অন্যান্যবার অতোটা মন দিয়ে শুনি নি, আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে যে পুজো, সেখানে সকালে মাইক বাজে না বলে খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল দুর্গা-অধিবাসের মন্ত্রগুলো। শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। পরে একটু বইপত্র ঘেঁটে আরো অবাক।
এতো সকলেই জানি যে আমাদের যে-কোন শুভ অনুষ্ঠানে সবসময়েই জলকে নিমন্ত্রণের রীতি আছে। হিন্দু-মুসলিম-আদিবাসী নির্বিশেষে আমি দেখেছি বাঙালী গ্রামের মেয়ে বৌরা বাড়িতে বিয়ে স্থির হলে সবচেয়ে আগে জলকে নিমন্ত্রণ করতে যান। নদী হোক বা পুকুর, তার কাছে গিয়ে দস্তুরমত আনুষ্ঠানিক ভাবে বলে আসা হয়, আমার মেয়ের/ছেলের বিয়ে অমুক দিন, তুমি নিশ্চয়ই যেও। মৃত্যুর পর সমস্ত ধর্মেই পার হতে হয় একটি নদী – বৈতরণী হোক কি লীদ বা পুলসেরাত।
আরও পড়ুন, ‘শুধু মানুষ নয়, পোকাকেও শ্রদ্ধা করতে হয়’: অজানা পার্বতী দাস বাউল
কিন্তু এতো তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন স্বাদ। দেবী তৈরি হয়ে উঠছেন আর তাঁর আরাধনার শুরু-বলা যায় অভিষেক, হচ্ছে সৃষ্টির মাঝখানে। আমাদের পরিচিত নদীনামগুলি তো আছেই গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী নর্মদা সিন্ধু কাবেরী। কিন্তু দেবীপুরাণে পাচ্ছি আরো অন্য নদীদের নামও যেমন, গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর পরেই আছেন সরযূ গণ্ডকী শ্বেতগঙ্গা চ কৌশিকী। এবার, শ্বেতগঙ্গা হল কোশীর এক বিরাট উপনদী আর কৌশিকী তো স্বয়ং কোশী। ‘সিন্ধুভৈরবসোণাদ্যা যে নদ্যা ভূবিসংস্থিতা’। এরপর ‘ভোগবতী পাতালে চ স্বর্গে মন্দাকিনীস্তথা’। অর্থাৎ স্বর্গমর্ত্যপাতালের এই ত্রিলোকবিধৌত করা হল দেবীকে। তারপর ‘দেব শূলপাণির ভৃঙ্গারে আবদ্ধ সুরা দ্বারা, পরে শঙ্খজল দ্বারা,’ তারপরে উষ্ণজল, দধিজল, গোমূত্র, মধুজল, সোনা রুপো ধোয়া জল, পুষ্প ও ফল ধোয়া জল দ্বারা স্নান করিয়ে অভিষেক করা বিধেয়। তারও পরে রয়ে গেল ঝর্ণার জল, শিশিরের জল, সাগরোদক অর্থাৎ সমুদ্রের জল। আর বারে বারেই বলা হচ্ছে ‘তেজসো ব্রহ্মবর্চসা ত্বমাভিসিঞ্চামি’। দীপ্তিময় ব্রহ্মবর্চসা, যা কিনা নদীকিনারের জলের বিশেষণ- তারা এত উজ্জ্বল যেন তারা স্বয়ং ব্রহ্মেরই বাণী, তাই দিয়েই দেবীকে অভিষিক্ত করা হচ্ছে।
কে তাহলে এই দেবী? বিল্ববৃক্ষে জন্ম নিয়ে যিনি দেবতাদের উদ্ধারকল্পে আবির্ভূতা হয়েছিলেন? মহাপণ্ডিত শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির লেখায় রয়েছে এক আশ্চর্য উদ্ঘাটন। তিনি শোনাচ্ছেন ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের এক উপাখ্যান যেখানে ব্রহ্মা বিপন্ন দেবতাদের বলছেন, কোন বিপদেই তো দেখিনা দেবতারা নিজেরা কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন! যা হোক, ব্রহ্মা তাঁদের বললেন বনে গিয়ে দেখতে পাবেন একটি বেলগাছের পাতায় অনাবৃত অঙ্গ, মুষ্টি পরিমাণ এক সোনার বরণী কন্যা নিদ্রিত রয়েছে। দেবতাদের স্তবে সে নিমেষে নিমেষে বর্ধিত হবে। তিনিই দেবী। যোগেশচন্দ্র ব্যাখ্যা করে বলছেন অনাবৃতাঙ্গী, স্বর্ণবর্ণা, মুষ্টিপরিমাণ এই দেবী প্রকৃতপক্ষে অগ্নি, যিনি বেলগাছের কাঠে নিহিত আছেন। মনে রাখতেই হয়, দুর্গাপুজোয় বেলগাছের একাধিক বিশেষ ভূমিকা থাকে।
আরও পড়ুন, ‘পজিটিভ’ পদক্ষেপ, এইচআইভি পজিটিভ শিশুদের হাত ধরে এলেন ‘মা’
এই দেবী যদি অগ্নি হন, যাঁর অভিষেক হয় এত রকমের উদক বা জলে, বহুবিধ মৃত্তিকাযোগে যার মধ্যে আছে নদীকিনারের মাটি, ধানখেতের মাটি, রন্ধনগৃহের মাটি থেকে গোয়ালের মাটি, অঙ্গমর্দনস্থলের মাটি পর্যন্ত, বিশশতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকের কয়েকজন লেখকের থেকে আমরা কেবল ‘বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা’র কথাই পেয়েছিলাম যদিও, এঁর অর্চনাও দেখি নবপত্রিকায়, দেবীর গায়ের রঙের বর্ণনা করা হয় অতসী ফুলের উপমায়, তাঁর প্রিয় ফুল হল স্থলপদ্ম, শতদল পদ্ম, অপরাজিতা, শেফালি- যার প্রতিটাই এই শরৎকালের স্বাভাবিক ফুল। তখন যে স্বাভাবিক প্রশ্ন মনে আসে, তাহলে দুর্গা কি এই বর্ষাবসান কালের যে ঋতু সেই শরতেরই দেবী? শারদা বলেও তো উল্লিখিত হন তিনি! দুর্গা কি বহু প্রাচীন কালে পূজিতা কোনো আরণ্যদেবী যিনি প্রকৃতির প্রতিমূর্তি হিসাবে পূজিতা হতেন? এরকম উদাহরণ তো পৃথিবীর সর্বত্রই পাওয়া যায়- কোনো প্রাচীন ধর্মানুষ্ঠান কালে কালে নিজের অনুষ্ঠানের চেহারাটি এক রেখেও অর্থে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন সকলেই জানি মহীশূরের চামুণ্ডামূর্তির আদলে দুর্গার অধুনা পূজিত রূপের মাটির প্রতিমা প্রথম তৈরি করিয়েছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। মনে পড়ে যায়, হরপ্পার সীল থেকে একটি নারীমূর্তির ছাপ পাওয়া গিয়েছিল যার শরীর থেকে গাছ লতা বেরিয়ে আসছিল। দুর্গার এক নাম কি শাকম্ভরী নয়?
(জয়া মিত্র পরিবেশবদ, মতামত ব্যক্তিগত)
জল মাটি সিরিজের সব লেখা একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে