে ৩১ অগাস্ট, ২০১৯ পর্যন্ত রাজ্যে ৫,৬৩৯ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘সব পেয়েছির দেশে’ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা
গত রবিবার রাতে পার্ক সার্কাসের ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে মারা যায় তিন বছরের অহর্ষি ধর। কিন্তু তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেও আমরা শুনি, ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা সেই ২৩। আবার স্বাস্থ্য দফতরের আরও এক নাম না জানা আধিকারিক বলছেন, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ।
বোধগম্য হলো কি? হওয়ার কথাও নয়। সমস্যার সমাধান করার আগে সমস্যা যে আদৌ রয়েছে, তা স্বীকার করতে হবে তো। সাধারণ বুদ্ধিতে তো তাই বলে। অথচ শুধু যদি কেন্দ্রীয় সরকারের ধোঁয়াটে হিসেব মেনেই চলা যায়, তাহলেও তো দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গির মরসুম বলে কিছু নেই। জানুয়ারি মাস থেকেই যদি আক্রান্ত এবং মৃতের হিসেব রাখা শুরু হয়, তবে জানুয়ারি থেকেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা হয় না কেন?
গতকাল, অর্থাৎ ২১ নভেম্বর, শোনা গেল যে কলকাতা পুরসভা নাকি তাদের মশা মারা অভিযানে 'ড্রোন' ব্যবহার করবে, এবং পুরসভার ছাদে এই ড্রোনের 'ডেমো' দেওয়া হবে। বলা হলো, শুধুমাত্র কলকাতার আয়তনই যেখানে ৫০ হাজার একরেরও বেশি, সেখানে সর্বত্র লোক পাঠিয়ে মশা মারার ওষুধ স্প্রে করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, এমন অসংখ্য এলাকা রয়েছে, যেখানে বাড়িঘর এমন গা ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে যে তাদের ফাঁক দিয়ে মশা গলে গেলেও মানুষ পারে না, অতএব সেইসব দুর্গম এলাকায় পাঠানো হবে ড্রোন।
প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, কলকাতার আকার আয়তন কি এতদিন অজানা ছিল? নাকি জানা যায় নি ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাবের সময়? আর কিছু না হোক, ডেঙ্গির মশা যে জমা জলে বৃদ্ধি পায়, সেই তথ্য এখন অনেকেরই জানা। বর্ষার পরেই যে বাড়বে ডেঙ্গির প্রকোপ, প্রতিবারই যে তাই হয়, তা বুঝতে কি খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন? তাহলে প্রতি বছর কী করে এই চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েন আমাদের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা? পুর-প্রতিনিধিদের প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, সারা বছরই চালানো হয় ডেঙ্গি প্রতিরোধ এবং সচেতনতা অভিযান। তা সত্ত্বেও প্রতি বছর ডেঙ্গিতে এত মৃত্যু দেখতে হয় কেন? যে অভিযানের নিট ফল চোখে দেখা যায় না, যান্ত্রিকভাবে সেই অভিযান চালিয়ে লাভ কী?
আরও পড়ুন: ‘তাতে আমার কী?’ বলার সময় শেষ
একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, সময়মত ডেঙ্গির চিকিৎসা না করানোয় মৃত্যু হয় অনেকেরই। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, সরকারের সচেতনতা অভিযান ব্যর্থ? অবশ্য সচেতনতা নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। গুগলে ইংরেজিতে 'কলকাতা ডেঙ্গি' লিখে একটা ছোট্ট সার্চ দিয়ে দেখুন, সার্চ সাজেশনের বহর দেখলে বুঝবেন কতটা সুদূরপ্রসারী ডেঙ্গি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা, কী ধরনের সার্চ হয় ডেঙ্গি নিয়ে।
প্রতি বছরই প্রশাসনের হাবভাব এমন, যেন এই সবে ডেঙ্গির দাপট সম্পর্কে অবগত হলেন সবাই। যেন এর আগে কেউ জানতেন না, কখন-কেন-কীভাবে বাড়ে কমে ডেঙ্গির প্রকোপ। উপ-মহানাগরিক (ডেপুটি মেয়র) অতীন ঘোষ দেখলাম বলেছেন, এবছর পুজোর পর আচমকা বেড়েছে ডেঙ্গির দাপাদাপি। স্বাভাবিক, কারণ এবছর বৃষ্টি হয়েছে পুজোর আগে-পরে। অতএব বেড়েছে জল জমার সম্ভাবনাও। কিন্তু পুরসভা যথারীতি অপ্রস্তুত, সুতরাং প্রতিরোধ ক্ষমতা তলানিতে।
একটাই কথা ঘুরেফিরে, প্রতিবারই নতুন করে ব্যবস্থা নিতে হবে কেন? এত বছর পরেও কোনও পাকাপাকি বন্দোবস্ত করা গেল না? কোনও অ্যাকশন প্ল্যান নেই, যা বছরভর চালু থাকে? অবশ্য সরকারিভাবে ডেঙ্গির উপস্থিতিই যেখানে স্বীকার করা মুশকিল, যেখানে ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেঙ্গি লিখলে বদলি হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকেন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, সেখানে অ্যাকশন প্ল্যানের আশা করা বাতুলতাই। চেনা পরিচিত মহলে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, ডেঙ্গি হলে কোন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবেন, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। অথচ বছরের পর বছর এই পরিস্থিতি মেনে নিতে হচ্ছে সকলকেই।
পরিশেষে, একটু আগেই আমার ফোনে রাজ্য সরকারের 'আহারে বাংলা' খাদ্য উৎসব সংক্রান্ত একটি এসএমএস পেলাম। উৎসবের বিজ্ঞাপন, বেশ বিশদ বিবরণ। মনে পড়ে না, পুরসভার তরফে ডেঙ্গি বা তার মোকাবিলা সংক্রান্ত একটিও মেসেজ কখনও পেয়েছি বলে।