২০২০-র শুরুতে যে কথা বারবার বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসছে তা হলো, নতুন বছরে এ দেশের রাজনীতিতে কী কী বিষয় মূল প্রভাব ফেলবে? শিক্ষিত, প্রগতিশীল, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা যতই গম্ভীর মুখ করে বিজলি-সড়ক-পানি কিংবা রুটি-কাপড়া-মকান নিয়ে হিন্দি শব্দের হ্যাট-ট্রিক কপচান না কেন, এ নিয়ে খুব বিতর্কের অবকাশ নেই যে মূল বিষয় আপাতত নাগরিকত্ব, নাগরিকত্ব এবং নাগরিকত্ব। বর্ষশেষের উৎসাহ-উদ্দীপনা-উচ্ছ্বাসের মতোই পঞ্জি এবং পঞ্জিকা সারা বছর ধরে এ দেশের নাগরিকদের চাগিয়ে রাখবে।
বিষয় যখন এটাই, তখন তার পরের আলোচনা এই যে, এর ফলাফল কী হবে? ভবিষ্যতদ্রষ্টা হতে গেলে আমাদের আন্তর্জাতিক স্তরে এই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি নির্বাচন নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন - পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভা, দিল্লীর বিধানসভা, এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভোট। অবশ্যই নাগরিকত্ব বিতর্কের প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পৌরসভা নির্বাচনে (যদি হয়), কিংবা দিল্লী বিধানসভায় (এটা হবে)। তবে সবচেয়ে গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, এ রাজ্যের এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাকি অন্তর্জাল খুঁজে 'ভারতীয় নাগরিকত্ব এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন' নিয়ে চোদ্দ পাতার গবেষণাপত্র লিখে ফেলেছেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতির আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি, এবং 'আসছে বার ট্রাম্প সরকার' তো আছেই। তবে সবচেয়ে গরম খবর, যা ইরানের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল কাশেম সোলেইমানিকে বিমানহানায় চন্দ্রবিন্দু করে দেওয়ার পর ট্রাম্প সাহেব জানিয়েছেন, যে এই লোকটিই নাকি দিল্লি থেকে লন্ডন, বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ ট্রাম্পের দিবারাত্রিতে এখন ভারত-ভাবনা। সেই সূত্র ধরেই গোপন গবেষণার অনুসিদ্ধান্ত হলো, ট্রাম্প সাহেব দ্বিতীয়বার ক্ষমতা আসার জন্যে নাগরিকত্বকেই তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে ছাপাবেন।
আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব প্রশ্নে সিএএ-এনআরসি বড় বিপত্তি
বুঝতেই পারছেন যে পরবর্তীকালে এর রূপায়ণের জন্যে ডাক পাবেন অমিত প্রতাপশালী ভারতীয় নেতা। আর সেই খবর শুনে ফেলে দু-একজন রেড ইন্ডিয়ান (লালমুখো মানুষ লিখলে কিন্তু বর্ণবিদ্বেষের দায়ে পড়বেন) নতুন করে আইসিএসই দশম শ্রেণীর ইংরিজি টেক্সট পড়তে শুরু করেছেন। 'চিফ সিয়াটেল’স স্পিচ' নামের সেই লেখা আজকের দিনে কলকাতার বেশির ভাগ অভিভাবক-অভিভাবিকাদেরই জানা। সহায়িকা বই নিয়ে প্রশ্ন-উত্তর মুখস্থ করা হয় সকাল-বিকেল, ইংরিজি গৃহশিক্ষিকার ঘরে গাদাগাদি করে বসা কাঠের বেঞ্চিতে। কিন্তু তা বলে লালমুখোদের মেঘলা আকাশ থেকে চলকে পড়া নোনতা জলের হিসেব রাখার সময় আমাদের নেই। বড়জোর সেই লেখার শুরুর দুটো লাইন কাট-পেস্ট করতে পারি, বাকিটা সময় থাকলে গুগুল করে পড়ে নেবেন।
“Yonder sky that has wept tears of compassion upon my people for centuries untold, and which to us appears changeless and eternal, may change. Today is fair. Tomorrow it may be overcast with clouds.”
এক দেশ থেকে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে শক্তিশালীর অন্য দেশ দখলের উপন্যাস যেমন থাকে, তেমনই থাকে এক দেশ থেকে তাড়া খেয়ে দুর্বলের অন্য দেশে ঢুকে পড়ার ছোটগল্প। আবার সেই টুকরো ছোটগল্পের সংকলন অনেক সময় থাকে-থাকে উপন্যাসের পাতার সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। একেকটি দৃষ্টিকোণ, এক একটি ভাবনা। তাই নাগরিকত্ব নিয়ে বিহ্বলতা তো থাকবেই। ব্যক্তি মানুষের স্বতন্ত্রতা রাষ্ট্রের সমষ্টি ভাবনার কাছে বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন: নয়া ভারতের ভক্তকুল ও পুরনো ভারতের ভক্তি আন্দোলন
অনুমান করা যাক, এই মুহূর্তে ভারতের একটা বড় অংশের মানুষই চাইছেন যে পড়শী দেশের অনুপ্রবেশকারীরা বিদায় হোন। তাহলেই নাকি আমাদের উন্নতি হবে অনেকটা। সহজ যুক্তিতে, মানুষ কমলে সম্পদের ভাগ যে বেশি পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। লব-টাকে একই রেখে হর কমালে যে দক্ষিণপন্থী শাসকের মান বাড়ে সেটাই ধ্রুবসত্য। কিন্তু সেই সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ যদি হয় জনপ্রতি একশো টাকা, আর নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে খরচ হয় দশ হাজার, তাহলে লাভের খাতায় সামরিক জাতীয়তাবাদ আর বর্ণহিন্দুত্ব ছাড়া বিশেষ কিছু থাকে না।
সেটাকে কেউ লাভ বলে মনে (হৃদয়) করতেই পারেন, কিন্তু তাঁকেও মাথায় (মস্তিষ্ক) রাখতে হবে যে নাগরিকত্বের মূল প্রশ্ন প্রমাণ সংক্রান্ত। আর এই জায়গাটাতেই আধুনিক সভ্যতার চরম ব্যর্থতা। ঠিক কোন নথির ভিত্তিতে এবং কোন জটিল প্রক্রিয়ায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়াদের ভারতবর্ষের সংসদীয় ব্যবস্থার ছাপ মারা পরিচয়পত্র হাতে তুলে দেওয়া যায়, নিশ্চয় তা নিয়ে নতুন গণপরিষদ সৃষ্টির কথা ভাবতে শুরু করেছেন আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২০ তাই নিজেকে নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার বছর, ওঙ্গে, শম্পেন, কিংবা সেন্টিনেলিজদের সঙ্গে ভেতো বাঙালির আরও একবার লাইনে দাঁড়ানো অভ্যাস করার চ্যালেঞ্জ।
মানুষ নিজের জায়গায় থিতু হয়ে থাকবে, নাকি পৌঁছে যাবে এক দেশ থেকে অন্য এক দেশে, এ নিয়ে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার অন্ত নেই। ফলে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তি হাতে থাকবেই। তবে শিক্ষিত যে সমস্ত পরিবার পড়শী দেশগুলির বিশেষ শ্রেণীর মানুষের নাগরিকত্বে আপত্তি তুলছেন, তাঁরা একবার ভেবে দেখতে পারেন নিজেদের পরিবারের সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁরা লন্ডন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, কোপেনহেগেন বা নিউ ইয়র্কে গিয়ে সুখে শান্তিতে আছেন। যাঁরা মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় উদ্দাম সমর্থন করছেন নিজের ছেড়ে আসা দেশকে।
আরও পড়ুন: দেশের মুসলিমরা মোদী-অমিতের বিরুদ্ধে, হিন্দুবিদ্বেষী নন
আসলে দেশ শুধু থাকার জায়গা নয়, মানুষের বহুমাত্রিক অস্তিত্বের একটি মাত্রাও বটে। তাই পড়শী দেশ ছেড়ে আসা বিধর্মী মুচিভাই রাস্তার ধারের কাচঢাকা দোকানে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের জয় দেখে যদি ভুল করে দুহাত শূন্যে ছুড়েও দেন, ভারতীয় হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করার মধ্যেও কিছুটা দেশভক্তি আছে। বিদেশ গিয়ে যে আমরা প্রতি মুহূর্তে নিজের দেশের মানুষ খুঁজি, তার মধ্যে নাগরিকত্ব কিংবা তার প্রমাণের ছিটেফোঁটা নেই, থাকে শুধু ছেড়ে আসা দেশের এক বিমূর্ত অবয়ব।
অন্য দেশে বাস করার যে জাগতিক অস্তিত্ব সংকট, সেখানে এই পৃথিবীতে নিজের আসল দেশটা যে কিছুটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাই যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস যোগায়। ধর্ম এবং নাগরিকত্বকে অতিক্রম করে মানুষের মধ্যের সেই দেশজ যোগাযোগ ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, তার একটা উদাহরণ দিয়ে এই লেখা শেষ করি।
কয়েকদিন আগে, মার্কিন দেশের পশ্চিম উপকূলে বছরশেষের ঘটনা এটা। আমার বন্ধু উদয়ন (সত্যি নাম) বহু বছর ধরে থাকেন সে দেশে। তাঁর জীবনে প্রায় একসঙ্গে পাশাপাশি বাড়িতে কাটানো পঁচিশ বছরের পুরনো বন্ধু উদ্দালক (নাম পরিবর্তিত) হৃদযন্ত্রের সমস্যায় হঠাৎ করে মারা যান বছর শেষে। বয়স তাঁর পঞ্চাশ পেরোয় নি। গত বর্ষাতেই উদয়ন এবং উদ্দালক ইংল্যান্ড গেছিলেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতকে সমর্থন করতে। নিজের দেশ তো, যদিও তাঁরা দুজনেই কিন্তু মার্কিন দেশের নাগরিক।
আরও পড়ুন: যে সমাজ সততার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হয় মাত্র
উদ্দালক চলে যাওয়ার চরম শোকের মধ্যেও তাঁর পরিবার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন অঙ্গদানের। অনেকের সঙ্গে উদয়নও সেই বার্তা পৌঁছে দেন চারদিকে। সকলেই জানেন, মার্কিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপুজো হয়। সেই সূত্রে একত্রিত হন অনেক মানুষ। সেখানে প্রতিবার পুজোয় অঞ্জলি দিতে আসেন আনোয়ার আলি এবং তাঁর স্ত্রী ফতিমা রশিদ (দুটি নামই পরিবর্তিত)। আনোয়ারের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন। স্বভাবতই যোগাযোগ ঘটে খুব তাড়াতাড়ি। ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ এই যোগাযোগের পর কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত প্রায় নেওয়াই হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, তার ঠিক পরের দিনই জানা যায় যে চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু জটিলতার কারণে প্রতিস্থাপন আপাতত সম্ভব নয়। ফতিমা-র লেখা হোয়াটস্যাপ বার্তাটি আমার কাছে পাঠিয়েছে উদয়ন। হুবহু সেটা তুলে দিলাম।
Hi Mr. Udayan,
We consulted two of our Nephrologists and one primary physician. They all advised us against this particular transplant due to some medical nuances. Your efforts and responses raised hope in us more. We will continue to find kidney donor (deceased or living donor) for Anwar. May God bless you and your friend’s family.
Thank You
……
সব ঘটনার শেষ তো সুখের হয় না। হোক না পুরনো সেই পৃথিবী, আঁকাবাঁকা রেখা টানা এদিক ওদিকের দেশ, তার মধ্যে থাক না শংসাপত্রের ছাপ মারা নাগরিক। কিডনির তো নাগরিকত্ব নেই। ২০১৯ হেরেছে তো কী? আমাদের এখনও প্রায় গোটা ২০২০-টাই হাতে আছে।