Advertisment

মোদী-ট্রাম্প, বন্ধুত্বের হিসেবনিকেশ?

মূল প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের এ ভারত সফরের তাৎপর্যটা কী? মানে ট্রাম্পের কী লাভ? তার চেয়েও বড় কথা হলো, ভারতের লাভ কী? এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া বেশ কঠিন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
donald trump in india

এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় খবর হলো, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ দেশে আসছেন। শুধু ভারতের খবরই বা বলি কেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশই এ সফরের দিকে তাকিয়ে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া কেন, চীনও তো এ সফরের দিকে কড়া নজর রাখছে।

Advertisment

মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের বেশ অল্প সময়ের মধ্যে অনেকবার বৈঠক হয়েছে। ট্রাম্প-মোদীর একটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন যে তৈরি হয়েছে, তাও অস্বীকার করা যায় না। তবে এই যে বারবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে যে ট্রাম্পের এই সফরটি বিরল, স্ট্যান্ড-আল্যোন সফর, মানে ট্রাম্প শুধুই ভারতে আসছেন, পাকিস্তান যাচ্ছেন না, এটা কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণতঃ সমস্ত প্রেসিডেন্টই ভারতে এলে পাকিস্তানেও আসেন। তা সে ক্লিন্টন, বুশ, ওবামা যেই হোন না। আর ট্রাম্প তো এখনো কখনো পাকিস্তানে যাননি।

মূল প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের এ ভারত সফরের তাৎপর্যটা কী? মানে ট্রাম্পের কী লাভ? তার চেয়েও বড় কথা হলো, ভারতের লাভ কী? এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া বেশ কঠিন। যদি বলি শূন্য, কোন লাভই নেই ভারতের? একটাই লাভ, সেটা হলো 'ডাইভারশন'। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতির ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থার মধ্যে ট্রাম্প আসায় আপাতত সংসদের বাজেট অধিবেশন ২ মার্চ শুরু হওয়ার আগে আমরা সবাই, মানে সংবাদমাধ্যম, ট্রাম্পের সফর নিয়েই ব্যস্ত থাকব। অতএব মানুষও কিছুদিন অর্থনীতি ভুলে থাকবেন। এই ধারণাটাও একটু বেশি 'সিনিক্যাল' বলে মনে হয়। আবার যদি বলি, এই সফরের ফলে ট্রাম্প ভারতের আর্থিক চালচিত্রটাই বদলে দেবেন, তবে ঢাকার রসিকতাই মনে পড়বে, 'কত্তা, একথায় ঘোড়ায় হাসবে!’

সবচেয়ে প্রথমে মনে রাখতে হবে, আমেরিকা এবং ভারতের আর্থিক সম্পর্ক অত্যন্ত অসম। এই সম্পর্ককে at par করা এত সহজ নয়। কারণ ভারত হলো মাথাপিছু ২০০০ ডলারের দেশ, আমেরিকা মাথাপিছু ৬০ হাজার ডলারের দেশ। সুতরাং আমরা যদি আমেরিকার পণ্যের ওপর ট্যাক্স না কমাই, তাতে ট্রাম্প গোঁসা প্রকাশ করলেও এর ফলে আমেরিকার অর্থনীতি বসে যাবে, মার্কিন ভোটে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে প্রচন্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যাবে, এমন নয়। বরং আমার তো মনে হয়, মোদী স্নায়ুযুদ্ধে এ যাত্রা জিতেছেন। তিনি যে কিছুতেই বাণিজ্য চুক্তি করতে রাজি হননি, সেটা ভারতের জন্য, মানে আমাদের জন্য, ভালো।

মনে রাখতে হবে, আমেরিকা পুঁজিবাদী দেশ। সর্বোপরি, ট্রাম্প নিজেই একজন ব্যবসায়ী। তিনি তাঁর দেশে ভোটের আগে চাইছেন দেশের ব্যবসায়ীদের খুশি করতে। ভারতে আসা মার্কিন পণ্যের ওপর চাপানো কর কমাতে। আমি গত কয়েক মাস ধরে দেখছি, এ ব্যাপারে ইউরোপ ও পশ্চিমের অন্য দেশগুলিও সব আমেরিকাকে সমর্থন করছে। কারণ তারাও ভাবছে, এই কর কমলে তাদের পণ্যের ওপর চাপানো করও কমবে। বিশেষত মোবাইল ইন্টারনেট-ল্যাপটপ ও তথ্য প্রযুক্তি, ডেটা ব্যবসা, এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে। কিন্তু ভারতীয় শিল্প মার্কিন পণ্যের কর কমাতে চায় না। আরএসএস তথা সংঘ পরিবারেরও সাধারণ ধারণা হলো, আগে স্বদেশী পণ্যকে রক্ষা করতে হবে। তাকে যদি ভারতীয় protectionism বলে সমালোচনা করেন ট্রাম্পে সাহেব, তা তিনি করুন।

চীন যখন এই কাজই করে, শুধু আমেরিকা নয়, আমাদের সঙ্গেও, তার বেলা? ইজরায়েলের মতো বন্ধু দেশও আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে করে। দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ‘গ্যাপ’ অনেকটাই। ট্রাম্প তো ভারতে আসার আগে টেলিভিশনে বাইট দিয়ে বলেছেন, "ভারত আমাদের পণ্যের ওপর বড় করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে রেখেছে, তবু মোদীকে আমার পছন্দ।"

কূটনীতি বড় মজার। এক রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ইতিহাস বলে, অনেক সময়ই তা হয়ে যায়। কিন্তু আসলে কখনোই তা ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থের ভিত্তিতেই এই সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ইন্দিরার আলিঙ্গনের ছবি তো পৃথিবী বিখ্যাত। একথাও সত্য যে ইন্দিরা গান্ধীর সৌন্দর্য ও ক্যারিশমাও ছিল ভুবনজোড়া। কিন্তু তা বলে কি কাস্ত্রো এমন কিছু করেছেন যা শুধুই ভারতের স্বার্থে? কিউবার স্বার্থে নয়? এমনটা হয় না।

মোদী ক্ষমতায় আসার পর ব্যক্তিগতভাবে শুধু ট্রাম্প নন, জাপানের আবে, রাশিয়ার পুতিন সহ বহু রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তা বলে কি ট্রাম্প তার মার্কিন স্বার্থ রক্ষা ভুলে কেবলই মোদী ভজনা করবেন? কূটনীতিতে এই বিবিধ স্তরগুলিও তাই বড় চিত্তাকর্ষক।
মোদী যে শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য চুক্তি করলেন না, তাতে ট্রাম্পের বিরাট ক্ষতি বৃদ্ধি না হলেও তিনি খুশি হলেন না। এবার তাই ভারতে আসার সময় তিনি বাণিজ্য সচিবকে সঙ্গে নিয়েই এলেন না। আমেরিকার চীনের সঙ্গে একটা বাণিজ্য চুক্তি তো আছেই, এই সফরের পরেও আমেরিকা WTO-র চুক্তির শর্ত মেনে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই থাকবে, সেটা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই।

তাই বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে যতই গোঁসা হোক, ট্রাম্প ভারতে এলেন। কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও তিনি সরাসরি আহমেদাবাদ আসছেন। সাধারণতঃ রাষ্ট্রপতিরা দিল্লিতে আসেন। তবু মুম্বই বা ব্যাঙ্গালোরে আসেন, কিন্তু কখনই এভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গুজরাতে আসেননি। আসলে ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। কূটনৈতিক সম্পর্কে এই স্নায়ুর লড়াই চলতেই থাকে। দর কষাকষি, এসবের মধ্যেই টাম্প আসছেন। আজ না হয় কাল বাণিজ্য চুক্তি হবে ধরে নিয়ে আমেরিকা এগোবে।

ভারতের এক বিশাল বাজার আছে। তাছাড়া প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও ভারতকে আমেরিকার দরকার। হেলিকপ্টার ভারত কিনছে আমেরিকার কাছ থেকে। তাছাড়া ট্রাম্প কোনদিন পাকিস্তানে যাননি। ইমরান খান এতবার নিমন্ত্রণ করা সত্ত্বেও ট্রাম্প এবারও পাকিস্তানে গেলেন না। এবারও টাম্পের সফর হলো স্ট্যান্ড অ্যালোন, এটাও কম কথা নয়। এইজন্য আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আসছেন, আমাদের অজিত ডোভালের সঙ্গেও তাঁর কথা হবে। পাকিস্তান ও চীনকে নিয়ে ভারতের অজস্র নিরাপত্তার সমস্যা তো আছেই। তাই আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করাটা ভারতেরও প্রয়োজন।

হাউডি মোদির বদলে এবার গুজরাটে নবনির্মিত বিশাল স্টেডিয়ামের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আসলে হবে হাউডি মোদী, মানে নমস্তে ট্রাম্প। এসবই কূটনীতির 'ফিল গুড'। কবে H1 ভিসা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের জটিলতা কমবে, আমরা জানি না। আসলে কূটনীতি হল গ্লাসের অর্ধেক জল। কূটনীতিতে একতরফা ভালো বা একতরফা খারাপ হয় না। কিছু ভালো আর কিছু মন্দ, এই সংমিশ্রণ নিয়েই সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিরূপিত হয়। আমরা সাংবাদিক। আমাদের একটা সমস্যা হলো, যাঁরা মোদীকে পছন্দ করেন না তাঁরা বলেন, মোদী এই কূটনীতিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ, আবার যাঁরা প্রবলভাবে মোদী ভক্ত তাঁরা বলবেন, এই সফর হল এক নব্য 'প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া'। মোদীর হাত ধরে ট্রাম্প ভারতে আসছেন। গুজরাতে লাখ লাখ মানুষ ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের শক্তি প্রদর্শন করবেন। হিউস্টনেও ৫৯ হাজার ভারতীয় আমেরিকান তাঁর নিজের দেশেই ট্রাম্পকে স্বাগত জানান, আর এখানে তো রাজ্যটার নাম গুজরাট। কাজেই এ হলো এক নতুন ধরনের পার্টনারশিপ, বা বলা ভালো কৌশলগত শরীকি সম্পর্ক।

এই প্রথম স্থলসেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনা, এই তিনটি ক্ষেত্রেই দুই দেশ যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ করছে। ন্যাটোর সদস্য না হয়েও যে এভাবে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা বেশ দেখার মতো ঘটনা।

অবশ্য হেনরি কিসিঞ্জার একদা বলেছিলেন, আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া অনেক সময় তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে যেতে পারে। ভারত তাই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক। বিশেষত ট্রাম্প তো এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বুশ অথবা ওবামার সময় দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট নেতা কাকে বলে সেটাই আমরা জানতাম না, হিউস্টনে ট্রাম্প বলেছিলেন, আমেরিকার মতো বন্ধু ভারত আর পাবে না। আমরাও এই বন্ধুত্ব চাই।

তবু মোদী যে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করছেন না, তার প্রমাণও যথেষ্ট। বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে প্রকাশ্যে যেভাবে আমেরিকা সমালোচনা করছে, তা থেকেই ভারতের এই দরকষাকষির শক্তি টের পাওয়া যাচ্ছে। যদিও বেশ কিছু দেশীয় মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই চুক্তি করা হচ্ছে না দেশীয় কিছু পুঁজিপতির জন্য। দুগ্ধজাত পণ্য বহু ছোট ব্যবসায়ী বলছেন এক পৃথক ভারতীয় দুগ্ধ ব্যবসার একচেটিয়া পুঁজিকে রক্ষা করার জন্যই আমেরিকার দুগ্ধ ব্যবসাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এই তর্ক-বিতর্ক চলুক। তবে একথা আপাতত স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে ভারত-মার্কিন দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক ভারতেরই স্বার্থে আজ প্রয়োজন। ঠান্ডা যুদ্ধের দিন শেষ হয়ে গেছে।

Advertisment