Advertisment

ঘরোয়া হিংসার শিকার পুরুষও, তবে কেন আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত?

সাম্প্রতিক কালে জনৈক বাংলা খবরের চ্যানেলে প্রদর্শিত একটি ভিডিও দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠেছেন তামাম দর্শককুল। কলকাতার সল্টলেক অঞ্চলে স্বামীকে বেধড়ক মারছেন স্ত্রী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
domestic violence mens rights

কালীঘাটের পটচিত্র, ১৮৭৫ সাল। সৌজন্যে: উইকিপিডিয়া

ঘরোয়া হিংসা। শুধু কি মহিলারাই এর শিকার? ঘটনাক্রম ও পরিসংখ্যান বলছে, এই তথ্য সঠিক নয় ! পুরুষরাও এর শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন। সাম্প্রতিক কালে জনৈক বাংলা খবরের চ্যানেলে প্রদর্শিত একটি ভিডিও দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠেছেন তামাম দর্শককুল। কলকাতার সল্টলেক অঞ্চলে স্বামীকে বেধড়ক মারছেন স্ত্রী। অপরাধ, ভদ্রলোক তাঁর বাবা-মাকে নিজেদের সঙ্গে রাখতে চেয়েছেন। প্রহার, তার সঙ্গে সিগারেটের ছ্যাঁকা। স্বামী ভদ্রলোক চেষ্টা করছেন বাধা দেওয়ার, বোঝাবার। কিন্তু মহিলার কোনও হেলদোল নেই। তিনি মেরেই চলেছেন। একই সঙ্গে হাত-মুখ দুটোই চলছে। এই ভিডিওটি দেখার পর ঘরোয়া হিংসা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বদলে যেতে বাধ্য। বরং এটাই প্রকট হবে, অত্যাচারীর ভূমিকায় স্ত্রীরাও কিছু কম যান না।

Advertisment

তাহলে আইন কেন শুধু মহিলাদের পক্ষে?

তার আগে প্রচলিত ধারণা নিয়ে কিছু কথা। মহিলাদের ওপর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের অত্যাচারের ঘটনা বহুকাল ধরেই জনসমক্ষে আসছে। এর জন্য সামাজিক প্রতিবাদ থেকে আইনি সুব্যবস্থা, কোনওটারই অভাব নেই। উল্টোদিকে পুরুষরা অত্যাচারিত হলেও, লজ্জায় গোপন রাখার প্রবণতার ফলে বিষয়টা সেভাবে জানাজানি হয় না।

বলা বাহুল্য, এই প্রবণতাও এক ধরণের সামাজিক বৈষম্য থেকে উদ্ভূত। শৈশব থেকেই ছেলেদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তারা কাঁদবে না, তারা যন্ত্রণা গোপন করবে। নচেৎ তাদের পুরুষত্বে কালি লেগে যাবে। এইসব বিভ্রান্তি থেকেই পুরুষরাও দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের প্রতি ঘটে চলা অন্যায়-অবিচার নির্বিবাদে সহ্য করার ফলে সমাজ জানতেই পারেনি তাঁদের কথা। পরিসংখ্যান বলে, বিবাহিত পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় অনেক বেশি। তবে সেসব নিয়ে মিডিয়া তেমন সোচ্চার হয় না, এই যা। এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিক এই ঘটনার মূল্যায়ন করলে এটাই মনে হয়, আইনেই বা এই বৈষম্য কেন? সমাজ জাগ্রত নয় বলে?

আরও পড়ুন: ‘কালো’ বনাম ‘ফর্সা’: সমাজ কি নেবে এই চ্যালেঞ্জ?

