দুর্গাপুজোকে বেশ কিছু কাল ধরে’ জাতীয় উৎসব, ‘আপামর (পামর কে, তা বলা হয় না যদিও) বাঙালির সামাজিক উৎসব’ ইত্যাদি বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। নিকট অতীতে কেউ কেউ আমাদের পাড়ার বাঘা সংসদীয় সিপিএম, তায় শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী, পাড়ার দুর্গাপুজোর সেক্রেটারি উদ্দীপ্তদার মতো নিজের চিঁচিঁ-বা-ছিছিকারী মুমুর্ষু বিবেককে থাবড়া মেরে থামিয়ে একে রাবীন্দ্রিক শারদোৎসব করে নিয়ে পার্টির শিথিল নিষেধাজ্ঞা এড়াতে প্রয়াস করেছিলেন। বর্তমানে কেউ কেউ আবার দুর্গাপুজোয় ‘আমাদের মুসলিম ভাই’-দের অংশগ্রহণের বৃত্তান্ত সোশ্যাল মিডিয়ায়, সংবাদপত্রে টেনে এনে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’-র নিদর্শন দেখিয়ে এমন আকুল হচ্ছেন যেন পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়বার ‘শান্তিপুর (নাকি দুর্গাপুর!) ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়’! এ অবস্থায় আমার মতো যারা বলবে দুর্গাপুজো কেবল বাঙালি হিন্দুর উৎসব, ‘ওঁদের’ নয়, তাদের কথা শোনার লোক, বা লোকের ‘টাইম’ কোথায়?
আসলে সাংস্কৃতিক রাজনীতি কেবল এক মজার খেলা নয়, ‘অতি বিষম বস্তু’! বিষম বলছি কেবল শকুন্তলার বিদায়কালে কণ্বমুনির মুখে মহামতি বিদ্যাসাগরের বসানো কথা — ‘বুঝিলাম স্নেহ অতি বিষম বস্তু’— তার অর্থে নয়! সাংস্কৃতিক রাজনীতি এখানে বিষম/অসম এই অর্থে যে ‘অপর’ সব সময় ‘আত্ম’-র নিচে। স্টিফেন রাইকার ও নিক হপকিন্স সেল্ফ অ্যাণ্ড নেশন বইতে বলছেন বোঝা জরুরি কিভাবে জাতীয়তাবাদের মনস্তত্ব্বে লোকরা আত্ম আর অপরের বর্গদুটিকে কিভাবে ধারণায়িত করে, আর সেটা সামাজিক ব্যবহাররীতির গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে যায়। আত্ম স্নিগ্ধ আর অনুকূল এবং দেশের ব্যাপারে কারুর গর্বের সঙ্গে জড়িত। অপর অনিষ্টকর এবং বিদেশিদের প্রতি ঘৃণার সঙ্গে জড়িত। রাইটিং সিকিউরিটি: ইউনাইটেড স্টেটস ফরেন পলিসি অ্যাণ্ড দ্য পলিটিক্স অভ আইডেন্টিটি-এ ডেভিড ক্যাম্পবেল দেখিয়েছেন ‘আত্ম’ আর ‘অপরকে’ অবস্থিত করতে যে ‘ভিতর’ আর ‘বাইরে’-র সামাজিক পরিসর তৈরি করা হয় তাতে উচ্চতনতা আর অধস্তনতার নৈতিক পরিসর নির্মাণ করে’ আত্মর জন্য উঁচু আসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অপরকে তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবেই! মজার ছলে হলেও। দুর্গাপ্রতিমার বিগ্রহ-ব্যাকরণের সম্বন্ধে বিষ্ণুপদ দাসের লেখা বা সংগৃহীত গান ‘একি দুগ্গি দেখলাম চাচা গানে’ যেরকম এক নিম্নবর্গীয় মুসলমান তার মজার অবাক ভাব জানাচ্ছে। এই গানও অবশ্য ঢাকতে পারেনি পাশাপাশি, এমনকি ঠিক পরের ‘দাগ’-এর জমিতে চাষ করা, নিম্নবর্গীয়, উভয়েই চুনোমাছ ভাত খাওয়া দুই গরিব বাঙালি চাষী, বঙ্কিমী ‘হাসেম শেখ’, আর তার পড়োশি ‘রামা কৈবর্ত’-র মধ্যে অতল সামাজিক ফাঁক। নইলে হাসেম শেখ কেমন করে’ রামা কৈবর্ত-র প্রধান পূজার প্রধান বিগ্রহ সম্পর্কে এমন অপার বিস্ময় মনে ধারণ করতে পারে? হাসেমের অবাকত্বের কারণ তবে কি এই যে জমিদারবাবুর বাড়িতে, সব দিক থেকেই তাঁর অর্থে হওয়া দুর্গাপুজো উভয়েরই বাড়ির অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহ থেকে বালক বিভূতিভূষণের রুপো চাচার বাড়ির মতো বেশ কিছু দূরে। কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই (পরিতোষ সেনের জিন্দাবাহার লেন-এ কি?) জমিদারবাবুর হিন্দু প্রজা তার মুসলিম পড়োশির কাছে দুর্গার গোটা পরিবারের মহিমা, রূপ-গুণ বোঝাতে গিয়ে জমিদার গিন্নির, পুত্রবধূ, কন্যা, পুত্রকে ক্রমাগতঃ উপমান হিসেবে ব্যবহার করায় মুসলিম বন্ধু বিরক্ত হয়ে তাকে শুধোয়, তবে এটা জমিদারের পুজো না হয়ে’ তার পুজো ক্যাম্নে হলো? এখানে দারিদ্র্যর কারণে হিন্দু প্রজাটি আর দারিদ্র্য-ধর্মীয় সাংস্কৃতিক কারণে মুসলিম প্রজাটি ‘আমাদের’ প্রধান উৎসব থেকে ভিন্ন দূরত্বে আছে। আমার বাড়িতে নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করতে আসা যে গরিব বাংলাদেশি মেয়েটি ইসলামের সম্বন্ধে তার পাহাড়প্রমাণ অজ্ঞতার সঙ্গে দুর্গা ও তাঁর সঙ্গী দেবদেবীর প্রতিমা ও বাহন সম্পর্কে অজ্ঞতাকে সমান ভাবে মিলিয়ে নিয়ে মাঝে মাঝে শাশুড়ির ঠাকুরঘরের কাজ করে দিতো তার অংশগ্রহণকে কিভাবে দেখবো?
এই সমস্যাটা না বুঝলে আমরা ধরতে পারবো না তিনি যে অজস্র, অসাধারণ শ্যামাসঙ্গীত আর কীর্তন লিখেছেন নজরুলের এই ‘গুণে’-ই কিভাবে তাঁর গানে, কবিতায় মাঝে মাঝে উর্দু, এমনকি আরবি শব্দ ঢোকানোর ‘দোষ’ কতকটা খণ্ডে গেছে। আমাদের বহু মুসলিম ভাইদের গুণ তাঁরা দুর্গাপুজোয় অংশ নেন বা নিয়েছেন। তাঁরা ভালো। আমাদের কিছু কিছু মুসলিম ভাইদের দোষ তাঁরা দুর্গাপুজোকে পৌত্তলিকতার কারণে বিধর্মী মনে করেন! এক উচ্চশিক্ষিত, উদারমনস্ক, আর্টিস্ট আর তাঁর আমলা পিতা উদ্দীপ্তদার ‘শারদোৎসবেও’ চাঁদা দিতে, এমনকি বড়ির ছাদে মাইক বসাতে ঘোর আপত্তি করেছেন। তাঁরা খারাপ। কারণ অকথিতভাবে দুর্গাপুজো বা তাতে অংশ-বা-অনংশগ্রহণ স্বাদেশিকতার বা তার অভাবের দ্যোতক। কেউ মনে রাখেন না, যে ধর্মীয় কারণে দুর্গাপুজোর পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে আপত্তি কেবল ‘মুসলিম ভাই’-দের নয়, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিশ্চানরা ছাড়াও বৈদিক হিন্দু ধর্মের এক সংস্কারবাদী অংশ ব্রাহ্মদেরও। আমার আর উদ্দীপ্তদার চেনা কিছু উচ্চশিক্ষিত ব্রাহ্ম পরিবার ছিলেন (এখনও আছেন) যাঁদের বাড়ির লোকরা, অনেকেই অধ্যাপক, দুর্গাপুজোর সময়কার পুতুলপুজোর কলকাতাকে মানে মানে বিদায় দিয়ে বাইরে চলে যেতেন। আপামর বাঙালি বলতে পশ্চিমবঙ্গে জন্মানো, বড় হওয়া মুসলিমদের সঙ্গে ব্রাহ্মদেরও বাদ দেবো নাকি?
তার মানে কি দুর্গাপুজোয় বাঙালি মুসলমানরা কখনো অংশ নেন নি? নিয়েছেন বৈকি, বহুদিন থেকে। ইদানীংই তাতে কিছু ভাঁটা পড়েছে। ১৯৪৬ সালে মডার্ন রিভিউ পত্রিকা-র ৭৯ সংখ্যায় রামানন্দ চ্যাটার্জি ১৮৭২ সালের বিভার্লি রিপোর্ট উল্লেখ করে’ জানান যে জাতিগতভাবে হিন্দু উৎপত্তির ও নিচু জাতের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান মাথা এবং গাল কামান; মহিলারা হিন্দু বধূদের মতই সিঁথিতে সিঁদুর দেন; আর প্রায়ই দুর্গাপুজো করেন। আসলে সেই সময়কার বাঙালি মুসলমানদের মানসিক অবস্থান মুসলিমের চেয়ে বেশি হিন্দুদের কাছাকাছি ছিল, কারণ একদিকে ইসলাম ধর্মের বিস্তারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রণালীবদ্ধ প্রশিক্ষণ তেমন হয়নি। আরেকদিকে বহু শতাব্দী পাশাপাশি থেকে বাঙালি মুসলমানদের উপর বাঙালি হিন্দুদের ধর্ম এবং অন্যান্য বিশ্বাস ও সামাজিক ব্যবহাররীতির প্রভাব পড়ে’ গিয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সেন হিস্ট্রি অভ বেঙ্গলি ল্যাংগোয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার বইতে (১৯১১) দেখিয়েছেন যে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের থেকে হিন্দু পুরাণ ও দেবতত্ত্বের, মহাভারতের প্রতি তাদের আগ্রহে ব্যথিত হয়েছিলেন ষোড়শ শতকের শেষ দিকের কবি সয়ীদ সুলতান। সেন দেখিয়েছিলেন মনসাগীতিকার রচন ও গায়নে ছাড়াও তার সাহিত্যভান্ডারের সরংরক্ষণে বিশ শতকের প্রথম চতুষ্পাদ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানদের বিশেষতঃ পূর্ব-উত্তর বঙ্গের মুসলমানদের প্রধান ভূমিকা ছিল। আদি উনিশ শতকের এক মুসলিম স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ জাফর শরিফ তাঁর কানুন-ই-ইসলাম গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে নিম্নশ্রেণির মুসলমানরা হিন্দু পণ্ডিতদের দিয়ে বিবাহ ও আচার অনুষ্ঠানের শুভদিন বিচার ছাড়াও দুর্গাপুজো ও অন্যান্য হিন্দু উৎসবে অংশ নিয়েছেন। আমরা নিজেরা দেখেছি যে মারীর সময়ে শীতলা ও রক্ষাকালীর পুজো করেছেন। কলেরার সময়ে হিন্দুদের ওলাইচণ্ডীর পাশাপাশি মুসলিমদের ওলাবিবি পুজো পেতেন। শাহাদাৎ এইচ খান দ্য ফ্রিডম অভ ইন্টেলেক্ট মুভমেণ্ট ইন বেঙ্গলি মুসলিম থট (১৯২৬-১৯৩৮) গ্রন্থে কাজী আবদুল ওদুদকে উদ্ধৃত করে’ দেখিয়েছেন যে বাংলায় ওয়াহাবি প্রভাব শুরু হওয়ার আগে গ্রামীণ মুসলিমরা প্রতিমাপূজা সম্পর্কে বিদ্বিষ্ট ছিলেন না, বরং অনেক বিশিষ্ট ও সম্মানিত মুসলিম বাড়িতে দুর্গা, কালী আদি হিন্দু দেবদেবীর পুজো করতেন। ঐতিহাসিক কমল কুমার ঘটকও উনিশ শতকের অনেকটা অবধি তাঁর হিন্দু রিভাইভ্যালিজ্ম ইন বেঙ্গল রামমোহন টু রামকৃষ্ণ (১৯৯১) বইতেও মুসলিম সমাজে হিন্দু প্রথার জারণ, হিন্দু জ্যোতিষী ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মুসলিম সমাজে আদর, আর কেবল বঙ্গে নয়, দাক্ষিণাত্যে রথযাত্রা ও দুর্গোৎসবে মুসলিমদের অংশগ্রহণের তথ্য দিয়েছেন। এটা কেবল গল্পের গরু গাছে ফলা নয়!
উনিশ শতকের শেষ দশকগুলি থেকে স্বাধীনতার আগের শেষ দশকতক অবধি কিন্তু এই আন্তঃসাংস্কৃতিক ঐক্য না টেকার ইতিহাসই দেখি! শ্রমিক শ্রেণির মধ্যেও দোলদুর্গোৎসব ঘিরে তার প্রকাশও দেখা যায়। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী রিথিঙ্কিং ওয়ার্কিং ক্লাস হিস্ট্রি, ১৯৯০-১৯৪০ (১৯৮৯)বইতে দেখিয়েছেন যে ১৯২৬-এর অক্টোবরে নৈহাটিতে মিল-শ্রমিকরা লাঠি-সড়কি-নাঙ্গা তরোয়াল নিয়ে লড়াই করে মুসলিমদের ‘অপমান করতে’ মসজিদের সামনে দুর্গাপ্রতিমা বসানোর অভিযোগে। ১৯২৭-এও হাওড়ার রামকেষ্টপুরে আর হুগলির রিষড়ায় পুজোর সময়ে ‘মসজিদের সামনে গান বাজনা’ বড় বিবাদের বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৩৮-এর জুনে ‘কাঁকিনাড়ার হিন্দুরা’ বাংলার ইংরেজ সরকারকে চিঠি লেখেন দোলের সময় দাঙ্গা আর হিন্দুদের উপর মুসলিমদের আক্রমণের ব্যাপারে। ১৯৩৮-এরই অক্টোবরে টিটাগড়ের ষাটজন মুসলমান সরকারকে চিঠি দেন দুর্গার মিছিলের সময় মসজিদের সামনে গানবাজনা করার বিরুদ্ধে। সরকারের মুখ্য সচিব এইচ. জে. টোয়াইনহ্যাম স্বীকারও করেন টিটাগড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, আর বিসর্জনের মিছিলে সাধারণতঃ যা হয় তার থেকে অনেক বেশি লোকের পা মেলানোর কথা। জয়া চ্যাটার্জি বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু মুসলিম কমিউন্যালিজ্ম অ্যাণ্ড পার্টিশন, ১৯৩২-১৯৪৭ বইতে দেশভাগের ঠিক আগে বর্ধমান শহরে বড় বাজার মসজিদের সামনে দিয়ে তাদের ‘পবিত্র সময়ে’ ঢাকঢোল ও অন্য গানবাজনা সহ দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রা নিয়ে যেতে মুসলিমদের দৃঢ় আপত্তি ও হিন্দুদের দৃঢ়তর সংকল্পের কথা, যদিও ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্টেই ছিল মুসলিমরা আগে এ নিয়ে আপত্তি করেন নি। স্পষ্টতঃই পরস্পর সহিষ্ণুতার বাতাবরণ ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এই অসহিষ্ণুতার উদাহরণ দীপেশের মতে খুঁজলে তখনও অনেক পাওয়া যেতো, আর আমরা নিজদের অভিজ্ঞতায় অনেক দেখেছি।
আসলে ঔপনিবেশিক বাংলায় এবং উত্তর- ঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গে ও কলকাতায় জমিদারি ও বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সম্পর্কে মুসলিমদের তৃষ্ণা বা বিতৃষ্ণার বিবরণ দিতে গেলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে দুর্গাপুজো একটি কার্নিভাল। কালীর মত নিত্যপূজার মন্দির দুর্গার বিশেষ নেই। বাংলায় মাতৃপূজা বা ‘মাদার কাল্ট’ বহুচর্চিত হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে দুর্গা তাঁর প্রধান দাবিদার ছিলেন না। কোন জমিদার প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন— ১৫৮৩-তে রাজশাহীতে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, ১৬১০ সালে সাবর্ণচৌধুরীদের পিতৃপুরুষ বড়িশার জমিদার লক্ষ্মীকান্ত গাঙ্গুলি, নাকি নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, আর তাঁদের দুর্গামূর্তিটি কেমন ছিল— সবই বিতর্কিত। কংসনারায়ণের সময়েই নাকি সাধারণ অবর্ণহিন্দুর জমিদারের পুজোবাড়ির ভিতরে ঢোকার অনুমতি হয়, লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ, যদিও তথ্যের উৎস দেন নি! প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজনের বেশি বিশ্বাস্য প্রার্থী শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব, যিনি মূলতঃ পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ ও ইংরেজদের বিজয়ের উদ্যাপন উপলক্ষে দুর্গাপুজো করেন, ১৭৫৭ সালে, অনামা ব্রিটিশ চিত্রকরের ছবি অনুযায়ী। মন্দিরে কারণ ক্লাইভ খৃষ্টীয় থ্যাংকসগিভিং চাইলেও কলকাতার একমাত্র গির্জা সেন্ট অ্যান্স সিরাজউদ্দোউলার কলকাতা অবরোধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যদিও কিছু ঐতিহাসিকের বিরোধী বক্তব্য দেব ১৭৫৭-র ক্লাইভের দেওয়ান হন, আর ১৭৭৫ সালে নন্দকুমারের ফাঁসির পরই বিশিষ্টতা পান।
যে যে কারণে অষ্টাদশ শতক থেকে জমিদারি দুর্গাপুজোর ধুম পড়ে যায় তা হলো —জমিদারদের তরফে একদিকে মুঘল এবং নবাবদের আরোপিত হিন্দুদের উৎসব কর ১৭৭২ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রদ করে দেওয়ায় গণ উৎসবের উপর নিষেধাজ্ঞা ওঠার খুশির প্রকাশ, অন্যদিকে ব্রিটিশদের সহযোগী এক মুৎসুদ্দি শ্রেণি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠা, এতৎকাল অবধি মুসলিমদের দমন ও তাদের সম্পর্কে অধরিকতার বোধের মোচন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পরে কোম্পানির অডিটরদের হাতে নিজেদের হিসাব পড়ে যাওয়ার পরে একটু করছাড় পাওয়া ব্যয়ের সুযোগ (যেটা ব্রিটিশদের দেওয়া দিনাজপুরের রাজা বৈদ্যনাথের চিঠি থেকে পাওয়া যায়), আর শেষতঃ নিজেদের মধ্যে একটু প্রতিযোগিতার লোভ, ইত্যাদি। পরে সেটা বারোয়ারিও হয়ে যায়। প্রথম সাধারণ বাঙালি হিন্দুদের পুজো যদি হয়ে থাকে ১৯১০ সালে উত্তর কলকাতার বলরাম বসু ঘাট রোডে, তবে প্রথম বারোয়ারি পুজো হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০।
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে জমিদারি পুজোয় যে ভক্তির চেয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য ও ভূমিস্বত্ব সম্পর্কে নবধনীদের সায়েবদের সঙ্গে সখ্য ও বৈভব দর্শনের ক্ষেত্র ছিল সে কথা তপন রায় চৌধুরী দেখিয়েছেন। এই প্রতিযোগিতামূলকতা জমিদারের চণ্ডীমণ্ডপ ছাড়িয়ে বারোয়ারি মণ্ডপে একইভাবে চলছে। একে সাহায্য করেছে দুর্গাপুজোর নির্মাণস্বরূপতা (constructivity), এটা যে প্রধানা দেবী হওয়া সত্ত্বেও দুর্গার