Advertisment

দীপাবলির সুখ ও অসুখ

শব্দবাজি মাইকের জোরালো বাজনার চেয়েও বেশি ক্ষতিকারক, কারণ এর শব্দ আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত। এর ফলে শরীর কোনোভাবেই শব্দটির সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারে না বা শব্দটি আসবে বুঝে তার জন্য প্রস্তুতও হতে পারে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
diwali pollution

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

দীপাবলি পালিত হয় হিমেল কার্তিকের অন্ধকারতম রাতে। আলোর উৎসব দীপাবলি। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অশুভের বিরুদ্ধে শুভের, অজ্ঞানতাকে সরিয়ে জ্ঞানের বিজয়ের প্রতীকী উৎসব। এই আলোর উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন দেবীর পূজা (কোথাও লক্ষ্মী, কোথাও কালী), পূর্বজদের প্রেতেদের স্বর্গে ফেরত পাঠানোর তাড়াহুড়ো, নানারকম মিথ ও ইতিহাস। সেসব আলোচনা মনোগ্রাহী, কিন্তু দীর্ঘ ও জটিল। আমরা সামান্য স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আলোটুকুর দিকে নজর দেবো। আর ধোঁয়ার দিকে। শব্দের দিকে।

Advertisment

স্বাস্থ্যকর্মীর দৃষ্টিতে দীপাবলির উৎসবটি দেখতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় নজর কেড়েছে। উৎসবটির একটি লোকায়ত দিক আছে, যা ঘরদোর, পোকামাকড়, পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য ইত্যাদির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিতে সাধারণ মানুষের এই আটপৌরে লোকায়ত অনুষ্ঠানগুলি ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ধনত্রয়োদশীর দিন ধনীরা সোনা কেনেন, কেউ কেনেন অন্য কোনো ধাতু। বিহার বাঙলা সহ পূর্বভারতের বিরাট অঞ্চলে ওই দিনটিতে নতুন ঝাঁটা কেনার চল। এবছরও শুক্রবার সন্ধেবেলা হাওড়া-লিলুয়ার বহু জায়গায় ঘুরে দেখলাম, বিক্রি হচ্ছে লক্ষাধিক ঝাঁটা। ধর্মীয় ব্যাখ্যা বলবে দেবী লক্ষ্মীর (বা দক্ষিণা কালীর) আগমনের আগে ঘর পরিষ্কার করার তাড়া।

আরও পড়ুন: আলোর উৎসবে কলকাতায় তুবড়ি ফেটে মৃত শিশু সহ দু’জন

কৃষি উৎপাদনের সময়কাল ও তার সঙ্গে জড়িত গ্রামীণ অর্থনীতির কথা খেয়াল রাখলে মনে হয়, এ আসলে আসন্ন অগ্রহায়ণ পৌষের জন্য প্রস্তুতির সূচনা। পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শুরু। চতুর্দশী থেকে প্রতিপদ অবধি নানা কারণে অগুন্তি ছোটছোট আগুন জ্বালিয়ে বর্ষার শেষ থেকে বেড়ে ওঠা পোকাগুলোকে যথাসম্ভব আত্মাহুতিতে প্ররোচিত করা প্রয়োজন। এরপর পাকতে শুরু করবে আমন ধান। গোলাবন্দী করতে হবে সম্বচ্ছরের ফসল। অত পোকার পেট ভরানোর পর মানুষের জন্য থাকবে কী? ঘর-উঠোন সাফ করে রাখাও জরুরি… উৎসব, ধান আর স্বাস্থ্যের কারণে।

অন্যদিকে আগুনের অতিব্যবহারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দূষণের প্রশ্ন। উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় শীতকালে আগাছা জ্বালানোর জন্য জমিতে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার যে রীতি প্রচলিত আছে, তাও গুরুতর পরিবেশ দূষণ ঘটায়। দীপাবলিতে আজকাল প্রদীপ বা মোমবাতি ছাড়াও ব্যবহৃত হয় বিপুল পরিমাণে বারুদ এবং নানা ধরনের রাসায়নিক মশলা। নানা ধরনের বাজি থেকে ঘটে চলে বিভিন্নরকম দূষণ। মানুষের বসতি অঞ্চলে শরীরের খুব কাছে বাজি পোড়ানো হয় বলে স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সরাসরি, এবং ব্যাপকভাবে।

প্রথমেই শব্দবাজির কথা ধরা যাক, যার বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু সামাজিক আন্দোলন হয়েছে এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। শব্দবাজি বায়ুদূষণ ছাড়াও যে বিশেষ ধরণের দূষণ ছড়ায়, তা হলো শব্দদূষণ। সহসা প্রাণ কাঁপানো শব্দ। আপনার প্রিয় বুড়িমার চকোলেট বোমাটির কারণে আপনার শ্রদ্ধেয় সিধু জ্যাঠা হৃদরোগ বা বধিরতায় আক্রান্ত হতে পারেন। জোরালো শব্দবাজি মাইকের জোরালো বাজনার চেয়েও বেশি ক্ষতিকারক, কারণ এর শব্দ আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত। এর ফলে শরীর কোনোভাবেই শব্দটির সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারে না বা শব্দটি আসবে বুঝে তার জন্য প্রস্তুতও হতে পারে না। এমন শব্দের কুপ্রভাব পড়ে কানে, স্নায়ুতন্ত্রে এবং হৃদপিণ্ডে।

আরও পড়ুন: আত্মহনন ও প্রতিরোধ

শব্দ উৎপন্ন হয় কম্পন থেকে, এবং তা প্রবাহিত হয় তরঙ্গের আকারে। হঠাৎ খুব জোরে শব্দ হলে যে পরিমাণ কম্পনের সৃষ্টি হয়, তার ফলে আশেপাশের বাতাসে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব প্রায় বিস্ফোরণের মতো। কানের খুব কাছে দুম করে এরকম বিস্ফোরণ হলে তার তরঙ্গের অভিঘাতে কানের ভেতরের বাতাস থেকে হাড়গোড়, সবকিছু কেঁপে ওঠে। এর ফলে কানের পর্দা (টিম্প্যানিক মেমব্রেন) ফেটে যেতে পারে। আরও মারাত্মক ক্ষতি হয়, যদি পর্দা না ফেটে তরঙ্গটি মধ্যকর্ণের তিনটি ক্ষুদ্র অস্থিকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে তোলে। এর ফলে অন্তঃকর্ণের 'কক্লিয়া' নামক মূল শ্রবণযন্ত্রটি মারাত্মকরকম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এভাবে স্থায়ী এবং চিকিৎসার অযোগ্য বধিরতার শিকার হতে পারেন ভুক্তভোগী।

কক্লিয়ার পাশেই থাকে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার যন্ত্র, যার মধ্যে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল একেক কানে তিনটে করে সেমিসার্কুলার ক্যানাল। এদের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে কক্লিয়ার বহু মিল এবং এরাও শব্দবাজির দ্বারা একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে তাৎক্ষণিকভাবে চরম মাথা ঘোরা অথবা শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে হাঁটাচলায় স্থায়ী সমস্যা হতে পারে।

বারবার চমকে যাওয়ার ফলে স্নায়ুতন্ত্রে এবং হরমোনের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তনের সৃষ্টি হয়। এসবের কারণে মাথাব্যথা, শারীরিক অবসাদ থেকে শুরু করে প্রাণঘাতী রোগও হতে পারে। শব্দবহুল দীপাবলির রাতে অনেক বয়স্ক মানুষ স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পশুরা এই ধরণের উৎকট অপ্রাকৃত শব্দে অভ্যস্ত নয়। তাদের জীবনে জোরালো শব্দ সাধারণত হিংস্র শিকারী পশু, বজ্রপাত ইত্যাদি মৃত্যুদূতের আগমনের সূচক। কখনোই আনন্দের বার্তা বহন করেনি বহু কোটি বছরের ইতিহাসে। তাই তারা এরকম শব্দকে ভয় পেতে শিখেছে বিবর্তনের পথে। গৃহপালিত পশুরা দীপাবলির রাতে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে।

আরও পড়ুন: নারী ও চিকিৎসাবিজ্ঞান

শব্দ না করা বাজিরাও একান্ত নিরীহ নয়। সবরকম বাজি থেকেই বেরোয় বিষাক্ত ধোঁয়া। তার দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূলত চোখ ও ফুসফুস। রাসায়নিকের প্রভাবে ক্ষতি হতে পারে অন্যান্য অঙ্গেরও। বাজির ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইওক্সাইড জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস থাকে। বিভিন্ন বাজির মধ্যে কার্বন ও সালফার যৌগ ছাড়াও গুঁড়ো লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম অক্সালেট, আর্সেনিক ও অ্যালুমিনিয়াম যৌগ, বেরিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম পারক্লোরেট ইত্যাদি বিভিন্ন রাসায়নিক থাকে। এগুলির বিক্রিয়ায় রঙ, বিচিত্র স্ফুলিঙ্গ ইত্যাদি যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনই তৈরি হয় স্বাস্থ্যনাশা ধোঁয়াও। সেসব ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করলে বিশেষত হাঁপানি বা ব্রংকাইটিস রোগীদের প্রবল শ্বাসকষ্ট হতে পারে। হৃদরোগের সম্ভাবনাও থাকে।