কথা বলছিলাম আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতার সঙ্গে। যেটা জানা গেল, প্রথমত, আইনটাই হলো 'প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স'। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে, মহিলারাই শুধুমাত্র গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। তাই তাঁদের সুরক্ষার জন্যই আইনের প্রয়োজন। অপরাধীর কাঠগড়ায় তাদের দাঁড় করানো যাবে না। একজন মহিলা আর এক মহিলার (শ্বাশুড়ি/ননদ/জা ইত্যাদি সম্পর্কিত) বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ জানাতে পারেন। স্বামীর বিরুদ্ধে তো পারেনই। কিন্তু এই আইন একজন পুরুষকে সেই অধিকার দেয় না। "এক্ষেত্রে একজন পুরুষ সাধারণ অপরাধ আইনে পুলিশের কাছে অভিযোগ ও সেই অনুসারে আদালতে মামলা করতে পারেন। আইন তাঁকে সেই সুযোগ দিয়েছে। এর অনেক রকম ধারা-উপধারা রয়েছে। সল্টলেক কান্ডেই তো ওই মহিলার বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে ও পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে," জানান অনির্বাণ।

অর্থাৎ অভিযোগটা আপনাকে করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের অন্যদেরও সচেতন হতে হবে। আইন-প্রশাসনের দরজায় বিষয়টা নিয়ে যেতে হবে। সেখানে যদিও এখনও কিছু পুরোনো ভাবনা রয়ে গেছে, বললেন অনির্বাণ। 'মহিলারাই ঘরোয়া হিংসার শিকার', এই ধারণাটা অচলায়তন হয়ে আটকে গেছে তাদের মাথায়। তবে আশার কথা, ধীরে ধীরে হলেও পরিবর্তন হচ্ছে। থানাগুলো এখন পুরুষের অভিযোগ আগের তুলনায় বেশি শোনে। প্রসঙ্গত, আইনের মাধ্যমে যদি ঘরোয়া হিংসার ক্ষেত্রে পুরুষের প্রতি সুবিচারের জায়গাটা একইভাবে আনতে হয়, তাহলে কী করণীয়? এটা ভাবার সময় বোধহয় এসে গেছে।

মহিলাদের জন্য আইন, শিশুদের জন্য আইন, পুরুষ কি এই প্রেক্ষিতে শুধুই হতভাগ্যের দলে থাকবেন? তাঁদের কি সুরক্ষার প্রয়োজন নেই? অনির্বাণের জবাব, "সুপ্রিম কোর্টের হাতেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা। সেখানে সঠিক পদ্ধতি মেনে আবেদন করতে হয়। সংবিধানের ১৪১ নম্বর ধারা অনুসারে ৩/৫/৭, অর্থাৎ যে কোনও বেজোড় সংখ্যক বিচারকমন্ডলী মিলে আলোচনার মাধ্যমে নতুন কোনও সংযোজন বা পরিবর্তন করতে পারেন। এক্ষেত্রে সর্বাধিক সহমত প্রয়োজন। এছাড়া বিধানসভা ও লোকসভা মিলেও কাজটি করতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্য রাষ্ট্রপতিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।"

সমাজের কী ভূমিকা?

বলা বাহুল্য, জনচেতনা ও জনসমর্থন অত্যন্ত জরুরি বিচার্য বিষয়। উল্লেখ প্রয়োজন, গত কয়েক বছর ধরে এই চেতনা জাগরণের কাজটা অত্যন্ত নিবিষ্ট ভাবে করে চলেছে অল বেঙ্গল মেন'স ফোরাম। পুরুষের পক্ষেও সমান জরুরি এই ঘরোয়া হিংসা আইন, এই মর্মে একটি সমীক্ষা করে তারা। তাতে দেখা যায়, প্রায় ৯৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এই যুক্তিকে সমর্থন করছেন। অর্থাৎ, কিছুটা ধীরে, অনেকটা সঙ্গোপনে হলেও পুরুষদের প্রতি অত্যাচার, তাঁদের দুঃখ-যন্ত্রণার বিষয়টি প্রকাশিত হচ্ছে।

সংস্থার প্রেসিডেন্ট নন্দিনী ভট্টাচার্যের কথায়, "এটাকে একটা সামগ্রিক আন্দোলনের রূপ দেওয়া জরুরি। আমরা সেটাই করছি। আলোচনা, বিতর্ক, সেমিনার চলছে। মানুষের সাড়াও পাচ্ছি।" এখানেই এসে পড়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। তাদের দিক থেকেও কিছুটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। মহিলাদের প্রতি ঘরোয়া হিংসার ছবি যেভাবে বারবার জনসমক্ষে এনেছে তারা, সেভাবেই পুরুষদের কথাও আনতে হবে।

যে কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই মনস্তত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। পরিবারে মেয়েরাও যে এমন হিংসার আশ্রয় নেন, তার পিছনেও কি তাহলে সেটাই? "অবশ্যই, মনস্তত্ব একটা বিরাট দিক। অপরাধ আইন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বারবার অনুভব করেছি এটা। আসলে যে সমানাধিকারের কথা মহিলারা বলেন, অনেকেরই তার উপলব্ধির জায়গাটা এখনও তৈরি হয়নি। তাঁরা আজও হীনমন্যতায় ভোগেন। নিরাপত্তাবোধের অভাবও আছে। এইগুলোই মনের মধ্যে পাক খেতে খেতে একটা অসুস্থ অন্ধকারের বাতাবরণ তৈরি হয়। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বোধের অভাবটাও একটা কারণ। স্বামীকে অনেক মহিলাই নিছক চাহিদা পূরণের যন্ত্র বলে মনে করেন। অত্যাচারের ইচ্ছেগুলোর সূত্রপাত এই যাবতীয় অস্বাভাবিকতা থেকেই," জানান অনির্বাণ।

আরও পড়ুন: বদলে যাওয়া সময়ে মিডিয়া, আজকের সমাজের আয়না

এই সমস্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে কিছু জরুরি কথা শেষবেলায়। ওই চ্যানেলের ভিডিওটি একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পোস্ট করা হয় এবং সেখানে তুমুলভাবে নেটিজেনদের রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বহিঃপ্রকাশের অনেকটাই সেই 'দাঁতের বদলে দাঁত' বা 'চোখের বদলে চোখের' মতো। আবার 'পুরুষত্ব'র ডঙ্কা বাজানোর প্রবণতাও লক্ষণীয়। "হাতে চুড়ি পরে বসে আছিস কেন? মার উল্টে!", এসব উত্তেজক ও প্ররোচনামূলক কথাবার্তায় হাওয়া গরম হয়। কিন্তু কোনও কাজের কাজ হয় না। আইন কোনও অবস্থাতেই নিজের হাতে নেওয়া উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

মহিলাদের পক্ষে সহানুভূতি আদায় করাটা তুলনায় সহজ। মাঝখান থেকে পীড়িত যে পুরুষ, তাঁর অভিযোগের ভিত্তিটাই বানচাল হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও, যেখানে অত্যাচারটা সম্পূর্ণ মানসিক, সেখানে একজন পুরুষ কী করবেন? প্রতি পদক্ষেপে যখন তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবেন তাঁর স্ত্রী বা পরিবারের অপর কোনও মহিলা, তখন? তাঁকে উত্যক্ত করবেন, অপমান করবেন সর্বসমক্ষে?

দুটো কথা পরিষ্কার জেনে রাখা দরকার। এক, পীড়ন বা অত্যাচার কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়, তা যিনিই করুন। দুই, আইনের পথ নেওয়াটাই সবচেয়ে বিচক্ষণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত এক্ষেত্রে। শারীরিক তো বটেই, মানসিক অত্যাচারজনিত অপরাধের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নিতে পারে আইন ও প্রশাসন। শুধু নিপীড়িতকে মুখটা খুলতে হবে। জানাতে হবে প্রশাসনিক স্তরে এবং সহমর্মী মানুষজনকে। এতে কোনও লজ্জা নেই। বরং সেটা গোপন করে গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন। মনে রাখা দরকার, প্রত্যেকের জীবন দামি, তাকে মূল্য দেওয়ার দায়িত্ব নিজেরও কম নয়। আর সমাজ? তাকে অবশ্যই মহিলা ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমদৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হতে হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment