মুখ্যমন্ত্রী এবছর অ্যাড হক বোনাস ২০০ টাকা বাড়ানোয় নারীপুরুষ নির্বিশেষে এক ধরনের রাজ্য সরকারি চাকুরেদের পকেটে এখন কড়কড়ে ৪০০০ টাকা। এই পংক্তিতে সরকারি ছাড়াও অন্যত্র কর্মরতরাও আছেন। ক্লাবকে দুলাখ আর চাকুরেকে কেন মাত্র বাড়তি দুশো এসব বেখাপ্পা কথা তো নয়ই, এ আলোচনায় ১৯৬৫ সালের পেমেন্ট অব বোনাস এক্টের কথা বা পরে সেই এক্ট সংশোধন করে নতুন বোনাস স্কেল চালু করার কথাও আনছি না । কারণ অত নিয়ম মেনে পুরো মাইনের প্রায় ন’ শতাংশ বোনাস টোনাসের গল্প এখন আর কেউ শোনায় না। অ্যাড হক বোনাস বলে একটা হাঁসজারু পেমেন্ট অল্প মাইনের চাকুরেদের হাতে ধরিয়ে দেয়। যাও বাছা, আনন্দ করোগে।
বোনাস খরচে নারী ও পুরুষ
এইখানে, মানে আনন্দের প্রশ্ন উঠলেই তোমার এ পথ আমার পথের থেকে অনেক দূরেই বেঁকে যায়। পুরুষ এবং নারীর বোনাসপ্রাপ্ত আনন্দ যে কতো ভিন্ন তা সবচেয়ে ভালো মালুম হয় উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলোতে গেলে। এমনিতেও চা বাগানগুলো চলে মেয়েদের ঘাড়ে ভর দিয়ে। চা পাতা ঝাড়াই বাছাই, ঘরে ফিরে কচি চাপাতা সেদ্ধ চানাচুর দিয়ে মেখে বাচ্চাদের খাওয়ানো (এটা কিন্তু কামিনদের একটি অসহায়তা কাম ডেলিক্যাসি), তারপর ঘুমন্ত ছানা পিঠে বেঁধে এক্সট্রা বোনাসের কারণে বাড়তি সময় চা বাগিচায় খাটা, সন্ধেয় ঘরে ফেরার সময় পিঠে বাচ্চা, মাথায় লাকড়ির বোঝা বয়ে নিয়ে আসা,রেশন তোলা, বাচ্চার টিকাকরণ কর্মসূচীতে যাওয়া -- একেকটি মহিলা চা শ্রমিক যেন একেক জন দশভুজা।
পুজোর সময় এই মহিলারা বোনাসের টাকা পাবে বলে সপ্তাহে একবারের জায়গায় দুবার হাট বসতে শুরু করে মুজনাই, ভার্ণোবাড়ি, দলদলিয়া, হাসিমারা, রায়মাটাঙয়ের চা বাগান গুলিতে। হ্যাঁ, মহিলাদের জন্যই। কারণ চা বাগানের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা সবাই জানে হাট ভর্তি ডালবড়া আর পেঁয়াজি বিক্রি হয় পুরুষদের জন্য। তাদের বেশির ভাগ হাঁড়িয়া খেয়ে মাতাল হবে বলে। তার আগে অবশ্য বেশি জনই বৌয়ের হাতে বোনাসের টাকার কিছুটা জমা রাখে।
তাই বলে কি মেয়েরা এসব খায় না! খায় খায়, খুব খায়। তবে মাতাল হবার আগে বোনাসের টাকা বিভিন্ন খাতে গুছিয়ে রাখে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাচ্চাদের নতুন জামাকাপড়ের টাকা। তারপর ঘর সারাই বা দেনা শোধ। এখন অনেকেই বাচ্চাদের জয়গাঁ বা আলিপুরদুয়ারের বিনা খরচের মিশনারি স্কুলে পড়তে পাঠায়। সেখানকার হোস্টেলখরচ বাবদ কিছু টাকা জমা রাখতে হয়। এইসব সাঙ্গ হলে হয়তো মেয়েটি নাকে শোঁকে হাটময় ছড়ানো নতুন জুতো, শাড়ি,কাচের চুড়ির টাটকা গন্ধ।
অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও কর্মক্ষেত্র, ফলে এতো অসুখে ভোগে এরা, কিছু টাকা আলাদা করে হয়তো রেখে দিলো শহরে গিয়ে ডাগদারবাবু দেখাবে বলে। সমতলের ভাইছাতু চাবাগানে নেপালি শ্রমিকের ভাইটিকা। সে খাতেও বোনাসের টাকা থেকে কিছু পরিমাণ সরিয়ে রাখতে দেখেছি এই মেয়েদের।
মোদ্দা কথা, শুধু হাঁড়িয়া খেয়ে বা জুয়ো খেলে বোনাসের বেশির ভাগ টাকা খরচ করেনা চা বাগানের মেয়েরা। দায়িত্ব যে শুধু জোয়াল নয়, তা পালনে আনন্দও আছে, এটা বোঝা যায় এই পুজোর সময়ে, যাকে বলা যেতে পারে বোনাসের কাল।
একই ছকে চলে শহরাঞ্চলের গৃহকর্মীদের বোনাস ব্যয়। প্রথমে বাচ্চার পুজোর জামা । তারপর ঘর সারাই বা এমন আনন্দের উপকরণ যা পুরো পরিবার ভোগ করতে পারবে। যেমন টিভি বা বাচ্চাদের ইউনিফর্ম বা কেবলের তার বওয়া শ্রমিক স্বামীর জামা ইস্ত্রি করবার জন্য ইলেক্ট্রিক আয়রণ। ধোপদুরস্ত না গেলে কম্পানি থেকে বকাবকি করে। বাদ বাকি কিছুটা চিকিৎসা, অল্পকিছু সঞ্চয়। বাচ্চাদের পড়ার খরচ। অনেকেরই ঝোঁক এখন ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে।
সবশেষে কখনো কাজের বাড়ির বৌদির মতো সাদা পাথরের ঝিলিক দেওয়া নাকফুল। অল্প সোনাই তো লাগে। তবে চল্লিশ হাজার ছাড়িয়ে গেলে সোনায় ছ্যাঁকা মারে, তখন রুপোর পায়েল বা পা-আঙুলের আংটিই যথেষ্ট । নিজের চাহিদাগুলি ফ্লেক্সিবল। অন্যগুলো নয়। তবে আজকাল একটা জিনিস না হলেই চলে না। সেটি বড় মোবাইল। বেশি বয়স বা সংসারে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপ থাকলে ছোট মোবাইলেও চলে। একটি কেস স্টাডিতে উঠে এলো কাঁচড়াপাড়া থেকে আসা একটি অল্পবয়সী আয়া-মেয়ের কথা। স্বামীর মোটর বাইক কেনার সময় করা লোন শোধ করবার জন্য সে রোজ সল্ট লেকে ছ' ঘন্টা শ্রম দান করে। যদিও তার বোনাস পাবার কথা নয়, সুসম্পর্কের কারণে সে একটা থোক টাকা পায়,যা সে খরচ করে দেনা শোধের জন্য।
অন্য এলাকার কথা জানি না, কিন্তু সল্ট লেক, নিউ টাউন অঞ্চলে পুজোয় শাড়ি ফাড়ি নেবার চল একেবারে উঠে গেছে। ফলে পুজোর সময়টাই এইসব জরুরি অথবা ফালতু মায়াকে সাকার করার সময়।
বোনাস-সুন্দরী কি শুধু মাঠেঘাটে, অন্যের বাড়িতে খেটে খাওয়া মেয়েরাই? অফিসে কাছারিতে এইরকম আনন্দ-আভা মাখা মুখ অনেক চোখে পড়বে উৎসবের সময়। বাড়লোই বা দুশো, কিন্তু থোক চারহাজার তো। এদের সবার মধ্যেই মিল কিন্তু আছে। আসলে মেয়েরা, তারা যে অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকেই আসুক না কেন, কেনাকাটা করার সময় শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবে। দ্বিতীয়ত বাজারহাট করবার সময় তারা আত্মীয় পরিজনদের কথা মাথায় রাখে। উপহার দেওয়া-নেওয়ার সামাজিক তাৎপর্য তাদের কাছে খুব জরুরি। আর জরুরি, কেনাকাটার জন্যই কেনাকাটার অর্থহীন অথচ স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ। নাহলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নাকফুল বা সবুজ কাচের চুড়ির ছটার জন্য এই মায়া, এই কালক্ষেপকে আর কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে !
নারী আর পুরুষের কেনাকাটার ধরনে যে পার্থক্য আছে তা প্রকট হয় এইরকম উৎসবের কালে, কিছু ক্ষেত্রে বোনাসের কল্যাণে। এই প্রবণতার মধ্যে বোনাস না-পাওয়া, না-নেওয়ারাও আছে। বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলি এই তফাত নিয়ে দারুণ সচেতন এবং বিক্রিবাটার স্বার্থে প্রচুর গবেষণাও করে। তাদের মতে ছেলেরাও কেনাকাটা করে। কিন্তু সেটা বেশির ভাগই প্রয়োজনভিত্তিক, কখনো বা শুধুই ব্যক্তিগত প্রয়োজনভিত্তিক। মধ্যবিত্ত পুরুষ ক্রেতার একটি পছন্দ তালিকা তৈরি করলে হয়তো দেখা যাবে তাতে জুতো, বেল্ট, ওয়ালেট, ব্র্যান্ডেড জামা, অ্যালকহলিক ড্রিংকস এবং ফেয়ারনেস ক্রিম ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। এই কারণে শপিং মলে অনেক সময় নিয়ে অকারণ ঘোরাঘুরি করে এমন পুরুষ ক্রেতার দেখা পাওয়া মুশকিল। তারা কেজো কেনাকাটা পছন্দ করে। পুজোর বাজারের ভিড়ে তাই তারা কোটিতে গুটিক। উল্টোদিকে মেয়েরা তাদের বৈচিত্র্যময় কেনাকাটার পদ্ধতিকে প্রায় একটি আবেগজড়িত মানসিক ও শারীরিক যাত্রার পর্যায়ে নিয়ে যেতে ভালবাসে। এই যাত্রার প্রতিটি স্তর নারী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায় বলেই কি এতো সময় ধরে এতো বাছাবাছি করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া ?
সামাজিক নির্মাণ ও বোনাস ব্যয়ের রকমফের
এই গবেষণালব্ধ ফলাফল অনেকটাই প্রভাবিত সামাজিক নির্মাণ বা সোশ্যাল কন্সট্রাক্টের দ্বারা। ছেলেরা মেয়েদের মতো ক'রে বাজার করবে না, অতো সময়ও দেবে না, কারণ তাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে সবসময়ই, এ আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে এবং শুনে শিখি, মাথায় বসিয়ে নিই। তবু সব জেনেশুনে কোনো প্রাপ্তবয়স্কা যদি স্বেচ্ছায় পিসতুতো দিদির মাসিশাশুড়ির জন্য উপহার কিনতে একবেলার অর্ধেক আর বোনাসের একাংশ হেলায় খরচ করতে চায় তাকে বারণ করবে কে ! একদল বলবে যতোক্ষণ না লক্ষ্মীমেয়ে বলে পিঠ চাপড়ানি নারীর ওপর অবদমনের রকমফের বলে সম্পূর্ণ সনাক্ত না হবে ততোদিন অব্দি এইসবেই আনন্দ খোঁজা চলতে থাকবে। আর কোন সচেতন নারী যদি বলেন ভবিষ্যত,পরিজন, সামাজিকতাতে যে আনন্দ, বেশি বুঝে তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা এক ধরণের মূর্খামি ,তাকেও স্বাগত জানাবার লোকের অভাব নেই।
তবে অবাধ ভোগবাদ আর বিকৃত মানসিকতার শিকার যে মেয়েরাই বেশি তাতে তো সন্দেহ নেই। ফলে বোনাস মানে যদি হয় উৎসবের কালে বা কোন কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ দ্বারা উৎসাহমূলকভাবে দেয় অর্থসমষ্টি, তাহলে পিতৃতন্ত্র তার কী হাল করেছে একবার দেখে নেওয়া যাক। সবাই জানে এই মহান দেশে মেয়ে খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক কৃতিত্ব ছিনিয়ে আনলেও সমমানের পুরুষ ক্রীড়াবিদদের থেকে অনেক কম অর্থ পুরস্কার এবং বোনাস হিসেবে পেয়ে থাকে। মেয়েরা আর্থিক বঞ্চনার শিকার অবশ্য সব ক্ষেত্রেই। চা বাগিচা শ্রমিক দয়ামণি ওঁরাও থেকে শুরু করে মাধুরী দীক্ষিতেও সে নিয়মের হেরফের হয় না। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে উন্নত দেশেও কেউ গলা তোলে না। ওয়ার্ল্ড কাপের সেমি ফাইন্যালে ওঠা আমেরিকান মেয়েদের টিমকে যতো অর্থ এবার বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়েছে পুরুষ টিমকে একই কৃতিত্বের জন্য দেওয়া হতো তার ছ’ গুণ বেশি।
রাশিয়ার একটি অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারী সংস্থা তাতরফ (Tatrof)। হঠাৎই কর্মস্থলের পরিবেশ রঙিন করবার অভিপ্রায়ে সেখানে হুলিয়া জারি হলো যে মহিলা কর্মীদের ছোট স্কার্ট পরে আসতে হবে। মেক আপ ছাড়া অফিসে আসা যাবে না। পুরুষ সহকর্মীদের দৃষ্টিভোগের এই ফতোয়া যে মেয়েরা মেনে নেবেন তাদের রীতিমতো বোনাস মিলবে কোম্পানির তরফ থেকে।
কী চমৎকার নিদান। জোর জুলুম নেই, শুধু টাকার টোপ ও মানসিক চাপেই কাজ হাসিল। স্কার্টের ঝুল কতো্টা হবে তাও বলে দেওয়া হলো। হাঁটুর ওপরে ৫ সেন্টিমিটার। বোনাস পেতে হলে মিনি স্কার্ট পরিহিতা কর্মীরা নিজেদের ছবি তুলে কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে দেবে। কেজো সময়টাও রঙিন হলো, আবার অবসর বিনোদনেরও ব্যবস্থা হলো। যে কোন পোশাক, ছোটো অথবা বড়, পিতৃতন্ত্র বোনাসের লোভ দেখিয়ে তা চাপিয়ে দিলে তা হয় নারীকে এজেন্টের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা এবং তাকে কুক্ষিগত ক'রে পরিচালনা করার জঘন্য মানসিকতার প্রকাশ। নারীস্বাধীনতার স্বঘোষিত অভিভাবক এইসব বোনাসপ্রদানকারীরা আসলে মুখোশধারী সেক্সিস্ট। নারীকে নিজের শরীর ও মনের ওপর অধিকার কায়েম করতে দিতে এদের চরম অনীহা এবং সেজন্য বোনাসের মত আপাত নিরীহ আর্থিক আনন্দ-উৎসকে শর্ত চাপিয়ে বিকৃত করতেও এরা পিছ পা হয়না।
এইভাবে বোনাস, কেনাকাটা, সে থেকে পাওয়া কেজো অথবা তূরীয় আনন্দের সব হিসেব গোলমাল ক'রে দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক প্ররোচনায় দেশিয় বাজারে নতুন কিছুর সমাগম হলে আশ্চর্য হব না । সংস্কারী ভারতীয় নারী-কর্মী, যার আনা মাসমাইনেটি সচ্ছলতার জন্য বড় জরুরি, অথচ যার চুল ছোট করে ছাঁটা নয়, দেবদ্বিজগুরুজনে যার ভক্তি অচলা, হাসিমুখে ঘোমটা মাথায় যে অফিস এবং গৃহে সব কর্তব্য পালন করে চলে, স্বসম্প্রদায়ে সামাজিক বিবাহের পর গার্হস্থ্য হিংসা সহ্য করে, কিন্তু লিভ-ইনের ধারণাকে থুথু ছেটায়, তার জন্য হয়তো রাষ্ট্র নতুন হারে বোনাস চালু করবে।
সেই আচ্ছেদিনের অপেক্ষা থাকুক। উৎক্রান্তি না এলে নতুন অঙ্কুরোদ্গম হয় না। মোকাবিলার নতুন দিগন্তও খোলে না।