অনেকক্ষণ এই ধোঁয়ার মধ্যে থাকলে কোষে অক্সিজেনের ঘাটতিজনিত সমস্যা হবে, মাথা ধরবে। অনেকটা ধোঁয়া ফুসফুসে গেলে কিছু ক্ষেত্রে পরবর্তী দুই-তিন দিনের মধ্যে অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম নামক প্রাণঘাতী ফুসফুসের রোগ হতে পারে, যার দরুন রোগীর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র (ভেন্টিলেটর) প্রয়োজন হতে পারে।

এইসব রাসায়নিক বাষ্প চোখে লাগলে চোখ জ্বালা করে এবং চোখের জলের ওপরের স্নেহজাতীয় পদার্থের স্তরটি নষ্ট হবার ফলে চোখ শুকনো ও লাল হয়ে যায়। এমন হলে পরিষ্কার জল বা কৃত্রিম চোখের জল ড্রপ দিয়ে চোখ ধোয়া যেতে পারে। আগে থেকেই চোখে গগলস পরে নেওয়া যেতে পারে, যদিও রাতে গগলস পরে টিটকিরি খাওয়ার সম্ভাবনা। ধোঁয়া থেকে মুখ-চোখ দূরে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

বাজির আগুনে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও নেহাৎ কম নয়। হাত-পা, মুখ, এমনকি চোখ পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। খুব সাবধানে শরীর থেকে দূরে রেখে বাজি পোড়ানো উচিত। পোশাকে আগুন ধরে গেলে অনেক বড় মাপের ক্ষতি হতে পারে, তাই সিল্কের পোশাক, ঢিলে বড় ঝুলওয়ালা পোশাক পরে বাজি না পোড়ানোই ভালো। কোনো জায়গা পুড়ে গেলে তৎক্ষনাৎ কলের জলের তলায় সেই অংশটিকে রেখে কিছুক্ষণ ধোয়া উচিত। এতে জায়গাটির উত্তাপ জলের ছোঁয়ায় কমতে থাকে এবং ক্ষতি কম হয়। পোশাকে আগুন লাগলেও জল ঢেলে নেভানোই ভালো। দেহের অনেকটা পুড়ে গেলে আগুন সম্পূর্ণ নিভে যাবার পর কম্বল চাপা দেওয়া উচিত, নইলে রোগীর দেহের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাওয়ার ভয় থাকে। বড়দের শরীরের কুড়ি শতাংশ এবং বাচ্চাদের দশ শতাংশ পুড়ে গেলে অথবা চোখ, মুখ বা যোনি অঞ্চলে দাহ থাকলে হাসপাতালে অবশ্যই ভর্তি করা কর্তব্য।

আরও পড়ুন: ঋতু, নারী ও আমরা

বাজির মতোই দেওয়ালির মিষ্টিও খানিক গোলমেলে। এই সময়ে এত বেশি মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হয়, যে তার গুণমান বজায় থাকে না। তাছাড়া উপহার দেওয়ার জন্য তৈরি বেশ কিছু মিষ্টিতে রঙ দেওয়া থাকে, যা প্রায়শই স্বাস্থ্যের পক্ষে হিতকর নয়। এধরনের মিষ্টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না হলেও কম খাওয়া ও খাওয়ানোই হিতকর।

বাজির অপকারের কথা আলোচনার সময় মনে রাখা দরকার বাজি শ্রমিকদের কথা। আমাদের বাজি পোড়ানোর ওপর যেমন নির্ভর করছে এঁদের জীবিকা, তেমনি বাজির মধ্যে ঠাসা যাবতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক এঁরা মাসের পর মাস ঘাঁটছেন, শুঁকছেন। এঁদের স্বাস্থ্যকে এসব রাসায়নিকের কুপ্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্য বৈজ্ঞানিক সুরক্ষা ব্যবস্থা সব বাজি কারখানায় কঠোরভাবে বলবৎ করা সরকারের কর্তব্য। আতসবাজি শিল্প ছিল শিশুশ্রমের অপব্যবহারের জন্য কুখ্যাত। আইনের প্রয়োগে এইদিক থেকে কিছু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করা দরকার। যেসব জায়গায় কাজ করার ফলে শিশুশ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার একটা হলো বাজির কারখানা।

যতই জ্ঞানগর্ভ সাবধানবাণী শোনানো যাক না কেন, মানুষ উৎসবে মাতবেন এবং বাজি পোড়াবেন। আইন করে বাজির ব্যবহার একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করবে। সুতরাং কম দূষণ সৃষ্টি করে, এমন আতসবাজি তৈরির গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া বা বিনিয়োগ করা একটা ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। পাশাপাশি দীপাবলির আলোয় আমরা আমাদের মনের অমাবস্যা দূর করতে পারি। শিখতে পারি নিজের, অপরের এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন থেকে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার পদ্ধতি। চারিদিক আলোয় আলো হোক। আমার আলোর আগুনে কারো ঘর যেন অন্ধকার না হয়।

Diwali Pollution
Advertisment