Advertisment

সরকার বা দেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়

এই যে উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে সীমান্তে সমস্যা জিইয়ে রাখা এবং প্রয়োজনে তা কাজে লাগানো এই যে পদ্ধতি তা প্রজাতন্ত্রের যে আত্মা সেখান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Kamaleswar Mukherjee on Republic Day significance

প্রতীকী ছবি।

Kamaleswar Mukherjee

Advertisment

রিপাবলিক শব্দটার মানে যদি আমরা ধরতে চাই তাহলে সেটা হল প্রজাতন্ত্র। এখন এই প্রজাতন্ত্রের সূত্রপাত যদি তাহলে গ্রিক এবং রোমান এম্পায়ারে এর প্রতিষ্ঠা দেখব। সিজেরোর লেখায় প্রথম রিপাবলিক শব্দটা আসে এবং অ্যারিস্টটলের লেখাতেও রিপাবলিক শব্দটি পাওয়া যায়। তৎকালীন দিন থেকেই গ্রিস এবং রোমে এই প্রথা চালু হয়েছিল। সরকার বা দেশ কারুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সরকার বা দেশ হল প্রজার সম্পত্তি। প্রজা ঠিক করবেন সেখানে কী করতে চলেছেন। সাধারণত ডেমোক্রেসি বা অলিগারকিয়ার পর আমরা রিপাবলিকে পৌঁছতে পারি। ভারতবর্ষেও প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব সিক্সথ সেঞ্চুরি থেকে ফোর্থ সেঞ্চুরি অবধি এমন রিপাবলিক পাওয়া যেত যাকে বলা হয় গণসংঘ বা মহাজনপদ।

সেই জায়গা থেকে রিপাবলিক বিষয়টির উৎপত্তি, যা সরাসরি কিংডম বা মোনার্কির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, অর্থাৎ কি না রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সে কথা মাথায় রেখেই ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হল তখন ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল রিপাবলিক ডে হিসাবে, কারণ সেই দিন ঘোষণা হয়েছিল যে ভারতবর্ষ একটা প্রজাতান্ত্রিক দেশ। ১৯২৯ সালে যেদিন পূর্ণ স্বরাজের আহ্বান করা হয়েছিল সেই দিনটিকেই রিপাবলিক ডে পালনের জন্য স্থির করা হয়েছিল। এরপর ৭০ বছর কেটে গিয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি এই প্রজাতন্ত্র দিবসে খুব বড় কুচকাওয়াজ হয়। সারা দেশজুড়ে পালিত হয় এই দিনটি। কিন্তু মুস্কিল হল যে ধীরে ধীরে এই প্রজাতন্ত্র যেন ভারতবর্ষ থেকে তার মূল হারাতে শুরু করেছে। আবার বোধহয় আমরা অলিগার্কি বা মোনার্কির দিকে ফিরে যেতে শুরু করেছি। কারণ আজকের শাসকের যে ব্যবহার, যে অভিব্যক্তি তা থেকে মনে হচ্ছে কোথাও তাঁরা রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। আমরা এক্ষেত্রে বলতে পারি যে, আমাদের স্বাভাবিক যে বিবর্তনজনক প্রগতি সেই প্রগতি কোথাও পথ হারিয়েছে এবং প্রত্যাগমনের যেন সূচনা হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রস্তাবনা বলতে কী বোঝায়? ভারতীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব কী?

আমাদের ভারতবর্ষকে আমরা আগে থেকেই বলতাম আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্র, যার মধ্যে উপনিবেশবাদ খুব দৃঢ়ভাবে প্রোথিত রয়েছে। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ সেই সামন্ততন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছিল। একটা সময় আমরা ভারতীয় সংবিধানের উপস্থাপনার মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি যে ভারতবর্ষ হচ্ছে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ কথাদুটি পরবর্তীতে সংযোজিত হয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, একটা ধর্মনিরপ্রেক্ষ রাষ্ট্র এবং অবশ্যই একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু তারপর আজকের দিনে যখন চারপাশ দেখছি যে ধর্ম, জাতি এবং লিঙ্গ এই তিনটে বিষয়ে ভেদাভেদ তৈরি করা হচ্ছে মানুষে-মানুষে, তখন আমরা বুঝতে পারছি যে কোথাও আমরা আবার ওই সংবিধানে বর্ণিত শব্দগুলো হারিয়ে ফেলে আমরা ভারতবর্ষেরই একটা বিশাল অংশের মানুষ তাঁরা হিন্দু রাষ্ট্রের সন্ধান করছেন। রাম রাজ্য প্রতিষ্টা করতে চাইছেন।

সুতরাং আজকের প্রজাতন্ত্র দিবসে বসে পরিস্থিতিটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর, প্রতিকূল এবং অসহনীয় হয়ে উঠছে যারা আমরা সামন্ততান্ত্রিক, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ থেকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম। তবে এটা প্রথমবার নয়, এর আগেও গেরুয়া ঝড় এসেছে দেশে, কিন্তু তখনের চেয়ে আজ অবস্থা এতোটা প্রতিকূল তার কারণ হল যে ১৯২৫ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখনই তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মতো দল। ১৯৪৮ সালে ছাত্র আন্দোলনের স্বার্থে তৈরি করা হয়েছিল অখিল ভারতী বিদ্যার্থী পরিষদ। তখন থেকেই তাঁদের একটা এজেন্ডা ছিল। প্রাক স্বাধীনতা যুগ থেকেই তাঁরা কোথাও ডানপন্থী ভাবনাচিন্তা তৈরি করতে শুরু করেছিল। তবে ভারত পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হলেও ভারতবর্ষ প্রথম থেকেই ভেবে নিয়েছিল যে ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরি হবে। কারণ যে অংশ ভেঙ্গে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল সেখানে জনসংখ্যার বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু যে সকল মুসলিমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে, কমিউনিস্ট আন্দোলন, অন্যান্য সশস্ত্র আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাদের অনেকাংশে নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির মধ্যেও ছিলেন, তাঁরা কিন্তু ভারতবর্ষ ছেড়ে এতে চাননি। তাই হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি হলে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আমার প্রাথমিক প্রশ্ন যেটা হত সেটা হল সেক্ষেত্রে যারা হিন্দু নন, তাঁরা ব্যতীত অন্যান্য সম্প্রদায় এবং নাস্তিকেরা কি ভারতবর্ষে থাকতে পারবেন না? দ্বিতীয়ত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় দিয়ে বিচার হবে রাষ্ট্র হিন্দু হবে না মুসলিম? সেদিক থেকে বিচার করলে তো ইউরোপ, আমেরিকার বহু রাষ্ট্রের খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হওয়া উচিত ছিল। আর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বহু রাষ্ট্রকে বৌদ্ধ রাষ্ট্র হতে হত। তা তো হয়নি। সুতরাং ভারতবর্ষেও এটা কোনদিন কাম্য ছিল না।

ভারতবর্ষ যখন তৈরি হয়েছে তখন কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলোও আমাদের সঙ্গে এসে হাত মিলিয়েছে। তা থেকেই বলা যায় যে ভারতের এই হিন্দুরাজ্যের কল্পনাটা সম্পূর্ণ ভুল। এটা আমি বলছি প্রজাতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে। আর নিজের মতাদর্শ বা বামপন্থা দিয়ে যদি বলি তাহলে আমার প্রশ্ন হল মানুষে মানুষে কোনও বিভেদই আমরা মানব না। সেটা শুধুমাত্র ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ, এমনকী শ্রেণিদ্বন্ধও মানব না। তা নিয়ে যাবতীয় আন্দোলন বা সংগ্রাম আমরা করব। হিন্দুরাজ্য আমার কাছে কোনও যৌক্তিকতা রাখে না।

আরও পড়ুন: নাগরিক সরকার নির্বাচন করে, না সরকার নাগরিক?

