Advertisment

জন ও স্বাস্থ্য: ডেঙ্গি ও আমাদের ভাবনাচিন্তা

এখন আমাদের হাতে ম্যালেরিয়ার ওষুধ আছে বলে এই রোগ নিয়ে ততটা আতঙ্কে ভুগি না আমরা। অনেক বেশি চেঁচামেচি হয় ডেঙ্গি নিয়ে, কারণ তার ওষুধ নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dengue

ফাইল ছবি (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

আবার ডেঙ্গির মরশুম শুরু হয়ে গেল। এই বাৎসরিক সমস্যাটি আমাদের বহুদিন ভোগাবে এবং ক্রমশ অধিকতর আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠবে। শুধু ডেঙ্গি নয়, একাধিক মশা বাহিত রোগ বছরের এই সময়ে মহামারীর আকার ধারণ করতে সক্ষম। একসময় মহামারী ছিল ম্যালেরিয়া। ম্যালেরিয়ার বিশেষত্ব ছিল এই যে একবার শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলে যকৃতে লুকিয়ে বসে থাকা আর সেখান থেকে বারে বারে রক্তে এসে তাণ্ডব করার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে বহুবার ভোগাত রোগীকে এবং শেষ অবধি অনেকেরই প্রাণ যেত এই তথাকথিত ভালুক জ্বরে। বহু সহস্রাব্দ ধরে এশিয়া-আফ্রিকার মানুষকে এই রোগ এমনই ক্লিষ্ট করেছে যে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে এসব অঞ্চলের মানুষের দেহে কিছু জিনগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। কিছু রক্তের রোগ বিবর্তনের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সুবিধা পেয়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলিতে টিকে গেছে সম্ভবত এই কারণে যে রোগগুলি নিজেরা খারাপ হলেও তাদের দরুন ম্যালেরিয়ার হাত থেকে খানিক সুরক্ষা পাওয়া যায়। একইভাবে সৃষ্ট বা নির্বাচিত হয়েছে বিশেষ রক্তের গ্রুপও।

Advertisment

এখন আমাদের হাতে ম্যালেরিয়ার ওষুধ আছে বলে এই রোগ নিয়ে ততটা আতঙ্কে ভুগি না আমরা। অনেক বেশি চেঁচামেচি হয় ডেঙ্গি নিয়ে, কারণ তার ওষুধ নেই। ওষুধ নেই জাপানি এনকেফালাইটিস (বি) ভাইরাসের জন্যেও। সেই রোগটি নিয়ে হইচই কম হবার কারণ সম্ভবত ভৌগোলিক। গ্রামাঞ্চলে যেসব জায়গায় ধানখেত, জমা জল, শূকর ও গবাদিপশুর উপস্থিতি আছে, সেসব এলাকায় জাপানি এনকেফালাইটিস মহামারী হয়ে উঠতে পারে। মৃত্যু অথবা স্থায়ী স্নায়ুবিকার হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে। কিছু এলাকায় প্রায় প্রতি বছর এনকেফালাইটিস রোগে অনেকের, বিশেষত শিশুদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ডেঙ্গি আজকের মতো ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগে থেকেই বাঙলা বিহার অঞ্চলে এনকেফালাইটিসের প্রাদুর্ভাব ছিল। তবু এ নিয়ে এত আলোচনা হয়নি, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিও হয়নি এতটা। তার প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে জাপানি এনকেফালাইটিস শহরাঞ্চলে তেমনভাবে থাবা বসায় না এর বাহক কিউলেক্স মশার বাসভূমি ও অভ্যাসের কারণে। সোশাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম বা আলোচনাচক্রগুলিতে শহরাঞ্চলের সমস্যা সাধারণত প্রাধান্য পায়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে সত্য।

ডেঙ্গি অবশ্য সত্যিই এই মুহূর্তে গ্রাম শহর নির্বিশেষে এক গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, মূলত এর মারণ ক্ষমতা আর আক্রান্তের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কারণে। কয়েক বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি বড় সমস্যা ছিল না, কিন্তু তখনও চেন্নাই বা দিল্লি শহরে ডেঙ্গি মহামারী হত। অর্থনীতির মতো রোগ ও জীবাণুরও গ্লোবালাইজেশন হচ্ছে। ক্রমশ ভৌগোলিকভাবে ছড়াতে ছড়াতে ডেঙ্গি এখন বাঙলার এক বড় বিপদ। 'বাঙলা' বললাম, কারণ পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশেও এর প্রকোপ প্রবল। ২০১৯ এ সম্ভবত বাঙলাদেশ থেকে জীবাণুটি কাঁটাতার পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসছে, অথচ তার নাম নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাকে কোনো জেল বা ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর উপায় নেই। জীবাণুটির চরিত্রেরও কিছু বদল হয়েছে বা হচ্ছে, যা ব্যাধিটির গতিবিধিকে আরও বেশি দুর্বোধ্য করে তুলছে এবং চিকিৎসার সময় পরবর্তী ধাপের সমস্যার জন্য আগাম ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে।

আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্য পরিষেবা ও নাগরিকত্ব

এই রোগের বাহক এডিস মশার আচরণ ও পছন্দ পরিবর্তিত হবার ফলেও সমস্যা বাড়ছে। এমনিতেই এই মশা দিনের বেলা কামড়ায়, এখন বাড়ির বাইরেও কামড়াচ্ছে। সেখানে না আছে মশারি, না আছে গুডনাইট, অল আউট, কচ্ছপ ধূপ। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সাবধানতা আর যথেষ্ট প্রতিরক্ষা নয় এখন। সমবেত সামাজিক প্রচেষ্টা এবং সরকারি পদক্ষেপের ওপরে আরও বেশি করে ভরসা রাখতে বাধ্য হবে মানুষ, যদিও সমাজ ও সরকার, দুটো ব্যবস্থাই ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে প্রবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক একুশ শতকে।
ডেঙ্গির মতো রোগ আমাদের কিছু প্রশ্ন, চ্যালেঞ্জ ও শিক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করায়, যে শিক্ষা শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুরূহ টেকনিক্যাল কচকচিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সামগ্রিক বিজ্ঞান ও সমাজ ভাবনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

প্রথমত চিকিৎসা বলতে আমরা যা বুঝি, তা এসব রোগের কাছে এসে ধাক্কা খায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসার হবার পর থেকে আমরা চিকিৎসার একটা মডেলকে ধ্রুব বলে ভাবতে শিখেছি। রোগের কারণটি চট করে খুঁজে বের করো এবং তাকে সারিয়ে ফেলো। এই মডেলটির সর্বময়তার ওপরেই নির্ভর করে অন্যান্য সব প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় আধুনিক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিশ্বজোড়া ফার্মাসিউটিক্যাল বাণিজ্য এবং রোগনির্ণয় সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক প্রযুক্তির বাণিজ্যিক স্বার্থও এর সঙ্গে জড়িত। জীবাণুঘটিত রোগের ক্ষেত্রে এই মডেল আমাদের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা মেটায়। সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো সমস্যা বা অঘটনের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শই এরকম একটা মডেল অবলম্বন করে ভাবনাচিন্তা করি। খারাপ ঘটনাটির জন্য দায়ী কে তা খুঁজে বের করো, দোষী সাব্যস্ত করো, শাস্তি দাও, বহিষ্কার করো বা মেরে ফেলো। তাতেই সমস্যা মিটবে বলে আমরা ধরে নিই। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে দায়ী জীবাণুটি চিহ্নিত করো এবং মেরে ফেলো। সামাজিক ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব সরকারের, রোগের ক্ষেত্রে সেই দায়িত্ব চিকিৎসকের। কর্তব্য একটাই, দোষীকে সরিয়ে দেওয়া।

ডেঙ্গির ক্ষেত্রে দোষী জীবাণুটিকে মেরে ফেলার মতো কোনো ওষুধ বা প্রক্রিয়া চিকিৎসকদের আয়ত্বে নেই। শরীরের সঙ্গে জীবাণুর বোঝাপড়া হবে। চিকিৎসার লক্ষ্য শুধুমাত্র রোগের প্রকোপ চলাকালীন শরীরকে নানাভাবে সাহায্য করে যাওয়া, যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে এবং নিজের লড়াইটা লড়তে পারে। এই চিকিৎসাটুকুই বা কীভাবে হবে? প্রত্যেক ডেঙ্গি রোগীকে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে ভর্তি করে প্রবল ইঞ্জেকশন, স্যালাইন, অক্সিজেন, প্লেটলেট দেওয়া হতে থাকবে? না, তার কোনো প্রয়োজন নেই, যদি অনেকের প্রত্যাশার তার এরকম জায়গাতেই বাঁধা, হয়ত সাংস্কৃতিক কারণে। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের যুগে আমরা দেখতে চাই প্রথম ওভার থেকেই ব্যাটসম্যান ধুমধড়ক্কা চার-ছয় মারবে। তেমনই হাসপাতালে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার নার্স সকলে মিলে বড় বড় সিরিঞ্জ হাতে রোগীর ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে আমাদের মনে হয়, বুঝি কোনো চিকিৎসাই হচ্ছে না।

আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: পরিবেশ ও চিকিৎসকের দায় দায়িত্ব

অথচ বেশিরভাগ ডেঙ্গির ক্ষেত্রে এসবের প্রয়োজনই নেই। রোগীর পরিবারের চাপে পড়ে অপ্রয়োজনে প্লেটলেট দিলে রোগীর ক্ষতিই হবে। এমনকি স্যালাইনও সকলের প্রয়োজন নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করাই চিকিৎসকের একমাত্র কাজ। জ্বর কমাতে সামান্য প্যারাসিটামল, রোগীকে জল খেতে উৎসাহ দেওয়া, এটুকুই অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট। আর কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা। প্লেটলেট খুব কমে গিয়ে রক্তপাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে, রক্তচাপ দারুণভাবে কমে গেলে বা অন্য কোনো জটিলতা দেখা দিলে তবে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিকিৎসা করার প্রশ্ন। কিছু ক্ষেত্রে আবার সর্বশক্তি দিয়ে চিকিৎসা করেও রোগীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয় না রোগের জটিলতা তেমন মারাত্মক হলে। এই ব্যাপারটা মেনে নিতে আমাদের খুবই অসুবিধে হয়। আমরা ভিজিলেন্সকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না, 'কাজ' দেখতে চাই। তাই চিকিৎসক যখন রোগীকে বিরাট কোনো ওষুধ না দিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন মন দিয়ে, তখন তাঁর চুপচাপ থাকাকে নিশ্চেষ্টতা মনে হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে যদি আচমকা জটিলতা দেখা দেয় এবং তা এতটা ভয়াবহ হয় যে সেই সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দিয়েও রোগীর প্রাণ বাঁচানো গেল না, তাহলে মনে হতে পারে যে বিনা চিকিৎসায় রোগীকে মেরে ফেলা হল। এই আবেগের মধ্যে কোনো অপরাধ নেই, কিন্তু আমাদের ভাবনার ধরণটি সম্বন্ধে সচেতন হওয়া প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমরা বৈজ্ঞানিক সত্যকে আরও মন খুলে গ্রহণ করতে শিখি।

রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এরকম একটি ক্ষেত্র আছে। নিজের জন্য ভালো খাবার, পরিপাটি ঘরদোর, জমানো টাকা, ইনসিওরেন্স এবং দামী হাসপাতালের ব্যবস্থা রেখে স্বাস্থ্যের বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকার একটা শিক্ষা আমরা পেয়েছি সামাজিক শিক্ষা আর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এই মডেলটাও এখানে ধাক্কা খায়। সমাজ ও সরকার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা ক্রমশ কমছে। নিজেকে বিল মেটাতে না হলে আমরা বিদ্যুৎ বা জলের অপচয় রোখার চেষ্টাও করি না। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার প্রতিবেশী যদি জল জমিয়ে না রাখার সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুভব না করেন, তবে আপনার ডেঙ্গি হতে পারে। শুধু খোলা ট্যাংক, গামলা বা চৌবাচ্চাতে জমা জল নয়, যে থার্মোকলের গ্লাস বা বাটি না ভেঙে ছুড়ে ফেলে দেন এদিক-সেদিক, তার মধ্যে জমা বৃষ্টির জলেও মশার চাষ হয়ে থাকে। আমাদের সকলের সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরুত্ব বুঝতে কিছুটা সাহায্য করে এসব মহামারী।
সরকারের ওপর ভরসা রাখতে বাধ্য ধনী দরিদ্র সব নাগরিক। মশক নিরোধক ব্যবস্থা, সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা অব্দি অনেক কাজ সরকারের। সেসব বিষয়ে সম্পূর্ণ আলোচনা আজ সম্ভব নয়। আজ এটুকু বলতে চাই যে সরকারের সদিচ্ছা, আগ্রহ, তৎপরতা এবং সততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগ ও মৃত্যু প্রতিরোধে সরকার সফল হতে পারেন বা ব্যর্থ, কিন্তু তাঁরা ব্যর্থতা থেকে কী শিখছেন, তা প্রধান বিবেচ্য। কোনো মহামারীর সঠিক পরিসংখ্যান পরবর্তী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। "অজানা জ্বর" নাম দিয়ে ডেঙ্গির প্রকোপকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করলে সমগ্র প্রক্রিয়াটিকেই পিছিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে ভুগতে হয় পরের বছরেও। ব্যর্থতায় ততখানি লজ্জা নেই, যতটা আছে সরকারি ব্যর্থতা আর মানুষের কষ্ট ধামাচাপা দেবার অসৎ প্রচেষ্টায়।

Jon O Swasthyo Dengue
Advertisment