আরাধনা আগে হতো বছরে একবারই জমিদারের চণ্ডীমণ্ডপে, পরে বাড়ির বাইরে মণ্ডপে তথা ‘প্যাণ্ডালে’। সৌগত ভাদুড়ি (যাঁর লেখায় দুর্গাপুজোর উৎপত্তিগত তথ্যগুলির অধিকাংশ আছে) তাঁর ‘অফ পাব্লিক স্ফিয়ার অ্যাণ্ড সেক্রেড স্পেস: অরিজিন্স অফ কমিউনিটি দুর্গাপূজা ইন বেঙ্গল’ প্রবন্ধে (সঃ এম ডি মুথুকুমারস্বামী ও মলি কৌশল, ফোকলোর, পাব্লিক স্ফিয়ার অ্যাণ্ড সিভিল সোসাইটি, ২০০৪) দেখিয়েছেন যে দুর্গাপুজো ক্রমাগতই হয়ে উঠেছে ভাবগম্ভীর ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে বার্ষিকভাবে জন্ম দেওয়া গণক্রিয়া ও সম্মেলনের পাব্লিক স্ফিয়ার বা স্পেস। দুর্গা সেখানে চালু অর্থে দেবীর চেয়ে সাময়িকভাবে নির্মিত মণ্ডপের নিচে বা মধ্যে, উৎসবী পাব্লিকের অনিমেষ দৃষ্টির সামনে গণঅংশগ্রহণ ঘটানোর নির্মিত স্থলে, এক প্রতীক।
বিভিন্ন কারণে (ব্রিটিশদের সম্পর্কে বিরাগ ও সন্দেহ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে মুসলিম জমিদারদের ক্ষতি, আদি শাসকসম্রপদায়ের আহত আত্মাভিমান ইত্যাদি) অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক জমিদারি পুজো নিয়ে মুসলিম এলিটরা বিতৃষ্ণ ছিলেন। নিম্নবর্গের মুসলিম প্রজারা এসে’ ‘একি দুগ্গি দেখলাম চাচা’ বলেছেন, অথবা আসেন নি। বা পরে, এমনকি আজকের দিনে, শহরে অনেকে দুর্গাপুজোর গ্র্যান্ড স্পেক্ট্যাক্ল, জৌলুশ- জাঁকজমক-ঘটা দেখতে আসছেন — হিন্দু বাড়ির বাইরে, প্যান্ডেলে। এসে দেখছেন নায়িকার মুখের আদলে, বা নতুন সামাজিক-সাংস্কৃতিক থিমের আদলে গড়া দেব-দেবী-অসুর, আলো, মণ্ডপসজ্জা। তাতে করে’ দুর্গাপুজো তাঁদের উৎসব, সব বাঙালির উৎসব কেন হয়ে যাবে? কেন সেই অন্যায় দাবি করবোই বা ‘আমরা’, যারা দুই ঈদের পার্থক্য জানি না; মহরমের মিছিলের দিকে অনিশ্চিত শঙ্কার সঙ্গে তাকাই, অথবা প্রতিযোগী অস্ত্রপূজার দাবি করি; কোজাগরীর রাত জাগার এবং কার্ত্তিক মাসে আকাশপ্রদীপ আর দীপাবলীর উৎসবের সঙ্গে শবে বরাতের রাতে বিনা প্রয়োজনে, মোমবাতি, প্রদীপ জ্বালানো, আতশবাজি ও পটকা ফোটানো, মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো মেলাই না? যদি ‘অপর’, যে কোনো কারণ্ ‘আত্ম’-র আনন্দে-উৎসবে ভাগ নিতে আসে, যদি বাংলাদেশে যশোরে লোন অফিস পাড়ায় আঠাশ বছর ধরে’ বন্ধ থাকার পর কিছু সরকারি অনুদান আর স্থানীয় সহৃদয় মুসলিমদের সহযোগিতায় এমনকি কিছুটা নেতৃত্বে হিন্দুরা আবার দুর্গাপুজো করতে পারেন, যদি বাংলাদেশের অনলাইন পত্রিকা ‘পরস্পর’ ঈদ সংখ্যার মতো দুর্গাপূজা সংখ্যা করে মৌলবাদী সমালোচনা তুচ্ছ করেও, তবে ‘আত্ম’ যেন পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে সগর্বে বলতে না শুরু করে দুর্গাপুজো ‘সঅঅব’ বাঙালির উৎসব। প্রক্রিয়ার নদী থাক তার নিজের ধর্মে, তাকে প্রকল্পের বাঁধে আটকাতে গেলেই বিপদ!