ধর্মকে বাদ রেখেই সারা পৃথিবীতে বদল আনা সম্ভব। কারন ধর্ম কোনও প্রাকৃতিক নিয়ম নয়। ধর্ম মানুষের তৈরি করা একটা মতামত। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের অন্তর্গত প্রবৃত্তিও নয়, পুরোটাই শিক্ষা। যেহেতু জন্মগত নয়, তাই সঠিক শিক্ষা মানুষকে ধর্ম থেকে বের করে আনতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। পাশপাশি বামপন্থী সরকার এ রাজ্য থেকে সরে দাঁড়তেই ধর্মীয় সংঘাত ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বাবরি মসজিদের ঘটনা মাথায় রেখেই বলছি ২০১১ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় অস্থিরতা দেখা যায়নি। ১৯৯০ থেকে যখন মার্কসীয় দর্শনের পশ্চাদসরণ হল বলে আমার মনে হয় তখন সারা পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক উদারনীতি এলো তখন থেকেই পৃথিবীর ভারসাম্যে বদল এল। বাজার অর্থনীতি দিয়েই চালিত হতে লাগল দেশগুলি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা কিন্তু খুব একটা ভালো জায়গাতেও পৌঁছয়নি। আজকে আমরা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যে এক জায়গায় পুঁজির কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া, অ্যায় ব্যায়ের ব্যবধান এই বিষয়গুলি আরও সামনে আসছে।  ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ৩৪ শতাংশ, বেকারত্ব বাড়ছে এবং  অর্থনীতিও প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এছাড়া পৃথিবীজুড়ে একনায়ক শক্তির ক্ষমতাবৃদ্ধির ফলে মানুষের প্রবৃত্তিও গনগনে হয়ে উঠছে। তবে আজকের প্রজন্ম কিন্তু আমাদের থেকে চিন্তাভাবনায় অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে উঠছে। সেই কারণে এই পরিস্থিতিতে ছাত্র সমাজই কিন্তু মূল শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাম ধারাকে বজায় রাখা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বামেদের ক্ষমতা প্রসারণ সেটা কিন্তু ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে থেকেই উঠে আসছে।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে তবে যুব সমাজ যা করছে তা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়? উত্তর হল রাষ্ট্র কিন্তু মানুষের তৈরি করা সঙ্গবদ্ধ জীবনের প্রতিরূপ। রাষ্ট্র মানে রাষ্ট্রযন্ত্র নয় যে যাদের নির্বাচনে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে তাঁদেরকেই নিপীড়ন করবে। রাষ্ট্র মানুষের জন্য তৈরি হয়, মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়। সেই কারণে আজ প্রজাতন্ত্র দিবস সেই আকর্ষণ হারিয়েছে। এ যেন কেবল একটা মিলিটারি কুচকাওয়াজ। একটা পরিচালিত নিয়মের মধ্যে ঘটে, যার সঙ্গে মানুষের আত্মিক কোনও সম্পর্ক নেই। সেই কারণেই আজকের প্রজাতন্ত্র দিবস আমাকে সেই আনন্দ দেয় না, আমাকে দেশের কথা মনে করাচ্ছে না। এখনের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা যিনি করতে পারতেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। এই যে উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে সীমান্তে সমস্যা জিইয়ে রাখা এবং প্রয়োজনে তা কাজে লাগানো এই যে পদ্ধতি তা প্রজাতন্ত্রের যে আত্মা সেখান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। আগে ছোটোবেলায় টিভিতে কুচকাওয়াজের এই মহড়া দেখতাম। এখন বয়সের ভারে তা আমাকে আকর্ষণ না করলেও  নতুন প্রজন্মকে কিন্তু আজকের প্রজাতন্ত্র দিবস আকর্ষণ করছে না। ৭০ বছরের প্রজাতন্ত্রে যখন দেখি না পাওয়ার তালিকাটা খুব বেশি সেই কারণে হারিয়ে যাচ্ছে সেই শ্রদ্ধা। হিংসা, হানাহানির কারণে যখন সমাজ ভাঙছে, অর্থনীতি ভাঙছে, সেখানে মিলিটারি বিউগল, অভিবাদন আজকের দিনে খুব দৃষ্টিকটু লাগছে।

অনুলিখন: দেবস্মিতা দাস

Republic Day 2020 kamaleswar mukharjee
Advertisment